দেশহীন মানুষের কথা- রাষ্ট্র বনাম আদিবাসীদের সুখ-দুঃখ by সঞ্জীব দ্রং

সম্প্রতি আমি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের সেক্রেটারিয়েটে চিঠি লিখেছিলাম। খুব দ্রুত উত্তর এল। চিঠির উত্তর দিয়েছেন জাতিসংঘের সামাজিক নীতি ও উন্নয়ন বিভাগের মিস নিলা বারনার্ডি। আমি জানতে চেয়েছিলাম, এ বছর আদিবাসী দিবসের মূল সুর কবে ঠিক করা হবে এবং আমরা কত তাড়াতাড়ি সেটি পেতে


পারি। উত্তর এল: এবার আদিবাসী দিবসের মূল সুর ‘ইনডিজিনাস মিডিয়া: এম্পাওয়ারিং ইনডিজিনাস ভয়েস।’
মিস বারনার্ডি জানিয়েছেন, জাতিসংঘ ৯ আগস্ট বহুপক্ষীয় সংলাপের আয়োজন করবে, যার মূল ভিত্তি হবে—এক. মিডিয়ার মাধ্যমে আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণ এবং জ্ঞানের বিকাশ; দুই. আদিবাসী ইস্যুতে এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে মিডিয়ার ভূমিকা শক্তিশালী করা, জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রে যেসব অধিকার দেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে জনসাধারণকে সজাগ করা এবং আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের স্বীকৃতি, রাজনৈতিক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের স্বাধীন, মুক্ত ও পূর্বাবহিত সম্মতি গ্রহণ নিশ্চিত করা; তিন. সরকার ও আদিবাসীদের মধ্যে সংলাপ এবং মতবিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টির জন্য মিডিয়ার ভূমিকা রাখা, যাতে জাতীয় জীবনে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বোঝাপড়া বৃদ্ধি পায় এবং আন্তসাংস্কৃতিক শিক্ষা উৎসাহিত হয়; চার. আদিবাসী নেটওয়ার্ক ও সংগঠনগুলো যেন নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারে, সফলতার উদাহরণ তুলে ধরতে পারে এবং নিজেদের দর্শন ও শিখন নিয়ে সহযোগিতা করতে পারে বিশ্বের আদিবাসী জনগণের সঙ্গে। মিডিয়ার বলিষ্ঠ ভূমিকা আশা করা হচ্ছে এবার আদিবাসী দিবসে।
জাতিসংঘকে আমার চিঠি লেখার কারণ, সম্প্রতি আদিবাসী দিবস নিয়ে রাষ্ট্র থেকে একটি বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা। অতীতে কোনো সরকার আদিবাসীদের সঙ্গে এমন অদ্ভুত আচরণ করেনি। গত মার্চ মাসে সরকার একটি চিঠি পাঠায় বিভিন্ন জেলায়, যার কারণে আদিবাসীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফোন করে জানতে চেয়েছে, এবার আদিবাসী দিবস পালিত হবে কি না। জাতিসংঘ সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে এ দিবস উদ্যাপনে আহ্বান জানিয়েছে। অন্যান্য বছরের মতো এবারও এই দিবসের মূল সুর ঠিক করা হয়েছে। আমাদের দেশে মিডিয়ার ভূমিকা আরও উজ্জ্বলতর হওয়া দরকার আদিবাসী ইস্যুতে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আদিবাসীরা এগিয়ে যাচ্ছে। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস একজন আদিবাসী। ভারতের লোকসভার স্পিকার ছিলেন একজন গারো। নেপালের স্পিকার ছিলেন লিমবু আদিবাসী। আমাদের ওয়াসফিয়া নাজরীন ও নিশাত মজুমদার এভারেস্ট জয় করলেন। সেই এডমন্ড হিলারির সময় থেকে তেনজিং ও শেরপা আদিবাসীরা এর পথপ্রদর্শক। শেরপা হলো নেপালের একটি আদিবাসীদের গোত্রের নাম। লাকি শেরপা নামের এক পাহাড়ি নেত্রীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল কানাডার অটোয়ায়।
জাতিসংঘ তথ্য বিবরণী বের করে আদিবাসীবিষয়ক অধিবেশনের সময়। আমি এর অনেক সভায় যোগ দিয়েছি। অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা সেখানে আদিবাসীদের দুঃখ-কষ্ট, বঞ্চনা মেনে নিয়ে তাঁদের দেশে আদিবাসীদের উন্নয়নে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার বর্ণনা দেন। ইতিবাচক ও গভীর সে কথাগুলো শুনে মন ভরে যায়। আর নিউইয়র্কে আমাদের দূতাবাসের প্রতিনিধি আদিবাসীবিষয়ক অধিবেশনে বসে বলে দেন, ‘বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই।’ অধিবেশনকক্ষে বসা সহস্র মানুষ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন তখন। আর কোনো দেশের প্রতিনিধি এ রকম কথা এই অধিবেশনে বলেন না। আমি নয় বছর অংশ নিয়েছি এই অধিবেশনে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছাড়া অন্য কোনো দেশের প্রতিনিধি এমন কথা বলেননি। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল অথবা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া কেউ এমন কথা বলেনি। এমন অভাগা দেশ আমাদের। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘নিজেরে করিতে গৌরব দান, নিজেরে কেবলি করি অপমান।’
আমি যখন জানলাম, বেলিজের প্রধান বিচারপতি সরকারকে বলে দিয়েছেন মায়া আদিবাসীদের কাছ থেকে যেসব ভূমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে তা ফেরত দিতে, মন ভরে গেছে। আদালত বলেছেন, আদিবাসীদের প্রথা, রীতিনীতি ও ভূমি মালিকানার সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করেই রাষ্ট্রকে এসব ভূমি, এলাকা ও সম্পদের আইনগত স্বীকৃতি দিতে হবে। মানবাধিকার আন্ত-আমেরিকান আদালত রুলিং দিয়েছেন, সুরিনামের সারামাকা জনগণের বনজ সম্পদ আহরণ, নিজেদের উন্নয়ন অগ্রাধিকার ও কৌশল নির্ধারণ এবং ভূমি ব্যবহারের অধিকার রয়েছে।
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়া সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ভুলের জন্য আদিবাসী পরিবার ও জনগণের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে। এপ্রিল মাসে কানাডা সরকার ও পার্লামেন্ট আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র পূর্ণ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী ৮০ হাজার আদিবাসী ছাত্রছাত্রী ও তাদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন আদিবাসী সন্তানদের পরিবার থেকে জোরপূর্বক বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্য। জাপান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আইনু জনগণকে ‘জাপানের উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাপানের পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আইনুদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি এবং জাপান নৃতাত্ত্বিকভাবে সমশ্রেণীভুক্ত বা একই জাতির দেশ নয়। বলিভিয়ায় সংবিধান সংশোধনের পক্ষে গণভোট হয়েছে, যেখানে আদিবাসীদের অধিকতর ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। নতুন সংবিধান কংগ্রেসে এবং সাংবিধানিক আদালতে আদিবাসী গোষ্ঠীকে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও স্বশাসন দিয়েছে, যেখানে তাদের প্রথাগত কমিউনিটি বিচারব্যবস্থার স্বীকৃতি রয়েছে। আমেরিকা রিকভারি অ্যান্ড রি-ইনভেস্টমেন্ট অ্যাক্ট নামে একটি বিলের মাধ্যমে স্থানীয় আদিবাসীদের আবাসনের জন্য ৫১০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। একই সময়ে হন্ডুরাস সরকার আদিবাসীদের শিক্ষার জন্য ১৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। নামিবিয়া সরকার আদিবাসী নারীর কল্যাণসহ শিক্ষা, কর্মসংস্থান, মৎস্য চাষ প্রভৃতি খাতে অর্থ অনুমোদন করেছে। ফিলিপাইন, নেপাল, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ আদিবাসীদের উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে।
আর আমাদের দেশে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার পরও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন বহু দূরের স্বপ্ন রয়ে গেছে। সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠনের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীবিষয়ক মন্ত্রী জেনি ম্যাকলিন আদিবাসীদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘এই ঐতিহাসিক দিনটির জন্য বহু বছর ধরে অপেক্ষা করছিলেন আদিবাসীরা। আমি প্রথমে আশা করি, এই ক্ষমাপ্রার্থনা আদিবাসীদের কষ্টকে লাঘব করবে এবং দ্বিতীয়ত, আদিবাসীদের সামনের দিকে অগ্রসর করতে সহায়তা করবে এবং সম্মিলিতভাবে অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীরা অতীতে যে দুঃখ-কষ্ট সয়েছে এবং এখনো করছে, তা থেকে উত্তরণের উপায় বের করবে। আজ আমরা আজকের এই ঐক্যকে কাজে লাগাতে চাই এবং বহু অস্ট্রেলিয়ান যেটি চাচ্ছেন, একত্রে সম্মুখে পথচলার জন্য।’
ক্ষমাপ্রার্থনার সময় ৩৪৪ শব্দসংবলিত ভাষণে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আজ আমরা এই ভূমির আদিবাসীদের শ্রদ্ধা জানাই, যারা মানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন সংস্কৃতির ধারক। আমরা আমাদের অতীতের ভুল আচরণের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। এখন জাতির জন্য সময় এসেছে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের নতুন পাতা খোলার, যেখানে অতীতের ভুলগুলো শুধরে নেওয়া হবে এবং সবাইকে আস্থায় নিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ রচিত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে তিনবার ‘সরি’ বলেছেন এবং অতীত সরকারগুলোর ভুল নীতি ও আইনের কারণে দুঃখ, যাতনা ও আঘাতপ্রাপ্ত আদিবাসী শিশু, তাদের মা-বাবা, ভাইবোন ও পরিবারের অন্যদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি আদিবাসীদের গর্বিত সংস্কৃতির গর্বিত মানুষ উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আপনাদের প্রতি অমর্যাদাকর এবং অপমানজনক আচরণ করা হয়েছে, এ জন্য আমরা দুঃখিত।’
আমি ভিনদেশের মানুষের উদাহরণ দিলাম। আদিবাসী দিবস পালনে নিরুৎসাহিত করে সরকার একটি চিঠি বিতরণ করছে, এ কথা জানার পর এই তো কিছুদিন আগে সরকারের অন্যতম শীর্ষ পর্যায়ের একজন আমাকে বলেছেন, ‘এই রকম চিঠি সরকার লেখে? লিখতে পারে?’ তাঁর মন খুব খারাপ আমার সামনে। আমি অবাক বিস্ময়ে এই বয়োবৃদ্ধ মানুষটির দিকে তাকাই। তাঁর চোখ কি ছলছল আদিবাসী মানুষের কষ্টে? আমি শুধু তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, এমন মানুষও তো আছেন সরকারের সঙ্গে। বাইরের দৃষ্টিতে হয়তো ক্ষমতার আসনে, আর ভেতরে ভেতরে কত অসহায়। পত্রিকায় দেখলাম, এই সরকারের দুজন মন্ত্রী আদিবাসী-সংক্রান্ত সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। বিরোধিতা করেছেন শিক্ষা ও টেলিযোগাযোগ-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যানও।
এই মানুষদের নিয়েই তো আমরা সম্মুখে এগিয়ে যেতে চাই। বুকে অনেক যন্ত্রণা নিয়েও বলতে চাই, আদিবাসী দিবসে সবার আমন্ত্রণ।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.