খুন হয়েছিলেন পাক অভিনেত্রী লায়লা খান

প্রায় দেড় বছর ধরে নিখোঁজ পাক বংশোদ্ভুত অভিনেত্রী লায়লা খানকে খুন করা হয়েছে। তার সঙ্গে, গত বছর ৯ ফেব্রুয়ারি গুলি করে খুন করা হয় লায়লার মা, ভাই-বোন-সহ মোট ৬ জনকে। পুলিশি তদন্তে সামনে এলো এই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
বৃহস্পতিবার জম্মুর কিস্তাওয়ার থেকে পুলিশের জালে ধরা পড়ে মূল অভিযুক্ত পারভেজ টাক। তাকে দফায় দফায় জেরা করে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ। লায়লার ‘বন্ধু’ পারভেজ জেরায় তার অপরাধ স্বীকার করেছেন বলে দাবি পুলিশের।
পারভেজ স্বীকার করেছেন, লায়লা খান এবং তার পরিবারকে বলা হয়, মুম্বাইতে তারা নিরাপদ নন। তাই, তাদের দুবাই চলে যেতে হবে। এই কথা বলে গত বছর ৯ ফেব্রুয়ারি তাদের সবাইকে দুটি গাড়িতে করে মুম্বাইয়ের একটি নির্জন জায়গায় নিয়ে যান পারভেজ। সেখানে গুলি করে খুন করা হয় লায়লা খান ও তার পরিজনদের। এরপর কাছেই একটি জায়গায় দেহগুলি মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। হত্যাকাণ্ডে পারভেজের সঙ্গী ছিল আতিস শেখ ওরফে সোনু এবং আফগান খান।

খুনের পর দুবাই পালিয়ে যান পারভেজ। প্রায় এক বছর সেখানে থাকার পর আসেন জম্মুর কিস্তওয়ারে। তার সঙ্গে ছিল লায়লার একটি দামি গাড়ি। সেই গাড়িটি দেখেই জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের সন্দেহ হয়। এরপরই গ্রেফতার করা হয় পারভেজকে।

পুলিশের দাবি, জেরায় পারভেজ জানিয়েছেন, লায়লার সম্পত্তি হস্তগত করার উদ্দেশ্যেই এই হত্যাকাণ্ড। পারভেজকে নিজেদের হেফাজতে নেবে মুম্বাই ক্রাইম ব্রাঞ্চ। মুম্বাই শহরের কোথায় লায়লাদের খুন করে দেহ পুঁতে ফেলা হয়, সেই তথ্য জানতে তাকে এবার জেরা করবে মুম্বাই পুলিশ। অভিযুক্ত আতিস শেখ এবং আফগান খানের খোঁজে চলবে তল্লাশি। অভিনেত্রী লায়লা খানের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈবা এবং পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এরও যোগ ছিল বলে সন্দেহ মহারাষ্ট্র এটিএসের। খুনের তদন্তের পাশাপাশি সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

পুলিশের একাংশের দাবি, লায়লা খান নিজেই ছিল আইএসআই-এর সিক্রেট এজেন্ট। ২৬/১১ -এর পর তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি পাক গুপ্তচর সংস্থা। তাই সপরিবারে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার ছক কষে রাওয়ালপিন্ডিতে থাকা সংগঠনের বড় কর্তারা।  অথবা যেহেতু তাকে দিয়ে কাজ উদ্ধার হয়ে গিয়েছে তাই তার মুখ বন্ধ করাটা জরুরি হয়ে পড়েছিল। সেই সঙ্গে উচ্চাকাঙ্কী লায়লা বলিউডে তৈরি করা নিজের জমিটা ছাড়তে চাইছিল না। তাই মতান্তর হওয়াতে তাকে সরিয়ে দেয়া হলো।

গুপ্তচর লায়লা খান
এই শিরোনাম ভারতীয় মিডিয়ার।

আনন্দবাজার লিখেছে, বলিউড, গ্ল্যামার আর সন্ত্রাসের কালো দুনিয়া। এই সব গুলো মিলেমিশে যেতে দেখা গিয়েছে অনেক সময়। দাউদ, আবু সালেমদের মত অন্ধকার দুনিয়ার লোকদের সঙ্গে বলিউডের সম্পর্কটা দু দশকেরও বেশি বেশ ঘনিষ্ঠ। তাদের সঙ্গে সুন্দরী নায়িকারাও যোগ দিয়েছেন বহু সময়। হাতের কাছের সহজ উদাহরণ মনিকা বেদি। কিন্তু লায়লা খান নামের এক পাক অভিনেত্রীর ঘটনাটা ছাড়িয়ে গেল সব কিছু। ঘটনাটা খোলসা করে বলা যাক।

আনন্দবাজার জানাচ্ছে, ২০০৮ সালে রাজেশ খান্নার বলিউডে প্রত্যাবর্তন নিয়ে বেশ ঝড় উঠেছিল। রাখি সাওয়ান্তের ভাই রাকেশ সাওয়ান্তের পরিচালনায় ‘ওয়াফা’ নামের এক বলিউডি সিনেমায় প্রত্যাবর্তন ঘটে রাজেশ খন্নার। নিঃশব্দে সেই সিনেমায় বলিউডে পা রেখেছিলেন পাকিস্তানের এক অভিনেত্রী লায়লা খান। সেই সিনেমায় লায়লার খোলামেলা দৃশ্যে অভিনয় দেখে অনেকেই বলেছিলেন, সাহসী দৃশ্যে অনেকেকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন লায়লা। আরেক পাক অভিনেত্রী বীণা মালিকের বাজার খাবেন লায়লা।

কিন্তু এরপরই হঠাৎ করে হারিয়ে যান এই পাক সুন্দরী। প্রচারমাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়ে যায় লায়লা কোথায়? এ দিকে ২০১১ সালের দিল্লি হাইকোর্ট চত্বরে বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্তে নেমে দিল্লি পুলিশ এক অদ্ভুত তথ্য পায়। তদন্তে নেমে যা থেকে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে পড়ে। পুলিশের কাছে থেকে সূত্র পেয়ে ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি ও আইবি’র গোয়েন্দারা তদন্তে জানতে পারেন, জঙ্গিরা রাতে সারা খান নামের এক মহিলার বাড়িতে রাত কাটিয়েছিলেন। পরে জানা যায়, সারা আর লায়লা আসলে একই মহিলা। পুলিশও হতবাক, বলিউডে অভিনয়ের নাম করে কীভাবে জঙ্গি হানার ছক কষত লায়লা‌! পুলিশ তদন্ত আরও গভীরে নিয়ে যায়। জানা যায়, লায়লার ভাই একজন লস্কর- ই- তৈবার সদস্য। সে গুপ্তচর চক্রের কিংপিন। অভিনয়ের নাম করে ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর, জায়গা, পরিকাঠামো ও ভবনের ছবি ও তথ্যলস্কর- ই- তৈবাকে, বকলমে আইএসআই এজেন্টদের সরবরাহ করত লায়লা। সঙ্গে নিজের নামের আর শরীরের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা চালান করত লস্কর- ই- তৈবাকে। আসলে সে ছিল লস্কর তথা আইএসআই-এর চর।

লায়লার বোন আজমিনা পটেল, বাবা আসিফ শেখ আর পারিবারিক বন্ধু পারভেজ ইকবাল তাক লায়লার সঙ্গে জঙ্গি কার্যকলাপে যুক্ত ছিল। লস্কর- ই- তৈবার আদেশ মেনে এই গত বছর সেপ্টেম্বরে লায়লা আর তার পরিবারের চারজন বোমা নিয়ে দিল্লি হাইকোর্টের বাইরে এক জঙ্গির হাতে তুলে দেয়। এরপর তিনটে আলদা গাড়িতে ইজ্জতপুরের ঘরে ফিরে আসে লায়লারা। সেখানে এই চারজন পাকিস্তান মদতপুষ্ট লস্কর জঙ্গিদের সঙ্গে সাঙ্কেতিক ভাষায় কথাবার্তার পর ঘরের সব নথি আর কাগজপত্রে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পরে আলাদা আলাদা ভাবে দেশ ছাড়ে। কিন্তু লায়লা এখন পাকিস্তানে, নাকি অন্য কোনও দেশে আছে তা জানা যায়নি। কার্যত লায়লা গায়েব। তার হদিশ নেই। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও কিছু জানে না। সবচেয়ে মজার ঘটনা হল, তার কেউ খোঁজ নেয়নি। তার পরিবারের লোকজন এবং পাক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেউ না। সীমান্তের ওপার থেকে কেউ প্রশ্ন তোলেনি, ভারত থেকে পাক মেয়েটা গেল কোথায়? তখনই সন্দেহটা দৃঢ় হয় ভারতীয় গোয়েন্দাদের।

পত্রিকাটি আরো লিখেছে, তিন বছর আগে মুনীর খান নামে এক ছদ্মবেশী বাংলাদেশী হুজি জঙ্গির সঙ্গে বিয়ে করেন লায়লা। এরপরই লায়লার সঙ্গে লস্করের যোগাযোগ হয়। লস্কর সেই সময় এমন একজনের খোঁজে ছিল যে ভারতের গোয়েন্দদের চোখে ধুলো দিয়ে নিঃশব্দে জঙ্গি আক্রমণ চালাতে পারে। লায়লা আবার বলিউডে অভিনয় করে সন্দেহের কোনো অবকাশই রাখেননি।

লায়লাকে যে পরিচালক বলিউডে সুযোগ করে দেন সেই রাকেশ সাওয়ান্ত বলছেন, “সিনেমা নিয়ে আলোচনা করতে লায়লার বাড়িতে মাঝে মাঝেই যেতাম। ওর বাড়িতে অনেক সন্দেহভাজন লোককে দেখেছি। লায়লার ড্রয়িংরুমে অস্ত্র পড়ে থাকতে দেখেছি। কিন্তু লায়লা বরাবরই বিভিন্ন অজুহাতে এসব কিছু বুঝতে দেয়নি। ও বলত, ওর পরিচিতরাই ঘরে রয়েছে।”

সুন্দরী, বলিউড, জঙ্গি হানা সব কেমন একসূত্রে গেঁথে গেল। লায়লার ঘটনা প্রমাণ করল আলোর নীচে বহু অন্ধকার আছে। যা এখনও ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতের বাইরে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কূটনীতিকের কথায়, হাজার ক্ষতে ভারতকে রক্তাক্ত করার পুরনো নীতি কার্যকর করতে গিয়েই পাকিস্তান প্রতিহিংসার বশে ফের এই কাজ করেছে। ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে এব্যাপারে ‘টিপ অফ’ও আসছে, কখনও আগে, কখনও পরে। এক্ষেত্রে পরে এসেছে। তাই ‘পাখি’ উড়ে গিয়েছে। ঠিক ডেভিড কোলম্যান হেডলি ওরফে দাউদ গিলানি নামে পাক-আমেরিকান লোকটি মুম্বইয়ের ব্যবসায়ী ও বলিউডের লোকদের ঠকিয়ে নিজের কাজ হাসিল করেছিল, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। দুঁদে গোয়েন্দা থেকে মুম্বাই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের অফিসাররাও জানিয়েছেন, মহেশ ভাটের ছেলে রাহুল ভাট ও মেয়ে পূজা ভাটকে বোকা বানিয়ে নিজের প্রভাব খাটিয়ে কাজ হাসিল করেছিল সাদা চামড়ার পাকিস্তানি গুপ্তচর ডেভিড কোলম্যান হেডলি ওরফে দাউদ গিলানি। পাক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির নিজের ভাইপো হেডলি আগে ছিল পেশায় ড্রাগ মাফিয়া। পরে হয় এফবিআই -এর এজেন্ট। ২৬/১১ এর আগে মুম্বাই-এ রেকি করে সব তথ্য সে তুলে দিয়েছিল আইএসআই অফিসারদের হাতে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই নিখুঁত হামলা চালায় কাসবরা। সে এখন মার্কিন মুলুকে শিকাগোয় বিচারাধীন বন্দি। সেই হেডলির কায়দা মতোই পাক সিক্রেট এজেন্টের কাজ কাজ করত লায়লা। যা জানতে পেরে কিংবদন্তী অভিনেতা রাজেশ খান্না থেকে বলিউড স্তম্ভিত। পুলিশ অফিসারদের কথায় এরকম কত জন লায়লা এদেশে আছে তার একটা সম্ভাব্য তালিকাও তৈরি করে নজরদারি চালাচ্ছেন গোয়েন্দারা।

সুত্র: জিনিউজ, টাইমস অব ইন্ডিয়া, আনন্দবাজার।

No comments

Powered by Blogger.