বিএনপিকে রাজপথে নামাতেই ॥ বোমা মহড়া!

বিএনপিকে রাজপথে নামাতে মরিয়া জামায়াত। টার্গেট আন্দোলনের নামে দেশকে অস্থিতিশীল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত-অনিশ্চয়তায় ফেলা।
তবে একাত্তরের জামায়াতের ঘৃণ্য অপকর্মের দায় নিতে চায় না বিএনপি। বিএনপির এমন মনোভাবে নতুন ফাঁদ পেতেছে জামায়াত। হঠাৎ করেই আতঙ্ক ছড়াতে বিরোধীদলীয় নেত্রীর কার্যালয়ের সামনে পটকাসদৃশ বোমার বিস্ফোরণের মহড়া নিয়ে তোলপাড় চলছে। প্রশ্ন উঠেছে, রাজপথে বিএনপিকে নামাতে জামায়াত সুকৌশলে নিজস্ব কমর্ী বাহিনীকে দিয়ে এসব করাচ্ছে, নাকি আগামীতে বড় ধরনের কোন নাশকতা চালাতে বিরোধীদলীয় নেত্রীর কার্যালয়ের সামনে বোমা হামলার মহড়া চলছে?
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ৰণগণনা শুরম্ন হয়েছে। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৩৯ বছর পর জনগণের আকাঙ্ৰা পূর্ণ হতে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর এই প্রথম বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে যুদ্ধাপরাধীদের। যাদের অধিকাংশই এখন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বে। সরকারের এমন কঠোর অবস্থানে এতদিন বুক উঁচিয়ে চলা এসব যুদ্ধাপরাধীর মনোবল এখন শূন্যের কোঠায়। বিচলিত-অস্থির হয়ে ওঠা জামায়াত তাদের এই দুঃসময়ে চাইছে বিএনপিকে কাছে পেতে। এ নিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে রম্নদ্ধদ্বার বৈঠকও করেছেন জামায়াত আমির। তারপরও সরকারবিরোধী বড় ধরনের আন্দোলনে বিএনপিকে নামাতে পারেনি তারা। এমনকি ছাত্রদলের বর্ধিত সভাতেও খালেদা জিয়ার সামনেই জামায়াত-শিবিরকে প্রত্যাখ্যান এবং তাদের ফাঁদে পা না দেয়ার দাবি উঠেছে প্রকাশ্যই।
এসব বিচার-বিশেস্নষণে রাজনীতি সংশিস্নষ্টদের মত হচ্ছে, বিরোধীদলীয় নেত্রীর কার্যালয়ের অদূরে প্রথম দফায় দু'টি ছোট সাইজের বোমা পুঁতে রাখা এবং দ্বিতীয় দফায় গভীর রাতে পটকাসদৃশ দু'টি বোমার বিস্ফোরণ বিএনপিকে আন্দোলনের মাঠে নামানোর নতুন ফাঁদ ছাড়া আর কিছুই নয়। সরকারের বিষয়টি হাল্কা করে দেখার কোন কিছু নেই। কেননা বিএনপির ওপর আঘাত আসলে দোষ পড়বে সরকারের ঘাড়ে। এমনটা হলে বিএনপি নামবে আন্দোলনের মাঠে। আন্দোলনের কোন ইসু্য না পেয়ে হয়ত জামায়াত বা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো গোপনে নিজেদের কর্মী বাহিনীকে মাঠে নামিয়ে একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে। তাই সরকারের উচিত হবে বিষয়টি গুরম্নত্বের সঙ্গে নিয়ে আসল রহস্য উন্মোচন করা। যাতে এসব ছোটখাটো মহড়ার মাধ্যমে বিরোধীদলীয় নেত্রীর কার্যালয় বা অন্য কোথাও বড় ধরনের কোন নাশকতামূলক ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপিকে মাঠে নামানো এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতে 'এক ঢিলে দুই পাখি' শিকার করতে না পারে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে দেশকে অস্থিতিশীল করতে একটি মহল গোপনে তৎপর তা গত কয়েকদিনের ঘটনায় স্পষ্ট। জামায়াত বিগত কয়েকটি মাস ধরেই যে একটা আন্দোলন দাঁড় করানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল সেটা বিভিন্ন সময়ে তাদের বক্তব্যের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন সূত্র বলছে, জামায়াতের পরিকল্পনাটাই হচ্ছে দেশে আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করা। সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে শাসক দলকে বিভ্রানত্মে ফেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইসু্য থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের তা-ব, নিষ্ঠুরভাবে ছাত্র হত্যা, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার অফিসের সামনে থেকে ককটেল উদ্ধার, বিভিন্নস্থানে পুলিশের সঙ্গে সরাসরি শিবিরের সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া, হঠাৎ করেই পার্বত্য অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টি, পাহাড়ী-বাঙালীর ঘরে আগুন, সংঘর্ষের রেশ কাটতে না কাটতেই বিরোধীদলীয় কার্যালয়ের সামনে দ্বিতীয় দফায় ককটেল বিস্ফোরণ একই পরিকল্পনার নানা রূপ বলেই সন্দেহ করা হচ্ছে। বিএনপির চেয়ারপার্সনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে_ এ রকম একটি ইসু্য তৈরিই যে হামলার উদ্দেশ্যে ছিল তা পরিষ্কার হয় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরম্নল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে সুপরিকল্পিতভাবে প্রাণনাশের জন্যই এই বোমা হামলা চালানো হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে সংসদের হুইপ ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মির্জা আজমের সংশিস্নষ্টতা রয়েছে।
পাল্টা অভিযোগ করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, জামায়াতের পরামর্শে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেই বিএনপি এই বোমার নাটক সাজিয়েছে। জামায়াত-শিবিরের প্রীতি ছেড়ে বিএনপি গণতন্ত্রের পথে না এলে জনগণ তাদের ৰমা করবে না। সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলে আওয়ামী লীগও ঘরে বসে থাকবে না।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরম্নর ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে সরকার। ইতোমধ্যে সরকার তরফে ঘোষণা দেয়া হয়েছে মার্চেই শুরম্ন হবে এ বিচার প্রক্রিয়া। বিচার হবে দু'দফায়। প্রথমে চিহ্নিত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী রাঘববোয়ালদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। জানা গেছে, জামায়াতের শীর্ষ পদে থাকা নিজামী-মুজাহিদ-সাঈদীসহ অনেক নেতাই আছেন প্রথম তালিকায়। এসব নেতার এতদিন দৃঢ় আশা ছিল, শেষ পর্যনত্ম হয়ত আনত্মর্জাতিক অঙ্গনের কোন কোন অংশ যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে অগ্রসর না হওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করবে। কিন্তু এ ৰেত্রেও মিত্র কোন দেশ থেকে কোন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পায়নি। বরং আনত্মর্জাতিক অঙ্গনেও যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারটি ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠছে। সর্বশেষ পঞ্চম সংশোধনী দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হলে জামায়াতকে শঙ্কিত করে তোলে।
সংশিস্নষ্ট সূত্র মতে, দেশে-বিদেশে অনেকটাই বন্ধুহীন হয়ে পড়া জামায়াত নেতারা নিজেদের রৰায় অস্থির হয়ে উঠেছে। নানাভাবে বিএনপিকে রাজপথে নামার জন্য প্ররোচিত করতে এখন নানা প্রক্রিয়ায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চরম হতাশা থেকেই জামায়াত 'ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হচ্ছে'_ এ ইসু্যকে ঢাল করে অপরাপর উগ্রপন্থী ইসলামিক দলগুলোকে নিয়ে সহিংস রাজনীতির মাধ্যমে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পন্থা অবলম্বন করছে। দীর্ঘ সময়ে গড়ে ওঠা অর্থের পাহাড় থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয় করে জঙ্গী তৎপরতাকে পৃষ্ঠপোষক দেয়ার অনেক প্রমাণ এখন গোয়েন্দাদের হাতে। শুধু দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি নয়, জামায়াত-শিবির চক্র তাদের সর্বপ্রকার নৃশংসতা, বর্বরতা এবং স্বাধীনতাবিরোধী কর্মযজ্ঞ লুকিয়ে সরকারের গ্রেফতার অভিযানকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করে আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে অনুকম্পা লাভে বিপুল অর্থব্যয়ে বিদেশী লবিস্ট নিয়োগ করেছে।
সর্বশেষ বিরোধীদলীয় নেত্রীর গুলশানের কার্যালয়ের সামনে বোমার ঘটনা কোন সাজানো নাটক নাকি জামায়াতের উদ্দেশ্যমূলক ঘটনা তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চুলচেরা বিশেস্নষণ চলছে। প্রথম দফায় উদ্ধারকৃত ককটেলসদৃশ দু'টি জর্দার কৌটা এবং সর্বশেষ বিস্ফোরিত দু'টি পটকাসদৃশ ককটেল সম্পর্কে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তা এবং পুলিশের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথম দফায় উদ্ধার করা জর্দার কৌটা দু'টি আসল বোমা নয়। পরীৰামূলক বিস্ফোরণের পর কৌটা দু'টি থেকে হাল্কা শব্দ আর বের হয়েছে সামান্য ধোঁয়া। দ্বিতীয় দফায় বিস্ফোরিত ককটেল দু'টিও নিম্নমানের। সামান্য শব্দ আর ধোঁয়া ছাড়া তাতে আঘাত হানার মতো কিছু ছিল না। তাঁদের মতে, এটি কোন অপরাধ সংঘটনের জন্য তৈরি বলে মনে হয়নি। আর এসবের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কোন নাশকতা ঘটানো সম্ভব নয়। আতঙ্ক ছড়ানো অথবা ভিন্ন উদ্দেশ্যে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।
ছোট জর্দার কৌটায় বানানো ককটেল বিস্ফোরণের পর পরই রাজপথে বিৰোভ করেছে বিএনপি। বিরোধীদলীয় নেত্রীকে প্রাণনাশের চেষ্টায় এসব হামলা করা হচ্ছে অভিযোগ করে বিৰোভ কর্মসূচী দিয়েছে দলটি। সূত্র মতে, ওই ঘটনার পর পরই বিএনপির কট্টোরপন্থী বলে পরিচিত অংশটি এই ইসু্যতে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বড় ধরনের সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ বাড়ায়। এ অংশটি হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচী ঘোষণার পৰেও জোরালো অবস্থান নেয়। কিন্তু বাদ সাধে বিএনপির উদারপন্থী বলে পরিচিত অংশটি। তারা সামান্য এই ইসু্যতে বড় কোন আন্দোলনে না যাওয়ার পরামর্শ দেন বিএনপির হাইকমান্ডকে। বিএনপিকে আন্দোলনে নামাতে জামায়াত বা সরকারবিরোধী কোন অংশ এ বোমা নাটকের সঙ্গে জড়িত কী না, এ ব্যাপারেও সন্দেহ প্রকাশ করলে চুপসে যায় সুযোগ সন্ধানীরা।
সূত্র জানায়, আতঙ্ক ছড়িয়ে ইসু্য সৃষ্টি করার এই অপপ্রয়াসের বিষয়টি বুঝতে পেরে বিএনপির হাইকমান্ড এ নিয়ে বেশিদূর যেতে চায় না। শরিক দল জামায়াত বিএনপিকে আন্দোলনের মাঠে নামাতে নিজেদের কর্মী বাহিনীকে দিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে_ এমন ধারণা থেকেই পিছু হটে বিএনপি। এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের নেপথ্যের পরিকল্পনাকারীদের দ্বিতীয় দফা প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায়। মরিয়া হয়ে আগামীতে হয়ত বড় ধরনের কোন ফাঁদ পেতে জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক অপশক্তিরা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করবে- এমন ধারণা থেকেই সরকার থেকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে বলে জানা গেছে।
রাজনৈতিক বিশেস্নষকদের মতে, বিরোধীদলীয় নেত্রীর কার্যালয়ের সামনে বোমা পুঁতে রাখা, বিস্ফোরণ ঘটানো, বিভিন্নস্থানে পরিকল্পিত অস্থিতিরতা সৃষ্টির বিষয়গুলোকে সরকারের হাল্কা করে দেখার কোন সুযোগ নেই। বিষয়গুলো গুরম্নত্বের সঙ্গে নিয়ে আসল রহস্য উন্মোচন করে তা জাতির সামনে প্রকাশ করা দরকার। এর মূল রহস্য অবশ্যই সরকারকে দ্রম্নত উদ্ঘাটন করতে হবে। নইলে বিলম্বতার সুযোগে এই অপশক্তি ছোট এসব মহড়ার ধারাবাহিকতায় বড় ধরনের কোন নাশকতা চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.