আদিবাসী বনাম উপজাতি বিতর্ক by ড. মিল্টন বিশ্বাস

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে বর্ণিত দেশের 'উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্র্রদায়'-এর জন্য সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য কোটা সুবিধা রয়েছে। এসব সুবিধাভোগী সম্প্র্রতি 'আদিবাসী ফোরাম' নামের সংগঠন থেকে ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস


পালনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে। পক্ষান্তরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসী শব্দটি না থাকায় বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের কাছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে বিশ্ব আদিবাসী দিবস উদ্‌যাপনে সরকারের কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত না হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের 'উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্র্রদায়' শব্দগুলোর পরিবর্তে আদিবাসী ফোরামের দাবি এখানে 'আদিবাসী জাতিসমূহ' সংযুক্ত করা হোক। বর্তমান সরকার ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা নানা বক্তব্য ও মন্তব্যে অসহযোগিতার মনোভাব প্রকাশ করে আসছেন।
'আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র ২০০৭' অনুসারে তাদের ৪৬টি অধিকারের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি বা সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হয়নি। তা ছাড়া ঘোষণাপত্রের ওপর সব সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে সর্বসম্মত সমর্থন নেই। এ কারণে বাংলাদেশ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক ঘোষণাপত্রের ওপর ভোট গ্রহণের সময় তারা ভোটদানে বিরত ছিল। তবে যেকোনো অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর অধিকারের প্রতি সমর্থন রয়েছে সরকারের। সংবিধান অনুসারে সরকার প্রধান প্রধান মানবাধিকার চুক্তির প্রতি অনুগত এবং উপজাতিদের অধিকার সমর্থন করে আসছে। উল্লেখ্য, 'আদিবাসী' শব্দটি সংবিধানে সংযোজিত হলে ২০০৭ সালের 'আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র' মেনে নিতে হবে; যা হবে বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী। কারণ ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ-৪-এ আছে : 'আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার চর্চার বেলায়, তাদের অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন এবং স্বশাসিত সরকারের অধিকার রয়েছে ও তাদের স্বশাসনের কার্যাবলির জন্য অর্থায়নের পন্থা এবং উৎসের ক্ষেত্রেও অনুরূপ অধিকার রয়েছে।' অর্থাৎ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করলে ও পার্বত্য অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশ সরকার খাগড়াছড়ির গ্যাস উত্তোলন করে অন্য জেলায় আনতে পারত না। কারণ সেখানকার স্বশাসিত আদিবাসী শাসক নিজেদের অর্থায়নের উৎস হিসেবে সেই খনিজ, বনজ ও অন্যান্য সম্পদ নিজেদের বলে চিন্তা করত। আবার অনুচ্ছেদ-৩৬-এ আছে, 'আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর, বিশেষত যারা আন্তর্জাতিক সীমানা দ্বারা বিভক্ত হয়েছে, তাদের অন্য প্রান্তের নিজস্ব জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কার্যক্রমসহ যোগাযোগ সম্পর্ক ও সহযোগিতা বজায় রাখার ও উন্নয়নের অধিকার রয়েছে।' রাষ্ট্র এই অধিকার কার্যকরে সহযোগিতা প্রদান ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। ঘোষণাপত্রের এই নির্দেশ কোনো সরকারই মেনে নিতে পারবে না। কারণ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক কার্যক্রম অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে। তা ছাড়া বাংলাদেশে পার্বত্য অঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকায় জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে; যা ক্রমেই সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত করবে। জাতিসংঘের এই ঘোষণাপত্রের শেষ অনুচ্ছেদ-৪৬-এ সবার মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখানোর কথা বলা হয়েছে এবং এই কাজটি বর্তমান মহাজোট সরকার সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছে। এর আগে 'পার্বত্য শান্তিচুক্তি' অনুসারে ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সমতা, বৈষম্যহীনতা, সুশাসন এবং সরল বিশ্বাসের মূলনীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের একাধিক অনুচ্ছেদ অনুসারে আদিবাসীদের কোনো অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে বৈষম্য করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা, চাকরি ও অন্যান্য বিষয়ে বাঙালিদের মতো তাদেরও সমান সুযোগ দিতে বাধ্য থাকবে রাষ্ট্র। এর আরেক ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে, উপজাতিদের 'আদিবাসী' হিসেবে চিহ্নিত করলে কোটা সুবিধা বাতিল অনিবার্য হয়ে পড়বে। ফলে তাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। সে ক্ষেত্রে বাঙালি-উপজাতি সম্পর্কের মধ্যে বিরূপ ধারণা জন্ম নিতে পারে। মনে রাখা দরকার, এই ঘোষণাপত্রের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশে বিপুলসংখ্যক নৃতাত্তি্বক জাতিগোষ্ঠীর বসতি রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভোটদানে বিরত ছিল রাশিয়া, ভুটান, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, ইউক্রেন, কলম্বিয়াসহ প্রভৃতি দেশ। অনুপস্থিত ছিল আরো অনেক উন্নত দেশ। উল্লেখ্য, ভারতে বসবাসকারী একই সম্প্র্রদায়ভুক্ত উপজাতিদের সেখানকার সংবিধানে 'আদিবাসী' হিসেবে সম্বোধন করা হয়নি। বলা হয়েছে- Scheduled Caste and Scheduled Tribes। সংবিধানে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরামকে উপজাতি অধ্যুষিত রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯(১)(২), ৩০(১)(১এ), ৪৬, ২৪৪(১) ২৪৪এ(১), ৩৩২(১), ৩৩৫, পঞ্চম অধ্যায়, পার্ট বি, অনুচ্ছেদ-৪ এবং ষষ্ঠ অধ্যায়ের অনুচ্ছেদ-১-এর অংশগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তথা উপজাতিগুলোর উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে ১৯৭২ সালের ২২ জুন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) প্রণীত 'ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন, ১৯৫৭' (কনভেনশন নম্বর ১০৭)-এ অনুস্বাক্ষর করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নৃতাত্তি্বক জাতিগোষ্ঠী এবং ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়সহ তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার জন্য জাতিসংঘের এই সংস্থাটি আবার সংশোধিত 'ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন ১৯৮৯' (কনভেনশন নম্বর ১৬৯) গ্রহণ করে। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি দলিল জাতীয় পর্যায়ে উপজাতিদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয়। এখানে ট্রাইবাল বা সেমি-ট্রাইবাল বলতে ওই গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে, যারা তাদের ট্রাইবাল বৈশিষ্ট্য হারানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং এখনো জাতীয় জনসমষ্টির সঙ্গে একীভূত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পথে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সরকার পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ি অধিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
সংবিধানে 'আদিবাসী' শব্দটি না থাকায় দেশ-বিদেশে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। অবশ্য এ ধরনের অপতৎপরতার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় নিজে উস্কানি দিয়ে ২০০৪-০৫ সালের মধ্যে উপজাতি-বাঙালি বিরোধের সূচনা করেন। তাঁর বাবা ত্রিদিব রায় পশ্চিম পাকিস্তানের মন্ত্রী ছিলেন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ১৯৬৬ সালে কাপ্তাই বাঁধ তৈরি করার অনুমতি ও সহায়তা দেন পাকিস্তান সরকারকে। এর ফলে তাঁর নিজের রাজবাড়িই পানিতে তলিয়ে যায়। তাঁর ছেলে রাজা দেবাশীষ রায় 'আদিবাসী' ইস্যু নিয়ে প্রথম বিতর্কের সৃষ্টি করেন। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির খসড়া প্রণয়নকালে রাজা নিজে উপস্থিত থেকেও চুক্তিতে ব্যবহৃত 'উপজাতি' শব্দ সম্পর্কে আপত্তি জানাননি। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে এই রাজার ভূমিকা হয়ে ওঠে বিতর্কিত। ২০০৭-০৮ সালে তিনি বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় উপজাতিদের বিভিন্ন অযৌক্তিক দাবিদাওয়া পূরণে সচেষ্ট ছিলেন। চাকমা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এই ব্যক্তির ইন্ধনে বিদেশি গণমাধ্যমে দেশের উপজাতি সম্পর্কে সরকারের নেতিবাচক মনোভাব ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে; যা একেবারেই অসত্য।
২০১১ সালের ১২ এপ্রিল চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত অনুষ্ঠানে বান্দরবানের বর্ষীয়ান বোমাং রাজা অং শু প্রু চৌধুরী বলেছিলেন, We are neither Indigenous nor Tribal. তাঁর এ কথার পক্ষে তিনি যুক্তি দেখান। তারা এ দেশেরই জনগণ। পার্বত্য অঞ্চলে পুরো বাংলাদেশের জনগণের মাত্র ০.৫ শতাংশ উপজাতির বাস। এই উপজাতিরা দেশের এক-দশমাংশ ভূখণ্ডের অধিকারী। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়েছে। ভূমি কমিশন গঠন ও 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল ২০১০' জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্র্রদায়ের ধারণা সবাই মেনে নেবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় পার্বত্য এলাকা থেকে বাঙালিদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র হবে মর্মান্তিক। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সবার ঐকান্তিক ইচ্ছাই গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
email-writermiltonbiswas@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.