শ্রদ্ধাঞ্জলি- অগ্রসর অগ্রজ বুলু খালা by দিল মনোয়ারা মনু

১৩ জুলাই সন্ধ্যা সাতটা। ষাট দশকের সুপরিচিত সংগঠন ‘সৃজনী’র উদ্যোগে, তাদের একনিষ্ঠ সদস্য আখতার হুসেনের সম্প্রতি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়া উপলক্ষে অভিনন্দন জানানোর জন্য এক ঘরোয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে আমরা যখন নিবিষ্ট মনে একে একে সৃজনীর সদস্যদের হূদয়ঘন স্মৃতিচারণ শুনছি, ঠিক সেই মুহূর্তেই


কঠিন দুঃসংবাদটি এল। রংপুরের আমাদের সবার প্রিয় বুলু খালা আর নেই। বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম। যদিও জানতাম তিনি দীর্ঘদিন থেকেই অসুস্থ, তবুও তাঁর এই চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। তাঁর ৯০ বছরের দীর্ঘজীবনে তিনি সমাজ ও মানুষের কাজে নিজেকে নিবেদিত রেখেছিলেন পরম সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে।
বুরু খালা অসহায়, নিগৃহী মানুষের জন্য কাজ করেছেন দশ হাতে। ক্লান্তি নেই, শ্রান্তি নেই, অন্যায়ের সঙ্গে আপস নেই, নেই কঠিন সংগ্রামময় উত্তাল পথচলায় এতটুকু শৈথিল্য, দ্বিধা বা সংকোচ। সেই আপসহীন প্রতিবাদী মানুষটিই বেশ কিছুদিন থেকে অসহায়, নিঃসঙ্গ, অসুস্থ, ক্লান্ত দেহটি টেনে বেড়িয়ে জীবনের সঙ্গে কঠিন যুদ্ধ শেষে অতঃপর মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন।
মনে পড়ছে একে একে অনেক মুহূর্ত, টুকরো টুকরো স্মৃতি। বুলু খালার সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় ১২ বছরের। রংপুরের পায়রাবন্দে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘নিজেরা করি’র ভূমিহীন নারীদের বিশাল সমাবেশে। পরপর বেশ কয়েক বছর এই সমাবেশে আমি বুলু খালাকে দেখেছি খুব কাছে থেকে, জেনেছি খুব ঘনিষ্ঠভাবে। বুলু খালা একজন প্রথা ভাঙা মানুষ। বৈরী সমাজের সব প্রতিকূলতা ভেঙে নিজে এগিয়েছেন, সেই সময়ের সমাজের নারীদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য সংগ্রাম করেছেন।
বুলু খালার আন্তরিকতা, সরলতা অন্যদিকে চরিত্রের দৃঢ়তা, আপসহীনতা আমাকে মুগ্ধ এবং বিস্মিত করেছে। তাঁর কর্মজীবনের এই আলোকিত দিকটি প্রণোদনা, শক্তি জুগিয়েছে আমাকে। তিনি বিশ্বাস করতেন সবার মধ্যেই কোনো-না কোনো প্রতিভা আছে, যা বিকাশের অপেক্ষায় থাকে। শুধু প্রথাগত শিক্ষাই মানুষকে শিক্ষিত করে না, তাই তিনি সারা জীবন জোর দিয়েছেন নারীসমাজকে অধিকার সচেতন ও প্রতিবাদী করার ক্ষেত্রে।
মনে পড়ছে ১৯৯৯ সালের ৯ ডিসেম্বরের কথা। রংপুরের পায়রাবন্দ। এলাকার ভূমিহীন নারীরা সমাবেশে আসছেন দূর-দূরান্ত থেকে, ফসলের জমির আইল ধরে সারিবদ্ধভাবে। ভোরের আলো তখন মাত্র ফুটেছে। সূর্যের লাল আলোর ছটা এসব সংগ্রামী মানুষের নানা বর্ণের পোশাকে এবং চোখে-মুখে যা এক অপূর্ব দ্যোতনা, ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে চলেছে। আর এ সমাবেশে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাদা ব্লাউজ, সাদা কাপড় পরা ছোটখাটো অথচ দৃঢ় এক সাহসী নারী, আমাদের সবার প্রিয় বুলু খালা। তাঁরই সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হতো প্রতিবছর এই প্রতিবাদী সমাবেশ। ঢাকা থেকে আইন, মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংগঠক, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণী-পেশার বিখ্যাত মানুষেরা উপস্থিত থাকতেন সেই সমাবেশে। বুলু খালার বলিষ্ঠ সভাপতিত্বে এবং সাহসী বক্তব্যে তাঁরাও উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত হতেন। শুধু বুলু খালাই নয়, এই অঞ্চলের ভূমিহীন নারীদের সাহস, কর্ম-উদ্যোগ ঢাকা থেকে যাওয়া বিশিষ্টজনের চরিত্রের নানা সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে তুলতে এ এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রাখত, তাঁদের সহজ স্বীকারোক্তি আমাদের সেই সময় মুগ্ধ করেছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সবচেয়ে অবহেলিত অথচ সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে দায়িত্বটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন—তা হচ্ছে, ভারতের কোচবিহারের নর্থ জোনের সিতাই বন্দরের বাংলাদেশি শরণার্থী শিবিরের স্যানিটেশনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব। যুদ্ধ-পরবর্তী দেশে ফিরে নতুন উদ্যমে নিজেকে বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত করেন। তিনি এ সময়ে মনভাঙা নারীদের মধ্যে নৈতিকতা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধের বীজটি নিজ হাতে বপনের চেষ্টা করেছেন। যুক্ত হয়েছেন বীরাঙ্গনা পুনর্বাসন কেন্দ্রের সঙ্গে। তিনি কেন্দ্রের সম্পাদক হিসেবে অসামান্য অবদান রেখেছেন, এঁদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং মানসিকভাবে সুস্থ ও নির্ভয় রাখতে।
শিক্ষক ফজিলাতুন নেসা বুলু আজীবন এই বোধটি তৈরি করতে চেয়েছেন তাঁর সব ছাত্রছাত্রীর মধ্যে। তিনি শিক্ষার পাশাপাশি সুধিবাবঞ্চিত নারীদের জন্য ১৯৬২ সালে গড়ে তুলেছিলেন ‘মহিলা কুটির শিল্প’ এবং ১৯৭৮ সালে গড়ে তোলেন ‘ছিন্নমূল নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র’। এই দুটো সংগঠনের মাধ্যমে তিনি স্থানীয় নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন।
মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বুলু খালা প্রায়ই অসুস্থ থাকা অবস্থায়ও কম খরচ অথচ দারুণভাবে পরিবেশবান্ধব একটি চুলা আবিষ্কার করে তা বহু ঘরে ও প্রতিষ্ঠানে স্বল্পমূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। রংপুরের ঘরে ঘরে এই চুলা আজো ভীষণ জনপ্রিয়। তিনি এই চুলার নামকরণ করেছেন ‘সেবা চুলা’। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ তাঁর কাছে এ চুলা নিতে আসত। বুলু খালা আবার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বহুজনকে হাতে-কলমে এই চুলা তৈরির পদ্ধতি শিখিয়েছেন। শেষ জীবনেও তিনি আন্তরিকতা ও ভালোবাসা নিয়ে এ কাজটি নিরলসভাবে করে গেছেন। ফজিলাতুন নেসা বুলু শুধু রোকেয়া দিবসের অনুষ্ঠান বা রোকেয়া আন্দোলনেই নয়, তিনি রংপুরের সব উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডে এবং সভা, সমাবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
প্রবল জনপ্রিয় ও জননন্দিত এ মানুষটিকে রংপুরবাসী তথা দেশবাসী তাই কখনো ভুলতে পারবে না। তিনি তাঁর সব গৌরব এবং মহিমা নিয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন—এই প্রত্যাশা আমাদের সবার।
দিল মনোয়ারা মনু

No comments

Powered by Blogger.