ভুলবার নয় সিরাজকে by বেলাল চৌধুরী

৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ পরলোকগমন করেছেন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। তাঁর অলীক মানুষ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য কীর্তি। একসময়ের পরিচিতজন ও গুণীবন্ধুকে নিয়ে এক কবির স্মৃতিচারণা
বিগত শতকের ষাটের দশকে বোধ করি আমি প্রথম সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গল্প ‘রাণীঘাটের বৃত্তান্ত’ পড়ি।


তখন ছোটগল্প নামের একটি পত্রিকা বের হতো। এতে অতীন, দেবেশ, দিব্যেন্দু, শীর্ষেন্দু, শংকর, রতন ভট্টাচার্য, সন্দীপন প্রমুখের লেখা পড়লেও সিরাজের লেখা পড়েছি অন্য কোথাও। তখন আসলে এসব অত্যাশ্চর্য সব ছোটগল্পের স্বাদ পাচ্ছি বিমল করের সম্পাদনার সৌজন্যে। আমি অবশ্য ঢাকাতে বসেই পড়ছি। তখনো বইপত্র আসা বন্ধ হয়ে যায়নি।
এরপর একসময় জলে ভাসতে ভাসতে যখন কলকাতায় নোঙর ফেলি, তখন কলেজস্ট্রিট কফি হাউস হয়ে যায়; বলতে গেলে দিবারাত্রির ঠিকানা তখন প্রথম চাক্ষুষ করি আরও অনেকানেক কবি-সাহিত্যিক-লেখকের মধ্যে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে।
তিনি তখন সদ্য ‘আলকাপ’ অর্থাৎ লোকনাট্যের একটি ধারা অনেকটা আমাদের চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘নাট্যাপোয়ার নাচ’ বা সদ্যপ্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের শেষ চলচ্চিত্র ঘেটুপুত্র কমলারই অন্যতম সংস্করণ বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। অবশ্য সিরাজ দেশ পত্রিকায় ‘লোকনাট্য, আলকাপ বনাম থার্ড থিয়েটার’; নামে একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন। আলকাপ দলে ছেলেরাই মেয়ের অভিনয় করে। ‘ছোকরা’ বলা হয় তাদের। হাবভাব সব মেয়েদের মতো। ওস্তাদ ঝাঁকসু, আলকাপের রাজা মানা হতো তাঁকে। তিনি আমায় বলেছিলেন একবার গঙ্গার পাড়ে বসে, ‘আপনি একজন লেখাপড়া জানা শিক্ষিত লোক, আপনি এদের মধ্যে থাকলে পড়ে যাবেন।’ অধঃপতনে যাওয়ার কথা বলছিলেন আরকি! তিনি আরও বুঝিয়ে বলেছিলেন ‘মায়া’ বলে একটা কথা আছে। ডায়ালগটা আমার ‘মায়ামৃদঙ্গ’ উপন্যাসে ব্যবহার করেছি। আসলে এটা একধরনের ইলিউশন। যাকে বলে অধ্যাস। অর্থাৎ সত্তা বা গুণাগুণ আরোপ। এক বস্তুতে অন্য বস্তুর বা তার গুণের কল্পনা। যেমন রজ্জুতে সর্পজ্ঞান বা একচন্দ্রস্থলে দ্বিচন্দ্রের অথবা শুক্তিতে রজতের প্রতীতি। সিরাজ অনেক লিখলেও তাঁর একমাত্র প্রদীপ হয়ে জ্বলছে অলীক মানুষ উপন্যাসটি। মুসলমান সমাজকে নিয়ে লেখা অলীক মানুষ একসঙ্গে অনেক পুরস্কার এনে দিয়েছে তাঁকে। অলীক মানুষ এক আশ্চর্য ফর্মে লেখা। বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম। মুসলিম-হিন্দু জীবনের যৌথ সামাজিক জীবনাচার। অলীক মানুষ উপন্যাসটি শেষ করতে গিয়ে সিরাজ যখন ভেবে কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছিলেন না, তখন বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাহিত্যামোদী, অধ্যাপক এবং বাংলা গদ্যের একজন গবেষক আনিসুজ্জামান উপন্যাসটির সমালোচনা করাতে সিরাজ দিশা খুঁজে পেয়ে নতুন করে লিখতে শুরু করেন। এমনকি উপন্যাসটির শেষাংশটুকু পর্যন্ত আনিসুজ্জামানের দেওয়া। ফলে সিরাজের পক্ষে এরপর অনর্গলভাবে লিখে উপন্যাসটি শেষ করতে অসুবিধা হয়নি। সিরাজের এই অকপট স্বীকারোক্তিতে বোঝা যায়, শুধু লেখক হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও সিরাজ কত বড়মাপের ছিলেন। সিরাজ প্রথম দিকে অনেক দিন কবিতা লিখেছেন। কলকাতায় এসে পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। পাত্তা পাননি। ’৬৪ সালের দিকে সন্তোষকুমার ঘোষের বদান্যতায় আনন্দবাজার-এ চাকরি পান। এরপর সংসারটা ঠিকঠাক চলতে শুরু করে। সাংবাদিকতার হাতেখড়ি ওই সন্তোষ ঘোষের কাছেই। সংবাদে সাহিত্য কতটুকু থাকবে, তাঁর কাছ থেকেই শিখেছিলেন।
সিরাজের ছোটগল্পের গুণগ্রাহী ছিলেন অনেকেই। তাঁদের মধ্যে প্রতিভা বসু, গৌরকিশোর ঘোষ। এমনকি সাগরময় ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ অনেকেই ছিলেন। শারদীয় দেশ পত্রিকায় তাঁর রত্নরাজিসম অসংখ্য গল্প ছাপা হলেও ভুল বোঝাবুঝির ফলে উপন্যাস কখনোই ছাপা হয়নি।
কিশোর উপযোগী সাহিত্য আর গোয়েন্দা কাহিনি রচনায় সিরাজের অনুরাগী ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী থেকে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত। সত্যজিৎ রায় তো সন্দেশ বিশেষ সংখ্যার জন্য সিরাজের লেখা চেয়ে অনুরোধ করেছিলেন, অনুরোধ করেছিলেন গোয়েন্দা গল্প লেখার অভ্যেসটা না ছাড়ার জন্য। আশ্চর্যজনকভাবে সিরাজের বইয়ের কাটতি না হলেও সিরাজ অনেকেরই প্রিয় লেখক ছিলেন।
নিজের অভিজ্ঞতা আর প্রকৃতির কাছে সিরাজ বারবার ফিরে গেছেন তাঁর কালজয়ী রচনাগুলোর জন্য। সিরাজের বিচিত্র ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুলিটি নেহাত ছোট ছিল না। মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের খোসবাসপুরে সিরাজের সঙ্গে একবার গিয়ে আমি জীবনের নানা বিষয়ে যেসব জ্ঞান অর্জন করেছিলাম, সেসব কোনো দিনই ভুলবার নয়। উপরন্তু এও বুঝতে পেরেছিলাম যে সিরাজের অফুরন্ত গল্পের ভান্ডারে যে কত শত হীরকখণ্ড রয়ে গেছে সেগুলো সঠিক পরিচর্যা পেলে বিশ্ব সাহিত্যের মণিমুক্তা হিসেবে পরিগণিত হতে পারত।

No comments

Powered by Blogger.