ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত নয় by হাসান বারারি

লিবিয়ার বেনগাজিতে অবস্থিত মার্কিন কনস্যুলেটে মঙ্গলবার মধ্যরাতের হামলায়_ যাতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টোফার স্টিভেন্স ও তার তিন সহকর্মী নিহত হয়েছেন_ কাপুরুষত্ব ও অপরিণামদর্শিতা ছাড়া কিছু নেই।
এই সন্ত্রাসী হামলা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বিবেচনা করা দরকার।


প্রথমত, আরব বসন্তজুড়ে ওবামা প্রশাসন সাধারণ আরবদের স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জনের ন্যায্য সংগ্রামকে সমর্থন দিয়ে গেছে। লিবীয় বিপ্লবে আমেরিকা যদি দৃঢ় ভূমিকা না গ্রহণ করত, খুব সম্ভবত গাদ্দাফি এখনও ক্ষমতায় থাকতেন এবং সে দেশের নাগরিকদের পক্ষে জীবনের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হতো না। আমি যদি লিবিয়ার নাগরিক হতাম, আমেরিকার প্রতি কৃতজ্ঞতার মনোভাবে কার্পণ্য থাকত না।
একই সঙ্গে আমার কাছে এটাও মনে হয়েছে, ধর্ম অবমাননাকর মুভিটি বিশ্বের দেড়শ' কোটি মুসলমানের জন্য সত্যিই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী ও উস্কানিমূলক। চলচ্চিত্রটি ছাড়াও হলো এমন সময় যখন আমেরিকার নাগরিকরা নাইন-ইলেভেনের ভয়ানক সন্ত্রাসী হামলার বার্ষিকী পালন করছে। আমি নিজেও কয়েক দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলাম এবং সে সময় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। এক ভোজসভায় দেখা হয়েছিল জনৈক ডাক্তারের সঙ্গে। তিনি পরিষ্কার যুক্তি দিয়ে বললেন যে, আমেরিকার গত কয়েকটি প্রশাসনের উচিত ছিল আরবদের ভিন্নভাবে দেখা। তিনি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিরই বিরোধিতা করেননি, কিছু আশার বাণীও শোনালেন যে বর্তমান প্রশাসন পরিস্থিতির উন্নতিমূলক পরিবর্তন ঘটাতে পারবে। তার দূরদর্শী ও বিজ্ঞজনোচিত কথাবার্তা আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল ও নাড়া দিয়েছিল। তিনি অবশ্য আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছিলেন যে, ১১ সেপ্টেম্বরের ভয়াবহ অঘটন থেকে অনেকে কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করেনি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন বলেন_ 'যুক্তরাষ্ট্র যেমন অন্যের ধর্ম বিশ্বাসে অবমাননার যে কোনো অপচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করে, তেমনই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর জীবন কেড়ে নেওয়ার মতো উন্মাদ সহিংসতারও সর্বাত্মক বিরোধিতা করে'_ আমি তার সঙ্গে সর্বাংশে একমত পোষণ করি। এই বিবৃতির প্রথম বাক্যাংশ পথনির্দেশমূলক। বারাক ওবামা সম্ভবত গত কয়েক দশকের মধ্যে আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি তার দেশের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের ব্যবধান কমিয়ে আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন।
বস্তুত আমরা এক ছোট্ট অথচ বৈচিত্র্যময় পৃথিবীতে বাস করি। কেউ যদি অপরের ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে নিজে রায় দিতে শুরু করে, সেটা আসলে বিরোধ ও সংঘাতের পথ প্রশস্ত করার মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়। বিশ্বকে আরও শান্তিময় করে তুলতে সৌদি বাদশা আবদুল্লাহও যেভাবে বিশ্ববাসীর কাছে আন্তঃধর্ম সংলাপ বৃদ্ধির আবেদন জানিয়েছিলেন, সেটা সঠিক ছিল। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের চারপাশে সবসময়ই এমন কিছু লোকজন থাকে, যারা এ ধরনের উদ্যোগ জটিল করে তোলেন। দ্বিতীয় বিবেচনার বিষয়টি এখানেই।
আমি সত্যিই বুঝতে পারি না যে ইসরায়েলি-আমেরিকান ওই পরিচালক কেন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। তিনি কেন কোটি কোটি মুসলমানের অনুভূতির বিষয়টি বুঝতে ব্যর্থ হলেন? ওই মুভি কেবল কারিগরি দিক থেকে দুর্বল এবং ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃতিতে ভরা নয়; এটা ঘৃণা ছড়ানো এবং আমাদের অঞ্চলকে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেওয়ার উপাদানে পরিপূর্ণ। তার উদ্দেশ্য ও চলচ্চিত্রটির প্রভাব নিঃসন্দেহে বিষমাখা।
এটা ঠিক যে, এখন সিরিয়ার বাশার আল আসাদ হাততালি দেবেন। তিনি আনন্দিত যে, একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর খেসারত দিতে হচ্ছে আমেরিকাকে। কিন্তু একটি কাপুরুষোচিত হামলার কারণে মার্কিন প্রশাসনের হতাশ হওয়া চলবে না। বরং ওবামা প্রশাসনের উচিত এসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিবিয়ার সরকারকে সহযোগিতা করা। আরব বিপ্লবের প্রতি সমর্থন যদি আমেরিকা উঠিয়ে নেয়, তাহলে দুর্বলতাই প্রকাশ পাবে এবং আরও হামলা ডেকে আনবে।
আমি নিশ্চিত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনি লিবিয়ার হামলাকে রাজনৈতিক রঙ দিতে যাচ্ছেন এবং এটাকে বারাক ওবামার নেতৃত্বের ব্যর্থতা হিসেবে দেখাবেন। তার জন্য এই হামলা নির্বাচনী খেলায় কিস্তিমাতের চাল হিসেব কাজে লাগতে পারে। কিন্তু তারপরও আমরা আশা করি, প্রেসিডেন্ট ওবামা ভারসাম্যপূর্ণ ও বিজ্ঞজনোচিত প্রতিক্রিয়া দেখাবেন এবং আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে এমন পদক্ষেপ নেবে না যা জঙ্গিবাদ ও চরমপন্থাকেই শক্তিশালী করবে।

অধ্যাপক ড. হাসান বারারি : জর্ডানের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও মধ্যপ্রাচ্য
বিশেষজ্ঞ; আরব নিউজ থেকে
ভাষান্তর শেখ রোকন
 

No comments

Powered by Blogger.