বিশেষ সাক্ষাৎকার : ড. ইফতেখারুজ্জামান-পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি তদন্তে দুদক কি কাজ করতে পারছে

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মহসীন হাবিব কালের কণ্ঠ : আপনি বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংক মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলেছে।


বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের বা সরকারের যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, এর পরও আপনি মনে করেন যে তখন ঋণটা দেওয়া উচিত ছিল?
ইফতেখারুজ্জামান : আমি এখনো মনে করি বিশ্বব্যাংকের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নেওয়া উচিত হয়নি, আরো সুযোগ ছিল। বিশ্বব্যাংক যে যুক্তিগুলো দিয়েছে, আমাদের কারো কাছেই কিন্তু দুর্নীতি গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা, বিশেষ করে টিআইবির অবস্থান থেকে দেখতে চাই, যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হোক এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের যে অবস্থানের কারণে আমরা বলেছি যে মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলা হলো, আমরা এখন যে অবস্থান দেখছি তাতে বিশ্বব্যাংক সিদ্ধান্তটি না নিলেও পারত। যেমন- বিশ্বব্যাংক বলতে পারত, আমরা এখন যেহেতু নেগোশিয়েট করতে পারছি না, তাই দুই মাসের জন্য সাসপেন্ড করলাম। এর মধ্যে যদি আপনারা আমাদের শর্তগুলো মেনে না নেন, তাহলে আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি তুলে নেব। বিশ্বব্যাংক, বাংলাদেশ ও পদ্মা সেতু- এই ইকুয়েশন কিন্তু শেষ হয়নি। এটির এখন একটি নতুন পর্যায় শুরু হয়েছে। একদিক থেকে সরকারের ওপর বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ এসেছে যে যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তাঁদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা এবং প্রথমত দেশবাসীকে এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্ববাসীকে একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যে আমাদের দেশসহ সব দেশেই দুর্নীতি হয়; কিন্তু আমরা সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারি। আমি আগেও বলেছি, এখনো বলব, এটি সরকারের জন্য একটি অগি্নপরীক্ষা। কারণ এখনো কিন্তু গুণগত পরিবর্তন তেমন কিছু হয়নি। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তটিকে আমরা বিতর্কিত বলেছি। কারণ অভিযোগ এসেছে এবং তাদের ভাষায় গ্রহণযোগ্য অভিযোগ। এদিকে সরকার বলেছে গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের এ অবস্থানকেও আমরা কখনো সঠিক বলিনি। কিন্তু অভিযোগ আসা মানেই অভিযোগ প্রমাণ হওয়া নয়। সে সুযোগটা কিন্তু তাঁকে দিতে হবে। আইনের ভাষাও তাই বলে। সে পরিপ্রেক্ষিতে তারা অভিযোগটি প্রমাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত স্থগিত রাখতে পারত। তা না করে তারা বিষয়টি একটা অপমানজনক অবস্থানে নিয়ে গেছে। ফলে তারা বাংলাদেশের মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মুখোমুখি করেছে। কিছু মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগের কারণে, কিছু মানুষের ব্যর্থতার কারণে দেশবাসীকে উন্নয়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কিন্তু আমরা কেউ দিইনি। আমরাও কিন্তু বিশ্বব্যাংকের সদস্য রাষ্ট্র। এটা যেমন সঠিক, আবার অন্যভাবে যদি বিশ্লেষণ করি, কেন বিশ্বব্যাংক এটা করল- সেদিকটি যদি দেখা যায়। পৃথিবীর সব দেশেই, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে প্রায় ৬০ বছর ধরে উন্নয়ন সহায়তা দিয়ে আসছে। যেসব দেশকে বিশ্বব্যাংক উন্নয়ন সহায়তা দিয়ে থাকে, সেখানে দুর্নীতির কারণে ব্যাপক একটা অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এটা সর্বজনবিদিত এবং প্রমাণিত। এই যে ক্ষতিটা হয়, সে দায় নিতে হয় উন্নয়নশীল দেশগুলোকেই। ইতিমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা এবং বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাংক ফান্ডের প্রকল্পগুলো এই যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেটার জন্য বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব দায়ও রয়েছে। তাদের নিজস্ব ব্যর্থতাও রয়েছে, তাদের নিজস্ব ফিন্যান্সিয়াল কন্ট্রোল ব্যবস্থায় দুর্বলতা রয়েছে। প্রতিটি প্রকল্প প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে তাদের একটি অংশগ্রহণ থাকে এবং তাদের দুর্বলতার কারণে এ অনিয়মগুলো হয়। একটি উদাহরণ হলো, বিশ্বব্যাংকের নিজেরই একটি মূল্যায়ন গ্রুপ আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন কমিটি। তাদেরই প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট বলা আছে যে এ দায় বিশ্বব্যাংককে নিতে হবে। এ কারণে বিশ্বব্যাংকের অভ্যন্তরেই চাপ সৃষ্টি হয়েছে এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলো, যারা বিশ্বব্যাংককে অর্থ দেয়, তাদের ভেতর থেকেই চাপটা এসেছে। কারণ তারা দেখতে চায়, তাদের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই দ্বিমুখী চাপের কারণেই ইনটেগ্রিটি ইউনিট গঠিত হয়েছে, যেটার কথা আমাদের বলা হচ্ছে। তারা বলছে, দুর্নীতিকে কোনোক্রমে টলারেট করবে না। সেটাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে অভিযোগ তোলার সঙ্গে সঙ্গে একটি সদস্য দেশ থেকে অর্থ তুলে নেওয়াটা যুক্তিযুক্ত নয়। উচিত হয়নি। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার যে ভুবন, সেখানে কিন্তু সেই অর্থে বিশ্বব্যাংক নবাগত।
কালের কণ্ঠ : আপনি পদ্মা সেতুর দুর্নীতি তদন্ত নিয়ে দুর্নীতি দমন সংস্থার তদন্ত বিষয়ে তাদের স্বাধীনতা আছে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাহলে কি দুদক স্বাধীন নয়?
ইফতেখারুজ্জামান : দুদকের এখন যে আইন আছে ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন আইন, সেটিকে যদি আমরা সাদামাটাভাবে দেখি তাহলে দুদক স্বাধীন হওয়ার কথা। স্বাধীনভাবে কাজ করার মতো আইনি কাঠামো রয়েছে। কিন্তু আমরা যেটা দেখি, আমাদের মতো দেশে দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান ততটুকুই কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যতটুকু ক্ষমতাসীন দল কার্যকর দেখতে চায়। এর সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত আমরা চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও দেখেছি। আমরা দেখেছি যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তা নিয়ে কিছুই করা হয়নি। একইভাবে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই কতগুলো সংশোধনী আনল। যদিও তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করবে। এই সংশোধনের মূল সাবস্ট্যান্স ছিল এই কমিশনের ওপর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। যে কারণে আমরা প্রতিবাদ করেছি, আপনারা গণমাধ্যমে লিখেছেন। কিন্তু তিন বছর সময় কেটে গেছে। সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেও এখন পর্যন্ত সেটা নিয়ে কী ঘটল তা কিন্তু জনগণ জানে না, পার্লামেন্টে এখনো প্রস্তাবাকারে আসেনি। এসব কারণে দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপরও একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য গত তিন বছরে কমিশন যে কাজ করেছে সেখানে একটি ধারার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দেখা যাচ্ছে এবং সেখানে একটি জিনিস আমরা দেখতে পাই যে সরকার দলের কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে কমিশন কতটা দৃঢ়তার সঙ্গে কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তেমনিভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্প দুর্নীতিতে সরকারের যেসব হাইপ্রোফাইল ব্যক্তির নাম এসেছে, সেখানে তাঁদের বিরুদ্ধে কমিশন কতটা কাজ করতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
কালের কণ্ঠ : প্রাসঙ্গিক একটি বিষয়, ২০০৪ সালে যখন নতুন কমিশন এলো সুলতান হোসেনের নেতৃত্বে, তখন এম হাফিজউদ্দিন খান লোকবল ঢালাওভাবে সাজাতে বলেছিলেন। কিন্তু দেখা গেছে, কমিশনের শুরুতেই সরকার দলীয়করণের চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেছে। অভিযোগ আছে, ২২ জন হিন্দু কর্মকর্তার ২১ জনকেই বাদ দিয়েছে এবং বহু বিতর্কিত মতাদর্শের লোককে নিয়োগ দিয়েছে। এবং সেই লোকবল নিয়েই কমিশনের কাজ অব্যাহত রয়েছে। প্রশ্ন হলো, তদন্তকারী কর্মকর্তা স্তরে ওই লোকবল দিয়ে যে কাজ চলছে, সে সম্পর্কে আপনাদের অবজারভেশন কী?
ইফতেখারুজ্জামান : খুবই প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এটি। আপনি যে উদাহরণটি দিলেন এটা কমিশনের ঘাটতির জায়গা। দুর্নীতি দমন কমিশনের ঘাটতির জায়গা। দুর্নীতি দমন কমিশন গঠিতই হয়েছিল টিআইবির একটি উদ্যোগে। টিআইবি গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা খসড়া আইনটি করে দিয়েছিলাম, সেখানে আমরা বলেছিলাম, সাবেক ব্যুরো থেকে যদি কাউকে নিতে হয় তাহলে তাঁদের অতীত রেকর্ড, যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা ভালো করে যেন যাচাই-বাছাই করে নেওয়া হয়। সেটা না করে দুটো কাজ করেছে তৎকালীন সরকার। একটি হলো কিছু পছন্দের লোককে তারা বেছে নেয়। পরে যখন বিতর্ক সৃষ্টি হয় তখন সুইপিংলি সবাইকে অ্যাবজর্ব করে নিয়েছে। ফলে যেটা হয়েছে, দুদক নিয়ে আমরা যে আলোচনা করি, সেখানে আপাতদৃষ্টিতে এ বিষয়টিই আসে যে সরকারের পক্ষ থেকে কতটা চাপ। সেটা বাহ্যিক একটি চ্যালেঞ্জ। কিন্তু দুদকের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জটি ওই খানেই। এখনকার যে দুদক সেটা ওই সাবেক ব্যুরোরই ট্রান্সফরমেশন। মানে ওল্ড ওয়াইন ইন নিউ বোটল। ফলে আগের সেই ব্যুরোর মানসিকতা বা পরিবেশই রয়ে গেছে কমিশনে। সে কারণেই এটি আমাদের একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। সবাই এ কথাই মনে করে, শুধু রাজনৈতিকভাবে বা প্রশাসনের বাইরে গিয়ে কাজ করাই নয়, দুদকের তদন্তের জন্য যে উচ্চমাত্রার দক্ষতার প্রয়োজন, সেটি দুদকের আছে কি না সেটাই মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
কালের কণ্ঠ : অর্থাৎ আপনারা তদন্তকারী কর্মকর্তা স্তর নিয়ে সন্তুষ্ট নন?
ইফতেখারুজ্জামান : ঠিক সন্তুষ্ট নই সেটা বলব না। কারণ আমরা তো ব্যক্তির কাজ নিয়ে অ্যাসেস করি না, করতে পারি না; কিন্তু আমরা যেটা বলতে পারি, সেটা হলো, সাবেক ব্যুরোর যে মানসিকতা সেটা উত্তরণ করে স্বাধীন কমিশনের মানসিকতা সৃষ্টি হয়নি। এটা অনেকের মতো আমাদেরও অবজারভেশন। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির মামলা অত্যন্ত টেকনিক্যাল স্কিল লোক দিয়ে করতে হয়। কারণ যাঁরা দুর্নীতি করেন তাঁরা কিন্তু অত্যন্ত পাওয়ারফুল এবং অর্থবিত্তের অধিকারী। তাঁরা চাইলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী নিয়োজিত করেন অথচ দুদকের অবস্থাটা দেখুন। তাদের রিসোর্সেসের সমস্যা। তাদের ওই মানের আইনজীবী দেওয়ার ক্যাপাসিটিও কিন্তু নেই। এটাও একটি মুখ্য সমস্যা।
কালের কণ্ঠ : নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে আপনাদের পর্যবেক্ষণ কী? বর্তমান নির্বাচন কমিশন কি একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে সক্ষম?
ইফতেখারুজ্জামান : এখন পর্যন্ত এটা বলার সময় হয়নি। আরেকটু দেখতে হবে। আমরা মনে করি, যে নির্বাচন কমিশনটি আমরা পেয়েছিলাম, তাদের যে ডেলিভারি, তাদের যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল, যদিও সেটা নিয়েও প্রশ্ন ছিল, কিন্তু শতভাগ না হলেও একটি প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে উত্তরণ করেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। পর্যবেক্ষকরা এবং আমরাও মনে করি, মোটামুটি সাফল্যের সঙ্গে কাজ চালিয়েছে। সে ধারাটি বর্তমান কমিশন অব্যাহত রাখতে পারবে কি না সেটা দেখার বিষয়। যে তিনজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাঁদের সম্পর্কে অভিযোগ করার মতো বিষয় আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। গণমাধ্যমেও কোনো অভিযোগ আসেনি। তাঁদের কিন্তু যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু কমিশন হিসেবে যে সক্রিয়তা বা অ্যাকটিভ ভূমিকা, স্বাধীনভাবে কাজ করার যে দৃঢ়তা, সে দৃঢ়তার প্রমাণ প্রত্যাশিত স্তরে আমরা কম দেখেছি। যেমন- অতিসম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, কিছু মন্তব্য ও চাপের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা এখন বলছেন একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা। কিন্তু কিছুদিন আগে বলেছিলেন, 'নির্বাচন কিভাবে হয় তার ওপর ভিত্তি করে আমরা কর্মপরিকল্পনা করব।' এতে মনে হয়েছিল, তাঁরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন। তবে আমি আশা করি, সরকারের সহায়তা পেলে যে সরকারের অধীনেই হোক না কেন, যদি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করা হয়, তাহলে হয়তো কমিশন সফল হবে। তবে বড় অ্যাডভানটেজ হলো, নির্বাচন কমিশন সচিব স্বাধীন। হিউম্যান রিসোর্স স্ট্রাকচার যেটা আছে, সেটার কিন্তু পরিবেশ আছে। সেই সঙ্গে যদি প্রশাসনের সহায়তা পায়।
কালের কণ্ঠ : সেটাই প্রশ্ন। প্রশাসনের সহায়তা পাওয়ার মতো শক্তি নির্বাচন কমিশনসংক্রান্ত আইনি কাঠামোতে আছে কি?
ইফতেখারুজ্জামান : সাংবিধানিকভাবে কমিশনের যে আইনি কাঠামো আছে, সেটা অনুযায়ী থিওরিটিক্যালি কমিশনের স্বাধীনভাবে কাজ করার কথা। কিন্তু সেটা করতে দুটো জিনিস দরকার। প্রথমত নির্বাচনের সময় এবং প্রস্তুতিপর্বে এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে নির্বাচন কমিশনের কাজের ওপর কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব যেন না থাকে। যেমন- নির্বাচনের সময় কিছু মন্ত্রণালয়কে কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত করার প্রবিশন রয়েছে। সেটা সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার উল্লেখ করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো এবং স্থানীয় প্রশাসন যদি সহায়ক হয়, তাহলে কমিশন সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে।
একই সঙ্গে কমিশনের লিডারশিপ ক্যাপাসিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদের দৃঢ়তা তিনজনের মধ্যে ঐকমত্য এবং সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।
কালের কণ্ঠ : এ টি এম শামসুল হুদা এবং তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে গঠিত নির্বাচন কমিশন কিন্তু সরকারের সহযোগিতা পায়নি। নির্বাচনে সেনাবাহিনী চেয়ে পায়নি একাধিক নির্বাচনে।
ইফতেখারুজ্জামান : সে জন্যই দুদকের প্রশ্নেও আমি বলেছিলাম, এ ধরনের কমিশনগুলো ততটুকুই কার্যকর হবে, যতটুকু সরকার দেখতে চায়। যতই শক্তিশালী কমিশন গঠন করা হোক, এর সঙ্গে মানসিকতার বিষয়টিও যুক্ত।
কালের কণ্ঠ : আইনি কাঠামো সংস্কারের কোনো নতুন প্রস্তাব টিআইবির আছে কি?
ইফতেখারুজ্জামান : এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। আমাদের আগে যে সংস্কারগুলো হয়েছিল, সেখানে আমরা অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে কাজ করেছি এবং সেখানে কিছু ভালো ফল পাওয়া গেছে। এই কমিশনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার জন্য আমরা প্রস্তাবনা দিয়েছি। তারা বলেছে, সুশীল সমাজসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই আমাদের প্রস্তাবনা আমরা দেব। এটি নিয়ে বিদায়ী কমিশনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা কাজ করতে চাই।
কালের কণ্ঠ : বর্তমান বাংলাদেশের দুর্নীতির সূচক কেমন বলে মনে করেন?
ইফতেখারুজ্জামান : এ সূচক দুইভাবে নির্ধারণ করা হয়। একটি হলো আন্তর্জাতিক তুলনামূলক বিশ্লেষণ। আন্তর্জাতিক তুলনামূলক বিশ্লেষণে একটি সূচক আছে, সেটির নাম দুর্নীতি ধারণা সূচক। যেটি প্রতিবছর প্রকাশিত হয়। সেটি বার্লিনভিত্তিক টিআই করে থাকে। আমরা সেটা প্রকাশ করি। সেখানে আপনি জানেন, বাংলাদেশের অবস্থান ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে শীর্ষে ছিল। পরে ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক তুলনামূলক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অবস্থানের কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। ২০১১-তে এসে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১০-এর মধ্যে ২.৭-এ। এটা ২০০১-এ ছিল ০.৪-এ। তুলনামূলক কিছু অগ্রগতি হলেও এখন পর্যন্ত ৫-এর নিচে স্কোর রয়েছে। ৫-এর ওপর যেতে পারলে আমরা বলতে পারব যে মধ্যম পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। এর মানে এখনো অনেক দূরে আছি আমরা। তবে আমরা একটি খানা জরিপ করে থাকি দুই বছর পর পর। সেখানে দেখা গেছে, ২০০৭-এর তুলনায় দুর্নীতি বেড়েছে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
ইফতেখারুজ্জামান : আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.