চ্যাম্পিয়নদের করুণ পরিণতি

অনেক চ্যাম্পিয়ন অলিম্পিয়ানেরই শেষ জীবনটা সুখকর হয়নি। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়েছেন কেউ কেউ, কারও কারও হয়েছে অস্বাভাবিক মৃত্যু ‘অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল...।’ রূপকথার নানান গল্পের সাধারণ সমাপ্তি এটা।


কিন্তু জীবন রূপকথা নয়। বাস্তব জীবনের নায়কদের জীবনের শেষটাও সব সময় সুখে-শান্তিতে কাটে না। কখনো কখনো তাদের মুখোমুখি হতে হয় নানা বিয়োগান্তক ঘটনার। চ্যাম্পিয়ন অলিম্পিয়ানদের অনেকেরই শেষটা সুখের হয়নি। কেউ ভুগেছেন কঠিন অসুখ-বিসুখে, কেউ যুঝেছেন দারিদ্র্যের সঙ্গে, কেউ বা বেঘোরে প্রাণ দিয়েছেন আততায়ীর হাতে, যুদ্ধও কেড়ে নিয়েছে কারও কারও জীবন।
জেসি ওয়েন্সের কথাই ধরা যাক। অলিম্পিক-নায়কদের একেবারে সংক্ষিপ্ততম তালিকা করলেও সেখানে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের এই কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাথলেটকে। ১৯৩৬ বার্লিন অলিম্পিকে হিটলারের নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে অ্যাথলেটিকসে চার-চারটি সোনার পদক জিতেছিলেন। ভুল প্রমাণ করেছিলেন নাজিদের আর্যশ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্বকে। কিন্তু ক্রীড়াঙ্গনে গৌরব তাঁর শেষ জীবনকে সুখী করতে পারেনি। জীবনধারণের প্রয়োজনে ঘোড়ার সঙ্গে দৌড়েছেন, পেট্রলপাম্পের কর্মী হিসেবেও কাজ করেছেন; করেছেন সেলাইয়ের কাজ। ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত ওয়েন্স ১৯৮০ সালে ৬৬ বছর বয়সে মারা যান চাপা একটা দুঃখ নিয়েই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯৩৬-এর বার্লিনই ছিল শেষ অলিম্পিক। ওই অলিম্পিকে অংশ নেওয়া প্রায় ২০ জনের মতো পোলিশ অলিম্পিয়ান নিহত হন যুদ্ধে। জার্মানিও হারিয়েছিল পদকজয়ী আনুমানিক ২৫ জনকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন লুটজ লং। বার্লিনে জেসি ওয়েন্স লংজাম্পে জিতেছিলেন লংয়ের পরামর্শ শুনেই। লংয়ের পরামর্শমতো রানআপ ঠিক না করলে হয়তো বাছাইপর্ব থেকেই বিদায় নিতে হতো ওয়েন্সকে। তাঁর পেছনে থেকে লংজাম্পের রুপা জেতা লং ১৯৪৩ সালে সিসিলিতে মিত্রবাহিনীর আক্রমণে প্রাণ হারান। তাঁর সম্পর্কে ওয়েন্সের একটা কথা বিখ্যাত হয়ে আছে। ওয়েন্স বলেছিলেন, ‘আমার সব পদক ও কাপ গলিয়ে ফেললেও তা লুটজ লংয়ের জন্য আমি যে ২৪ ক্যারট সোনার নিখাদ বন্ধুত্ব অনুভব করি, তার সমান হতে পারবে না।’
বার্লিন অলিম্পিকে ১৫০০ মিটার দৌড়ের চ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ডের জ্যাক লাভলককে গ্রাস করতে পারেনি মহাযুদ্ধ। পেশায় চিকিৎসক এই অলিম্পিয়ান পরে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। তবে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি তাঁর। ঘোড়ায় চড়তে গিয়ে এক দুর্ঘটনায় পড়েন লাভলক। সেটিরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ৪০তম জন্মদিনের আট দিন আগে জীবনাবসান ঘটে তাঁর।
১৯৪৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর নিউইয়র্কের পাতালরেলের এক স্টেশনে অসুস্থ হয়ে পড়েন লাভলক। মাথা ঝিমঝিম করছিল তাঁর। মাথা ঘুরে হঠাৎ পড়ে যান স্টেশনে আগুয়ান এক ট্রেনের সামনে।
পোলিশ-আমেরিকান স্টেলা ওয়ালশও বার্লিন থেকে ফিরেছিলেন তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে। মেয়েদের ১০০ মিটারে ফাইনালে যুক্তরাষ্ট্রের হেলেন স্টেফেনসের পেছনে থেকে দ্বিতীয় হন পোল্যান্ডের এই স্প্রিন্টার। তাঁর অনেক সমর্থক প্রশ্ন তুলেছিলেন স্টেফেনসের সামর্থ্য নিয়ে। বলেছিলেন, একজন নারী হয়ে এত জোরে দৌড়ানো অসম্ভব! শেষ পর্যন্ত তাঁদের কথা তাঁদেরই গিলতে হয়েছিল। ১৯৮০ সালে ক্লিভল্যান্ডে এক ব্যাংক ডাকাতির সামনে পড়ে ক্রসফায়ারে নিহত হন ৬৯ বছর বয়সী ওয়ালশ। ময়নাতদন্তে বেরোল, ওয়ালশ আদতে নারী নন, পুরুষ; যদিও তাঁর ক্রোমোজোমে পুরুষ ও নারী—দুটোরই অস্তিত্ব ছিল।
যাঁদের ঘিরে আবর্তিত হয়েছিল অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র চ্যারিয়টস অব ফায়ারের চিত্রনাট্য, সেই দুজনের একজন এরিক লিডেলও বাঁচেননি বেশি দিন। ১৯২৪ প্যারিস অলিম্পিকের ৪০০ মিটার দৌড়ের সোনাজয়ী এই স্কটিশ অ্যাথলেট মিশনারি হিসেবে কাজ করতেন চীনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান চীনকে দখল করে নিলে বন্দী হন লিডেল। জাপানি বন্দিশিবিরেই জীবনাবসান হয় তাঁর। ১৯৯১ সালের আগ পর্যন্ত অচিহ্নিতই ছিল তাঁর সমাধি।
১৯৫৬ মেলবোর্ন অলিম্পিকে ইরানকে ইতিহাসের প্রথম সোনা এনে দিয়েছিলেন কুস্তিগির গোলাম রেজা তখতি। কিন্তু সরকারবিরোধী বিশ্বাসই বিপদ ডেকে আনে তাঁর। রেজা শাহ পাহলভির আক্রোশের শিকার হন তখতি। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর। কাগজেকলমে তাঁর মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালানো হলেও অনেকের বিশ্বাস, তৎকালীন শাসকদের গুপ্ত পুলিশ সাভাকই তখতির মৃত্যুর জন্য দায়ী।
কাজাখস্তানের বক্সার বেকজাতার সাত্তারখানভ ফেদারওয়েটে সোনা জিতেছিলেন ২০০০ সিডনি অলিম্পিকে। মাস কয়েক পরই নববর্ষের প্রাক্কালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এই বক্সার। সাত্তারখানভের বাবা সেইলখানের বিশ্বাস, তাঁর ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে; আর এর পেছনে কাজ করেছে অলিম্পিক জিতে পাওয়া টাকাপয়সার ভাগ দিতে অস্বীকৃতি। সোনা জয়ের পর প্রায় এক লাখ ডলার বোনাস পেয়েছিলেন সাত্তারখানভ।
এএফপি অবলম্বনে
সোলায়মান পলাশ

No comments

Powered by Blogger.