শিল্পীর ভুবন- জাল ও জলের স্বরলিপি by সিলভিয়া নাজনীন

‘ছবি এঁকে শিল্পী হব এবং চিত্রকলা একদিন আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠবে, তা কখনো ভাবতেই পারিনি।’ শিল্পী ফরিদা জামান এভাবেই বলতে শুরু করেন। শিল্প নিয়ে উপলব্ধির জগৎ তিনি নিজের মতো করেই সৃষ্টি করেছেন। ক্যানভাসকে সীমাবদ্ধ পরিসর মনে হয় না কখনোই।


একটি ফ্ল্যাট সারফেসকে নতুন সব কম্পোজিশনে সাজিয়ে তোলাও আনন্দের ব্যাপার। তবে ছবি আঁকা তাঁর কাছে এতটাই স্বচ্ছন্দময় যে তা শুরু করলেই স্বল্প সময়ে চিত্রপট বিভিন্ন স্বপ্নিল অনুভূতিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের শিক্ষক-আবাসিক এলাকার এক নিরিবিলি পথের পাশেই শিল্পীর স্টুডিও। শিল্পী ফরিদা জামানের বেশির ভাগ সময় কাটে এই স্টুডিওতে। একপাশে ছবি আঁকার সরঞ্জাম—ইজেল, ক্যানভাস-কাগজ-রং-ব্রাশ-কালি-কলম, অন্যদিকে শিল্পসম্বন্ধীয় বই-ম্যাগাজিন আর নানান দেশের বিভিন্ন ধরনের দর্শনীয় উপকরণ।
ফরিদা জামানের শৈশবের একটা বড় অংশ কেটেছে চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনার পাহাড়ি প্রকৃতির নৈসর্গিক পরিবেশে, যা তাঁর চেতনাকে প্রকৃতির সঙ্গে আরও নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ করেছে। নদীর মানুষ বা নদীপাড়ের জনজীবন ও নিসর্গ তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে প্রতি মুর্হূতে। জীবনের সৌন্দর্য তিনি খুঁজেছেন জল এবং জললগ্ন সরলতায়। প্রতিটি বিষয়কে দেখার যে অভিজ্ঞতা শিল্পী নিজের মধ্যে নির্মাণ করেছেন, তা অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া দুরূহ। তাঁর চিত্রকল্প শুধুই নদীকেন্দ্রিক রোমান্টিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে না, তিনি সর্বদাই মানুষের সঙ্গে নদীর সম্পর্ককে উপজীব্য করেন। ফরিদা জামান শিল্পীজীবনের শুরু থেকেই মাছ ধরার জাল ও মাছকে কেন্দ্র করে নানা প্রতীকী ঢঙে ছবি এঁকেছেন। এই বিষয় নিয়ে যে স্বকীয় শৈলী তিনি নির্মাণ করেছেন, তা তাঁর চিত্রপটকে বিশেষায়িত করে তোলে। ‘জেলে এবং তাদের জীবন আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এটি আমাদের শিকড়ের এক দৃঢ় বাঁধন।’ তাই তাঁর স্মৃতিতে এই নদী, গ্রাম, জেলেজীবন ও নিসর্গ বারবার ফিরে এসেছে। তিনি প্রকৃতিকে উপলব্ধি করেন একান্ত নিজের মতো করে। তাঁর জীবন দর্শনে প্রকৃতির সরলতাকে সহজ তুলির আঁচড়ে বিনির্মাণ করেন।
শিল্পী ফরিদা জামান মনে করেন, ছবি আঁকার জন্য দক্ষতা প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘আমার মনের শিল্পবোধ থেকে আমি যা বলতে চাই, চিত্রতলে তারই উপস্থাপন। তাই এ ক্ষেত্রে দক্ষতার বিকল্প নেই। সময়কে ধরে রাখার একটি মাধ্যম চিত্রকলা। ইতিহাসকে শুধু নয়, বরং নিজের সত্তাকে রূপায়িত করার একটি মাধ্যম এটি। ভাবনার ধারাবাহিকতার সঙ্গে সব সময় কাজেরও একটা ধারাবাহিকতা থাকতে হয়।’
ফরিদা জামানের কাজে তুলনামূলকভাবে নারী বেশি উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি আমাদের প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক ধারণাকে অস্বীকার করে তাঁর পেইন্টিংয়ে নিয়ে আসেন ‘ফিশিং ওমেন’, যা আমাদের সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের নতুন রূপের উপস্থাপনা। শিল্পীর ভাষায়, ‘চিরন্তন বাংলার মেঠোপথের মতোই আমার পেইন্টিংয়ের চরিত্র। এখানে কোনো কিছুই আরোপিত নয়, বরং স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়ে ওঠা।’
সংযোজন-বিয়োজনের নিরীক্ষা শিল্পী ফরিদা জামান সর্বদাই করেন। তাঁর ‘সুফিয়া’ শীর্ষক সিরিজ অনন্য সাধারণ নানাভাবেই। বৃক্ষ-লতার মতোই এখানে দেহাবয়ব লতিয়ে যাওয়া কোমলতায় পরিপূর্ণ, এখানে নাগরিক সৌন্দর্যের কোনো ছাপ নেই; প্রকৃতির সঙ্গে নদী, নৌকা ও পাখির নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকা। প্রকৃতি ও নারী তাঁর পেইন্টিংয়ে একাকার হয়ে যায়। ভারতীয় দর্শনে নারীকে যেভাবে প্রকৃতি অর্থে উপস্থাপন করা হয়, ঠিক সেভাবে নয়। শিল্পী আমাদের জানাতে ভোলেন না যে এই সুফিয়া কল্পলোকের কোনো চরিত্র নয়, বরং বাস্তব পৃথিবীর সংগ্রামী সাধারণ নারী।
শিল্পী ফরিদা জামান জীবনের অর্থহীন অস্থিরতা, প্রতিযোগিতা ও জটিলতাকে সযতনে এড়িয়ে চলেন। এমনকি পোস্টমর্ডান জটিল শিল্পকে প্রতিনিধিত্ব না করে পরিচিত লোকজ জীবন, নিসর্গ, চেনা পাখি, মাছ, জাল প্রভৃতিকে ক্যানভাসে শৈল্পিক চেতনায় রূপায়িত করেন। তাঁর প্রকাশভঙ্গিও অনেক বেশি সংবেদনশীল, প্রকৃতি অভিমুখী ও সহজ-সরল জীবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষায় পরিপূর্ণ। জটিল বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে স্নিগ্ধ নৈসর্গিক সরল প্রাকৃতিক জীবনের মুখোমুখি হতে আহ্বান জানায় ফরিদা জামানের শিল্পকর্ম।

শিল্পী ফরিদা জামান: জন্ম ১৯৫৩ সালে, চাঁদপুরে। ১৯৭৪ সালে বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বিএফএ, ১৯৭৮ সালে এমএস ইউনিভার্সিটি অব বরোদা থেকে এমএফএ এবং ১৯৯৫ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন থেকে পিএইচডি করেছেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

No comments

Powered by Blogger.