একবার খেলে কেউ ভোলে না রসিকজনের কাছে বেশ জনপ্রিয়- গাইবান্ধার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি রসমঞ্জরি by আবু জাফর সাবু

গাইবান্ধার সুস্বাদু এবং সর্বজনপ্রিয় মিষ্টি হচ্ছে রসমঞ্জরি। এ মিষ্টি সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে, একবার কেউ এ মিষ্টির স্বাদ আস্বাদন করলে এর রসময় তৃপ্তিদায়ক স্বাদে তাকে আকৃষ্ট হতেই হবে। রসমঞ্জরি শুধু তাই এতদঞ্চলেই নয়, প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ বিদেশেও যায় মানুষের রসনাতৃপ্তি মেটাতে।


এই মিষ্টির কাব্যিক নামের মধ্যেই রয়েছে তার ভিন্নতা। রসালো ঘন দুধের ক্ষীরের সঙ্গে খাঁটি ছানায় তৈরি মারবেল সদৃশ্য ছোট ছোট গোলাকার রসগোল্লা সমন্বয়ে তৈরি হয় এই মিষ্টি। মুকুল থেকে সদ্য বেরুনো আমের গুটির মতো রসগোল্লা দুধের ঘন ক্ষিরে মঞ্জরিত হয়ে দুটি ভিন্ন স্বাদের সমন্বয়ে সৃষ্টি করে তৃতীয় মাত্রার অপূর্ব স্বাদ। তাই এই মিষ্টির নাম (রস+মঞ্জরি) রসমঞ্জরি। এই মিষ্টি তৈরির উপকরণে থাকে শুধু খাঁটি গরুর দুধ, চিনি, দুধের ছানা এবং মশলার মধ্যে ছোট এলাচ। তৈরির পদ্ধতি এমন কিছু কঠিন নয়। শুধু গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন ক্ষীর করতে হবে এবং তাতে মেশাতে হবে পরিমাণ মতো এলাচ, সামান্য পরিমাণ উন্নতমানের ময়দা ও পরিমাণ মতো চিনি। এছাড়া ছানা দিয়ে ছোট গোলাকার গুটি তৈরি করে চিনির সিরায় জ্বাল দিতে হবে। বাদামী রং হলে ছাকনি দিয়ে সিরা ঝরিয়ে রসগোল্লার গুটিগুলো ক্ষীরে মেশানো হয়। পরে ঠান্ডা করে ক্ষীর গুটিগুলোসহ রসমঞ্জরি প্লেটে পরিবেশিত হয়।
কোন্ কারিগর প্রথমে এ মিষ্টি তৈরি করেছে বা ঠিক কত দিন আগে এই মিষ্টির প্রচলন হয়েছিল তা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে গাইবান্ধা জেলা শহরের সার্কুলার রোডের রমেশ ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারের রমেশচন্দ্র ঘোষ পঞ্চাশের দশকে রসমঞ্জরিকে শুধু নিজ জেলাতেই নয় বরং গোটা দেশের মিষ্টিপ্রিয় রসিকজনদের কাছে পরিচিত এবং সুপ্রিয় করে তোলেন। তারপর আর থেমে নেই এই মিষ্টির বিস্তার। এগিয়েছে সম্মুখে মিষ্টিপ্রিয়দের মন জয় করে। এ কথা সত্য যে রসমঞ্জরির আদি সেই স্বাদের যথেষ্ট ঘাটতি এখানকার মিষ্টিতে রয়েছে।
জেলা শহরের গাইবান্ধা মিষ্টান্ন ভান্ডার, রমেশ ঘোষ মিষ্টির দোকান, পুষ্প মিষ্টান্ন ভান্ডার, জলযোগ মিষ্টান্ন ভান্ডার, সন্তোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার, কালিবাবুর মিষ্টির দোকান, দেব মিষ্টান্ন ভান্ডার এবং পলাশবাড়ি উপজেলা সদরের শিল্পী হোটেল এ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ও গোবিন্দগঞ্জের মায়ামনি ও বনফুল হোটেল এ্যান্ড রেস্টুরেন্টে ভালমানের রসমঞ্জরি পাওয়া যায়।
প্রতিকেজি রসমঞ্জরি ২শ’ ৫০ টাকা এবং প্রতিপ্লেট ৫০ টাকা ও হাফপ্লেট ২৫ টাকা দরে বেচাকেনা চলে। বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য এমনকি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠানোর ক্ষেত্রেও নিজস্ব গোলাকার প্লাস্টিক পাত্রে টেপ দিয়ে এয়ারটাইট প্যাকিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে উন্নতমানের মিষ্টির দোকানগুলোতে।
মিষ্টি ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, প্রতিকেজি রসমঞ্জরির গড় উৎপাদনব্যয় পড়ে প্রায় ২শ’ ২৫ টাকা থেকে ২শ’ ৩০ টাকা। তবে দুধ, চিনি, ময়দা, এলাচ এবং জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিসহ কারিগরের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় এই মিষ্টি তৈরিতে লাভের পরিমাণ সীমিত হয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে গাইবান্ধা মিষ্টান্ন ভান্ডারের রাশেদ আহমেদ, পুষ্প মিষ্টি ভান্ডারের শরিফুল ইসলাম মিন্টু ও সন্তোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারের সন্তোষ সাহা জানালেন, খাঁটি দুধ প্রাপ্তি এবং কারিগরের দক্ষতার ওপরই নির্ভর করে রসমঞ্জরির গুণ, মান ও স্বাদ। এ জেলায় উন্নতমানের এবং চাহিদা মোতাবেক দুধ সরবরাহে সক্ষম বড় গরুর খামার গড়ে না ওঠায় এ মিষ্টির উৎপাদন ও মান বিঘিœত হচ্ছে। এছাড়া ভাল এবং দক্ষ মিষ্টির কারিগরের অভাবও বিখ্যাত এই মিষ্টির স্বাদে ব্যত্যয় ঘটায় বহুলাংশে। তবে অধিক লাভের প্রত্যাশা ছানা ও ক্ষীরে বেশি পরিমাণ আটা, সুজি ও অন্যান্য ভেজাল মিশিয়ে গ্রামগঞ্জে অনেক মিষ্টির দোকানে নিম্নমানের রসমঞ্জরিও আজকাল তৈরি হচ্ছে। যাতে এ জেলার ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টির সুনাম বিঘিœত হচ্ছে বলেও তাঁরা উল্লেখ করেন।

No comments

Powered by Blogger.