জাতীয় আয়কর দিবস-কর আইনের সংস্কার কী ও কেন by মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

এ দেশের আয়কর আইন হবে এ দেশেরই আবহমান অর্থনীতির আবহে লালিত ধ্যান-ধারণার প্রতিফলক; হবে সহজবোধ্য, জটিলতা পরিহারী এবং এর প্রয়োগ হবে স্বাচ্ছন্দ্যে সর্বজনীন ব্যবহার উপযোগী। তবেই বাড়বে এর গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন যোগ্যতা।
করদাতা যেন নিজেই নিজের কর ফরম পূরণ, কর নির্ধারণ এবং সরাসরি তা দাখিলে সক্ষম হন
বাংলাদেশের বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশটি নতুন মলাটে আইন হিসেবে প্রমিতকরণের কাজ শেষ পর্যায়ে। রাজস্ব আইনের সংস্কারের এ আয়োজন-উদ্যোগ সহসা সচকিত নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলছে পরিকল্পনা আর প্রাজ্ঞ পরামর্শকদের প্রয়াস-পারঙ্গমতা। রাজস্ব আইন সংস্কারের উদ্যোগের আগ্রহ-অভিপ্রায়ে কোনো কমতি নেই, কিন্তু বিদ্যমান আইনে 'শতেক শতাব্দী ধরে নামা শিরে অসম্মানভারের' লাঘব প্রকৃত প্রস্তাবে ঘটছে কি-না, সংস্কারকৃত আইন কতটা বাস্তবায়নসম্মত, আয়কর আহরণকারী এবং দাতার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা এবং তার রূপকল্প ও তাৎপর্য তুলে ধরতেই এবারের আয়কর দিবসের এ ভাবনা।
বাংলাদেশে বিদ্যমান আয়কর আইনের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি হলে দেখা যাবে এ আইন জন্মগতভাবে ব্রিটিশ, দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে ঔপনিবেশিক এবং প্রায়োগিক দিক থেকে জটিল, নিবর্তনমূলক ও প্রতিরোধাত্মক। এ দেশে ভূমি কর বা রাজস্ব আদায়ের প্রথা প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে চলে এলেও এ দেশে আধুনিক আয়কর প্রবর্তিত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে। আমরা জানি, এ দেশ ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্বাধীনে চলে যায়। পরবর্তী ১০০ বছরে এদেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্তাকে পরনির্ভরকরণ কার্যক্রম চলতে থাকে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এ দেশের শাসনভার কোম্পানির কাছ থেকে ব্রিটিশ সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়। ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল ভারতে প্রথম ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জেমস উইলসন (১৮০৫-১৮৬০) তার বাজেট বক্তৃতায় এ দেশে প্রথম আধুনিক আয়কর প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন। আয়কর আইন প্রবর্তনের দু'মাসের মাথায় ডিসেন্ট্রিতে কলকাতাতেই মারা যান উইলসন। প্রথম থেকেই আদায়ের ক্ষেত্রে করদাতাদের প্রতি বশংবদ অদায়িত্বশীল আচরণ, পারস্পরিক অবিশ্বাস, ফাঁকিজুঁকি প্রতিরোধাত্মক ঔপনিবেশিক মনোভাব প্রাধান্য পায়। করযোগ্য আয় নির্ধারণ থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে পরিপালনীয় বিধি-বিধানের ভাষা জটিল ও দ্ব্যর্থবোধক হয়ে ওঠে।
১৯৪৭-এ ভারত বিভাগের পর আয়কর আইনে যেখানে 'ভারত' লেখা সেখানে 'পাকিস্তান' এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর 'বাংলাদেশ' প্রতিস্থাপনকরত প্রবর্তিত হয়। শাসকের ও শাসিতের মধ্যকার হরিজন্টাল ও ভার্টিকাল সম্পর্কের শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন সত্ত্বেও আয়কর আহরণ সংক্রান্ত ধ্যান-ধারণা একই থেকে যায়। ভারতীয় প্রজাতন্ত্র ১৯৬১ সালে সে দেশের রাজস্ব আইনকে নিজস্ব সমাজ ও সময়ের দাবির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পুনর্গঠিত আইন প্রবর্তন করে। আর আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ (১৯৮৪ সালের ৩৬ নং অধ্যাদেশ) জারির মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজস্ব আয়কর আইন প্রবর্তিত হয় ১৯৮৪ সালে। তখন দেশে আইন পরিষদ বিদ্যমান না থাকায় রাষ্ট্র ও নাগরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও গণ-গুরুত্বপূর্ণ আয়কর আইনটি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি হওয়ায় এটির প্রণয়ন ও প্রয়োগ যোগ্যতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। বারবার দাবি উঠেছে আয়কর অধ্যাদেশের স্থলে আয়কর আইন প্রণয়নের। ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ভাষা ও গতিপ্রকৃতি নিবিড় পর্যবেক্ষণে গেলে এটা প্রতীয়মান হয়, বছর বছর অর্থ আইনে যে সব শব্দগত সংযোজন-বিয়োজন এবং মূল ধারণার আওতায় প্রয়োগ যোগ্যতার মাপকাঠির পরিবর্তন বা পরিমার্জন অনুমোদিত হয়েছে তা ধারণ করা ছাড়া মূল ঔপনিবেশিক আইনের ভাব-ভাষা-দৃষ্টিভঙ্গিগত তেমন কোনো পরিবর্তন বা সংস্কার দৃশ্যগোচর হয় না। বরং প্রতিবছর কর নির্ধারণ, শুনানি, বিচার-আচারে কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বা এখতিয়ার, কর অবকাশ, নিষ্কৃতি ছাড় কিংবা বিশেষ সুবিধাবলির ধারা-উপধারা সংযোজন-বিয়োজন করতে করারোপ, আদায় ও করদাতার অধিকার, কর অবকাশ নিষ্কৃতি ও সুবিধা সংক্রান্ত মৌল দর্শন অনেক ক্ষেত্রেই হয়েছে বিস্মৃত। যুগধর্মের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কর নির্ধারণ ও আদায় সংক্রান্ত বিধানাবলি সহজীকরণ, সরলীকরণ তথা করদাতা বান্ধবকরণ করা না হলে আইন আরও জটিল হতে পারে।
আর এ নিরিখেই আয়কর আইনের ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে পুরোপুরি সংস্কারের আওতায় আনা আবশ্যক। স্বেচ্ছায় করদানে সক্ষম করদাতাকে উদ্বুদ্ধকরণের ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ততায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় এমন নিরুৎসাহিত বোধের কারণগুলো শনাক্ত করে উপযুক্ত বা প্রযোজ্য পরিবর্তন আনা এবং সংস্কারকৃত সেই আইন প্রয়োগেও রাজস্ব আহরণ বিভাগের মানসিকতার (সরহফংবঃ) সমন্বয় প্রত্যাশিত থেকে যাবে। সহজ ও সর্বজন বোধগম্যতার জন্য এ আইন হতে হবে বাংলা ভাষায় । ইংরেজি ভাষায় প্রণীত আয়কর আইনের খসড়ার ওপর জন-মতামত চাওয়া হচ্ছে। অথচ ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রয়োগ আইন পাসের পর দেশের সব আইন বাংলা ভাষায় প্রণয়নের বিধান রয়েছে। বিদ্যমান আয়কর আইন স্রেফ পুনর্লিখন এবং কী কী নতুন খাতে কর আরোপ করা হতে পারে (যা প্রতি বছর অর্থ আইনের মাধ্যমে পরিবর্তনযোগ্য) এমন বিষয়কে মতামতের বিষয়ভুক্ত না করে আইনের মৌল দৃষ্টিভঙ্গি তথা দার্শনিকতাকে, দুর্বোধ্য ও দ্ব্যর্থবোধকতাকে করদাতার দায়িত্ব-কর্তব্য তথা তার মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধি-বিধানকে আইন প্রয়োগের প্রাকরণিক ও পদ্ধতি প্রক্রিয়া সংক্রান্ত ধারা-উপধারাগুলোকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আবহাওয়া ও সংস্কৃতিতে গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে নির্মাণে মনোযোগী হওয়ার সময় শেষ হয়ে যায়নি। বাইরের থেকে কোনো আইনের কাঠামো ও ভাষ্য চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস নিকট-অতীতেও ছিল। তড়িঘড়ি করে কিংবা বাইরের মুসাবিদায় আইন প্রণীত হলে সমস্যা থেকেই যাবে।
এ দেশের আয়কর আইন হবে এ দেশেরই আবহমান অর্থনীতির আবহে লালিত ধ্যান-ধারণার প্রতিফলক; হবে সহজবোধ্য, জটিলতা পরিহারী এবং এর প্রয়োগ হবে স্বাচ্ছন্দ্যে সর্বজনীন ব্যবহার উপযোগী। তবেই বাড়বে এর গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন যোগ্যতা। করদাতা যেন নিজেই নিজের কর ফরম পূরণ, কর নির্ধারণ এবং সরাসরি তা দাখিলে সক্ষম হন। অর্থনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে অবস্থানরত করদাতারা যেন অভিন্ন আচরণে আইনগতভাবে কর দেওয়ায় দায়িত্বশীল হতে স্বতঃস্ফূর্ততা বোধ করেন। কর আদায় নয়, কর আহরণে করদাতা ও কর আহরণকারীর মধ্যকার দূরত্ব যত কমে আসবে, যত বেশি মাত্রায় করদাতা কর নেটের আওতায় আসবেন, তত কর রাজস্ব আহরণে সুষম, সহনশীল ও দায়িত্ববোধের বিকাশ ঘটবে। এমন পরিস্থিতিতে করদাতাকে তাড়া করে ফেরার মতো স্পর্শকাতরতার অবসান ঘটবে।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ :সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.