মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য ভেস্তে গেছে! by পাভেল হায়দার চৌধুরী

শেষ বেলায় ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব কমানো, জোটের শরিকদের সঙ্গে মনোমালিন্য দূর করা এবং পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ও হলমার্ক কেলেঙ্কারিসহ চলমান বিভিন্ন সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর উদ্দেশ্যেই হঠাৎ করে মন্ত্রিসভায় চতুর্থ দফা রদবদল করা হয়।


তবে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় মন্ত্রিসভায় রদবদলের এ উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফলতা পায়নি। দলের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য জানান, তাঁরা আওয়ামী লীগ করেন এবং করবেন। কিন্তু শেষ সময়ে এসে মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ব্যর্থতা ও দুর্নামের ভাগী হতে চান না। সাড়ে তিন বছরের অবহেলার উপশম এভাবে হওয়ার নয়। উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ কেন মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব নাকচ করলেন জানতে চাইলে ওই নেতা বলেন, এ বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সরকারকে কিছুটা বিপাকে পড়তে হয়েছে। মন্ত্রিসভার রদবদলের উদ্দেশ্যও অনেকটা ভেস্তে গেছে বলে মনে হয়।' তিনি আরো বলেন, তাঁর জানা মতে সরকারের শেষ সময়ে অবহেলিত জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব কমানোই ছিল এবারের মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজন মনে করেছেন বলে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করেছেন। এর বাইরে আর কোনো কারণ আছে বলে তিনি মনে করেন না।
গত জাতীয় নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মন্ত্রিসভা গঠনের সময় প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতাদের বাদ দিয়ে অনেক নতুন মুখ দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা। তখন মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টির গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এবং সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়াকে (টেকনোক্র্যাট) শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। শরিকদের আর কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। তাই মহাজোটের শরিকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। মন্ত্রিসভার দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। অনেকেই মনে করেন, সরকারের অনভিজ্ঞ মন্ত্রীরা বিরোধী দলের নানা অভিযোগের জবাবও দিতে পারছিলেন না। আবার কোনো কোনো মন্ত্রীর অতিকথনে সরকার বিব্রত অবস্থায় পড়ে। তাঁদের উল্টাপাল্টা কথা বিরোধী দলকে সমালোচনা করার সুযোগ করে দিচ্ছিল।
অন্যদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সরকার নানামুখী চাপের মধ্যে পড়েছে। এসব সংকট থেকে উত্তরণের জন্যই মন্ত্রীদের দপ্তর পুনর্বণ্টন হচ্ছে- পরোক্ষভাবে জনগণকে এমন ধারণা দেওয়াটাই মন্ত্রিসভায় রদবদলের উদ্দেশ্য বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। তাই জ্যেষ্ঠ ও দক্ষদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
জানা গেছে, মহাজোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনা এবং তাদের আচরণে জোটের শরিকরা ক্ষুব্ধ। মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন মহাজোট ছাড়ার। তিনি এমনও বলেছেন, মহাজোট সরকারে তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই। জি এম কাদেরের ওপর প্রচণ্ড চাপ রয়েছে মন্ত্রিত্ব ছাড়ার।
এদিকে ১১ দল কিছু জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে। এ লক্ষ্যে তারা কয়েকটি বৈঠকও করেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ১১ দলের বাইরে থাকা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। মহাজোটের শরিক কোনো দল যাতে সরকার থেকে বের হয়ে না যায়, সে জন্যই জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে শেষ বেলায় মন্ত্রী করা হয়েছে। তবে একই ধরনের প্রস্তাবে সাড়া দেননি মহাজোটের আরেক নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
পরপর তিন দফা মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করা হলেও তাতে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল জলিলের মতো প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতাদের ঠাঁই হয়নি। বরং তাঁদের সভাপতিমণ্ডলী থেকে বাদ দিয়ে উপদেষ্টা করে অনেকটা নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। সরকারের শেষ বেলায় এসে নানা সংকটে পড়ে এখন তাঁদের কাছে টানার চেষ্টায় তাই পুরোপুরি সাড়া মেলেনি। শুধু তা-ই নয়, তোফায়েল আহমেদ ছাড়াও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তাঁরাও প্রস্তাব নাকচ করে দেন বলে দলীয় সূত্র জানায়।

No comments

Powered by Blogger.