ধর্ম- রোজাদারের মর্যাদা সবার ওপরে by আবদুস সবুর খান

ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে রোজা তৃতীয়। তবে গুরুত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে রোজাদারের অবস্থান সবার ওপরে। ইমাম গাজ্জালি যথার্থই বলেছেন, ‘সব এবাদতই আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের জন্য, তবুও মার্যাদার উচ্চতায় রোজা পবিত্র কাবাগৃহের ন্যায় প্রাধান্য রাখে, যদিও সমস্ত ভূপৃষ্ঠই আল্লাহ্ তাআলার সৃষ্টি।’


রোজাদারের এই বরকতময় প্রাধান্য দুটি কারণে। প্রথমত, রোজার মাধ্যমে রোজাদার কয়েকটি বিষয় থেকে নিজেকে বিরত রাখেন এবং কয়েকটি বিষয় বর্জন করেন। এটি ব্যক্তির সম্পূর্ণরূপে অভ্যন্তরীণ বিষয়। এতে এমন কোনো আমল নেই, যা দৃষ্টিগোচর হয়। অর্থাৎ, এতে লোক দেখানোর মতো কিছু নেই। রোজাদার যদি লোকচক্ষুর আড়ালে এসব বর্জিত জিনিস ভোগ করে কেউ দেখবে না। অথচ রোজাদার তা করেন না। ব্যক্তির নিজেকে সংযত রেখে নিজের রিপু দমন করে পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠার এই কষ্টসাধ্য প্রয়াস একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না।
দ্বিতীয়ত, রোজা আল্লাহ্র দুশমনের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। কারণ, কামনা-বাসনা হচ্ছে শয়তানের হাতিয়ার—যার মাধ্যমে মানুষকে সে পাপাচারে লিপ্ত হতে প্রলুব্ধ করে। আর পানাহারের মাধ্যমে এসব রিপু শক্তিশালী হয়। রোজাদার দিনের বেলায় পানাহার বর্জন করার মাধ্যমে কামনা-বাসনাকে সংযত করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে তোলে।
রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘শয়তান মানুষের রক্ত চলার পথে বিচরণ করে। সুতরাং ক্ষুধা, তৃষ্ণা দ্বারা তার পথসমূহকে সংকীর্ণ করে দাও।’ এদিকে লক্ষ্য রেখেই তিনি হজরত আয়েশা (রা.)-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সর্বদা জান্নাতের দরজায় কড়া নাড়ো।’ হজরত আয়েশা (রা.) আরজ করলেন, ‘কীসের মাধ্যমে?’ হুজুর (সা.) বললেন, ‘ক্ষুধার মাধ্যমে।’
এ কারণেই তিনি এরশাদ করেছেন, ‘সওমের কৃচ্ছ্র সাধন আল্লাহ্র ইবাদতের তোরণ।’
রোজাদারের নিদ্রা এবাদতের সমতুল্য, তাঁর চুপ থাকা তসবিহ পাঠের সমতুল্য। সে সামান্য এবাদতে অন্য সময় অপেক্ষা অধিকতর সওয়াবের অধিকারী হয়। ইমান ও এহতেসাবের সঙ্গে যে ব্যক্তি রোজা রাখেন, তাঁর অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। রোজাদারের মর্যাদা প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘আমি সেই মহান আল্লাহ্র কসম করে বলছি, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, নিশ্চয়ই জেনে রাখো। আল্লাহ্র নিকট রোজাদারে মুখের দুর্গন্ধ মেশক বা কস্তুরি অপেক্ষা অধিকতর সুগন্ধি বলে বিবেচিত।’ (বুখারি)
হাদিসে কুদসিতে রোজাদারের মর্যাদা সম্পর্কে স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন, ‘মানুষ যত প্রকার নেক কাজ করে, আমি তার সওয়াব দশ গুণ থেকে সাত শ গুণ বৃদ্ধি করে দেই। কিন্তু রোজা এই নিয়মের বাইরে। রোজার সওয়াব একই নিয়মে সীমাবদ্ধ বা সীমিত নয়। রোজার সওয়াবের পুরস্কার স্বয়ং আমি প্রদান করব।’ (বুখারি)
বেহেশতেও রোজাদারদের পৃথক মর্যাদার ব্যবস্থা থাকবে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘রোজাদাররা রাইয়ান দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে এবং আল্লাহ্র সাক্ষাৎ লাভের আশীর্বাদে পুরস্কৃত হবে।’(বুখারি)
প্রকৃতপক্ষে রমজান মাসে আমরা সবাই আল্লাহ্র মেহমান এবং তিনি স্বয়ং আমাদের মেজবান। এ মাসে তিনি তাঁর রহমত বা করুণার চাদরে এই পৃথিবীকে ঢেকে দেন। সর্বত্রই সর্বদা তাঁর করুণা বর্ষিত হতে থাকে। বিশেষ করে রাতের শেষভাগে তিনি তাঁর এই করুণার ডালা নিয়ে প্রথম আসমানে নেমে এসে তাঁর বান্দাদেরকে আহ্বান করতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে তিনি বলেন, হজরত রাসুলপাক (সা.) বলেছেন ‘আমাদের প্রভু প্রতিপালক যিনি সব কল্যাণের মালিক এবং সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী, তিনি প্রতি রাতে এমন সময় পৃথিবীর নিকটতম আকাশে নেমে আসেন, যখন রাতের এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকে। আর বলেন, “কে আমাকে ডাকে যেন আমি তার ডাকে সাড়া দেই, কে আমার কাছে প্রার্থনা করে যেন আমি তাকে দান করি এবং কে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে যেন আমি তাকে ক্ষমা করে দেই”।’ (বুখারি)
পবিত্র মাহে রমজানে রোজাদার বান্দার জন্য মহান রাব্বুল আলামিন এই যে এত মর্যাদা ও করুণার আয়োজন করে রেখেছেন আমাদের, তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। এই সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার করা উচিত। রোজাদারদের সম্মানেই আমাদের সবারই রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করা কর্তব্য। সবারই খেয়াল রাখা উচিত, আমার জন্য যাতে কোনো রোজাদারের ক্ষতি না হয়। মাহে রমজান ও রোজাদারের জন্য ক্ষতিকর—এমন সব কিছুই বন্ধ রাখা উচিত। অশ্লীল কথাবার্তা, শব্দদূষণ, রাস্তাঘাটে অহেতুক গাড়ির হর্ন বাজানো ইত্যাদি থেকে নিজেকে পবিত্র রেখে আল্লাহ্র মেহমান রোজাদারদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন আমাদের প্রত্যেকেরই নৈতিক দায়িত্ব।
পবিত্র মাহে রমজানে আমরাও যেন মহান আল্লাহ্র এই করুণাধারায় সিক্ত হয়ে আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি ও আত্তোন্নয়নের সাধনায় উত্তীর্ণ হয়ে মাকারিমুল আখলাক বা সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হতে পারি, এটাই হোক আমাদের একমাত্র প্রার্থনা।
ড. আবদুস সবুর খান: সহযোগী অধ্যাপক ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.