প্রায় সাত হাজার মামলা প্রত্যাহার, এখনো চলছে

সরকারের শেষ সময়ে এসেও ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা’ প্রত্যাহার করা হচ্ছে। প্রথমে সিদ্ধান্ত ছিল, বিএনপির আমলে করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু এখন বর্তমান সরকারের আমলের খুনের মামলাও হয়রানিমূলক বিবেচনায় প্রত্যাহারের চেষ্টা করা হচ্ছে।


বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এখন হত্যা, চোখ তুলে ফেলা, টাকা আত্মসাৎ করার মতো মামলাও ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। কোনো কোনো জেলা প্রশাসক বিষয়টি নিয়ে বিব্রত ও ক্ষুব্ধ।
বর্তমান সরকার ইতিমধ্যে ছয় হাজার ৭৮৬টি মামলা সম্পূর্ণ বা আংশিক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে কমবেশি ৮১ হাজার অভিযুক্ত ব্যক্তি খালাস পেয়েছেন বা খালাসের প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। বিএনপির সরকারের সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় ৭৩ হাজার ৫০০ আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।
রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার-সংক্রান্ত কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা এ মাসেই। তার আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে মতামত চেয়ে জেলা কমিটির কাছে পাঠানো হয়। গত ২২ জুলাই মামলা প্রত্যাহার-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির কাছে প্রতিবেদন দিয়েছে বিভিন্ন জেলা প্রশাসন।
আসামি সরকারদলীয়, তাই নিয়মের ঊর্ধ্বে: লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং কমলাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান শওকত আলী একটি হত্যা এবং আরেকটি হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি। ঘটনা দুটি ২০০৯ সালের।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, তোতা মিঞা হত্যা মামলা ও আবদুস সামাদের চোখ নষ্ট করাসহ হত্যাচেষ্টা মামলার এই আসামি সরকারদলীয় হওয়ায় মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে জেলা কমিটি। কিন্তু সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ সরকারের আমলের মামলা প্রত্যাহার করা যায় না।
শওকত আলী চোখ নষ্ট করার মামলার ফেরারি আসামি। ২০১২ সালের ২৭ মার্চ তাঁর চেয়ারম্যান পদ বাতিল করে আদালত রায়ও দেন। তিনি এর বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। মামলা দুটি প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছেন লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক ও কমিটির সভাপতি মোখলেছার রহমান। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান এতে লিখিত সুপারিশ করেন।
জেলা প্রশাসক প্রথম আলোকে বলেন, কমিটির সদস্য হিসেবে ও অন্যদের সুপারিশের আলোকে রাজনৈতিক মামলা হিসেবে তা প্রত্যাহারের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে করা মামলা কোন সিদ্ধান্তে ‘হয়রানিমূলক’ হিসেবে গণ্য করে প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হলো—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কমিটির সদস্যদের সুপারিশের আলোকে তিনি এটা করেছেন।
দুদকের মামলাও প্রত্যাহারের সুপারিশ: ২০০৯ সালের ৭ নভেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে কাপ্তাই থানায় অননুমোদিতভাবে জ্বালানি খরচ করার অভিযোগে মামলা করা হয়। মামলার আসামি কর্ণফুলী পেপার মিল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিক লীগের কাপ্তাই আঞ্চলিক শাখার সভাপতি মো. শাহজাহান। ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর মামলা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেন তিনি। তবে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। মামলা প্রত্যাহার-সংক্রান্ত রাঙামাটি জেলা কমিটির সদস্যসচিব ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাইফ উদ্দিন আহম্মদ বলেন, দুদকের মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করার এখতিয়ার জেলা কমিটির নেই। তবে কেউ মারা গেলে তাঁর মামলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রত্যাহার হয়ে যায়।
মহাজোট সরকার এসে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ প্রণয়নে জাতীয় কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির কাছে মামলা প্রত্যাহারের আবেদনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন বিশেষ বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
জেলা প্রশাসকদের কেউ কেউ বিব্রত: গত এপ্রিলে ৩৪ জেলার প্রশাসকের কাছে মামলার নথির বিষয়ে জানতে চেয়ে চিঠি পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। পাঁচ মাস পার হলেও নয় জেলার প্রশাসক মতামত পাঠাননি।
অভিযোগ উঠেছে, জেলা প্রশাসকদের চাপ দিয়ে মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ আনা হচ্ছে। অন্যদিকে জেলা কমিটির বৈঠক না ডেকেই সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) বা আওয়ামী লীগের নেতারা সুপারিশ করছেন। আর জেলা প্রশাসকেরা সুপারিশ পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন।
কয়েকজন জেলা প্রশাসক প্রথম আলোকে বলেন, কিছু মামলা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক না হওয়ায় তাঁরা বৈঠক করেননি, সুপারিশও পাঠাননি। একজন জেলা প্রশাসক তাঁর পাঠানো মতামতে লিখেছেন, মামলায় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। তাই প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করা গেল না।
এর আগে আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন জাতীয় কমিটির কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর ‘রাজনৈতিক কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিন খসরু। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁর নেতৃত্বে কমিটি করা হয়েছিল। কমিটি দীর্ঘদিন যাচাই-বাছাই করে মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। মূলত যাঁরা প্রকৃতভাবেই রাজনৈতিক হয়রানির শিকার এবং যাঁরা সরকারের নির্ধারিত সময়ে আবেদন করতে পারেননি, তাঁদের মামলা যাচাই-বাছাই করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.