একের পর এক কেলেঙ্কারিতে বেকায়দায় সরকার by আনোয়ার হোসেন

একের পর এক কেলেঙ্কারি নিয়ে এমনিতে বেকায়দায় আছে বর্তমান মহাজোট সরকার। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ ও জোটের শরিক রাশেদ খান মেননের মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যান। বিষয়টি এখন সরকার ও দলকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে।


এসব নিয়ে আওয়ামী লীগের তিনজন মন্ত্রী, পাঁচজন কেন্দ্রীয় নেতা, একাধিক সাংসদ, দুজন সাংগঠনিক সম্পাদকসহ জেলার ও সহযোগী সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব নেতা বলেন, সরকারের পৌনে চার বছরের সব কর্মকাণ্ড ছাপিয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে শেয়ারবাজারে কারসাজি, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি, সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের (সহকারী একান্ত সচিব) অর্থ কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাস। কিন্তু কোনো ঘটনায়ই সরকার সময়মতো ব্যবস্থা নেয়নি। সর্বশেষ এর সঙ্গে যুক্ত হলো মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের উদ্যোগ দুই প্রবীণ নেতার প্রত্যাখ্যান।
আর, এসব কেলেঙ্কারি নিয়ে জাতীয় সংসদের ভেতরে-বাইরে সরব ছিলেন মহাজোটের সাংসদ তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু ও ওবায়দুল কাদের। এঁদের মধ্যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও ওবায়দুল কাদেরকে ইতিপূর্বে মন্ত্রী করা হয়েছে। বাকি তিনজনের মুখ বন্ধ করতেই গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করা হয়েছে বলে মনে করেন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। কিন্তু তোফায়েল ও মেনন তা গ্রহণ না করায় বিষয়টি বুমেরাং হয়েছে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি আরেক দফা ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে জেলা পর্যায়ের অনেক নেতা মনে করেন, সরকার এ পর্যন্ত যেসব বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রক্ষা এবং ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি আড়াল করতে গিয়ে। এর ফলে দলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে সরকারের গঠনের পর পৌনে চার বছরের মাথায় এখন অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যে আওয়ামী লীগের পুনরায় ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে গভীর সন্দেহ রয়েছে।
রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে, এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালেও আওয়ামী লীগ সরকার ফেনীর জয়নাল হাজারী, লক্ষ্মীপুরের আবু তাহের, নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমানসহ বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসের ‘গডফাদারদের’ রক্ষা করতে গিয়ে ভরাডুবি ডেকে আনে। সেবারও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ ছাড়া বর্তমান সরকার কিছু অপ্রয়োজনীয় বিষয়েও বাড়াবাড়ি করে ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে বলে মনে করেন দলীয় নেতারা। এর মধ্যে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে টানাহেঁচড়া, ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে বিভক্ত করা এবং জনমতের বিপক্ষে গিয়ে আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর স্থাপনের উদ্যোগ অন্যতম। ড. ইউনূসের কারণে সরকার সম্পর্কে বহির্বিশ্বে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন অনেক নেতা।
এ ছাড়া হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে কঠোর সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মহাজোটের শরিক দলের নেতা রাশেদ খান মেননসহ আরও কয়েকজন। এর আগে শেয়ারবাজার নিয়েও সংসদে উত্তপ্ত আলোচনা হয় বেশ কয়েকবার।
আজ শনিবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেও পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে সর্বশেষ অবস্থা, হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও সর্বশেষ মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতে পারে বলে কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র এক বছর বাকি। এই অবস্থায় কিছু ব্যক্তির দুর্নাম কিংবা সরকারের নেওয়া ভুল কৌশল আগামী নির্বাচনেও প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। বিশেষ করে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলোর কারণে জনগণ আওয়ামী লীগকে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কাতারে নামিয়ে আনে কি না, সেই শঙ্কাও কাজ করছে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে।
জেলা পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শুরুটা হয়েছিল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সারা দেশে ছাত্রলীগের সহিংস সংঘাত দিয়ে। ছাত্রলীগের সংঘাত কিংবা অন্যদের দখল-টেন্ডারবাজি বন্ধ করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী। তবে টেন্ডারবাজি আর দখলবাজি ছাড়িয়ে গেছে দুর্নীতি ও আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায়। তাঁদের মতে, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং রেলের তদন্ত কমিটি যতই বলুক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মধ্যরাতের অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত নন, মানুষ তা বিশ্বাস করেনি।
জ্যেষ্ঠ একজন মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন পর্যন্ত সরকার কিছু উন্নয়নমূলক কর্মসূচি পালন করেছে, সেগুলো প্রশংসিত হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতির গতিও কিছুটা আশাব্যঞ্জক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে সরকার প্রশংসা পেয়েছে। কৃষি ও শিক্ষা খাতে এবং জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য আছে। কিন্তু সরকারের ভেতরের বা ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তির দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারি সেসব সাফল্যে কালিমা এঁকে দিয়েছে। আগামী নির্বাচনে এই বিষয়গুলোই বড় হয়ে দেখা দিতে পারে।
যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন প্রথম আলোকে বলেন, এটা ঠিক, সামান্য জিনিস বড় অর্জনকে আড়াল করে দেয়। ব্যক্তির বিষয় সব সরকারের আমলেই থাকে। তবে হলমার্কের বিষয়ে কিন্তু সরকার ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিষয়টি সমালোচিত। তবে দুদক তো বলছে, তিনি নির্দোষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন মন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ও হলমার্ক কেলেঙ্কারির কারণে মানুষ বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের সঙ্গে আওয়ামী লীগকে তুলনা করা শুরু করেছে। যে দুর্নীতির জন্য মানুষ বিএনপি-জামায়াতকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, সেই দুর্নীতির তকমা বর্তমান সরকারের গায়ে পড়লে ভোটে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
দুজন মন্ত্রী মনে করেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরপরই সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। দুই দিন আগে বা পরে হলেও প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমানকেও হয়তো পদ ছাড়তে হবে। তবে এরই মধ্যে ব্যক্তি মসিউর ও দল সম্পর্কে খারাপ বার্তা গেছে মানুষের কাছে। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনও সরকারের জন্য বিব্রতকর ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই মাস এবং বুয়েটে দীর্ঘদিন ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনের পর সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারিতেও প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টার নাম এসেছে। এখন তাঁকে পদে রাখা এবং বের করে দেওয়া—দুটিই বিব্রতকর। এ ছাড়া সুশাসনের অভাব, প্রশাসনে দলীয়করণ, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীর অযোগ্যতা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির অভিযোগ লোকমুখে ব্যাপক আলোচনায় রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.