আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৮৪)-ঐতিহাসিক দলিল স্টপ জেনোসাইড by আলী যাকের

কলকাতায় দুপুরে সাধারণত ফুটপাতের ধারে শালপাতার ঠোঙায় কাবলি মোটরের তৈরি ঘুগনি, যার দাম ৩৫ পয়সা- এই ছিল আমাদের লাঞ্চ। বিকেলে খুব বেশি ক্ষিদে পেলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অদূরে যে চায়ের দোকান আছে, সেখানে গিয়ে একটা শিঙাড়া কিংবা একটি বনরুটি।


কেবল রাতের বেলা মাঝেমধ্যে সময়মতো আমার নানাবাড়িতে ফিরলে কিংবা বড় আপার বাড়িতে গেলে নিদেনপক্ষে একটি ব্যঞ্জন এবং ডাল দিয়ে ভাত খাওয়া হতো। অধিকাংশ দিন সময়মতো বাড়ি ফেরা হতো না। ভাবতে অবাক লাগে যে ওই তরুণ বয়সে অদম্য ক্ষুধা পেটে সংবরণ করতে কোনো কষ্ট পেতে হয়নি। নিজেদের কাজের উত্তেজনা নিয়ে এতই মত্ত থাকতাম আমরা যে খাওয়া, ঘুম ইত্যাদি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না আমাদের। তবুও যখন কেউ আদর করে খেতে ডাকতেন, বড় ভালো লাগত। খাওয়া শেষ হলে পরে বুঝতাম যে দীর্ঘদিন প্রায় অভুক্ত কেটেছে আমাদের। এই সময় কলকাতার রাস্তার মোড়ের ফেরিওয়ালাদের তৈরি করা ঝালমুড়ি একটি অতি উপাদেয় খাদ্য ছিল। ঝালমুড়ির সঙ্গে কলকাতায় ছোলা সেদ্ধ, আলু সেদ্ধ, ধনেপাতা এবং টমেটোও মেশানো হতো। মনে হতো যেন অমৃত খাচ্ছি। কলকাতার সর্বত্র সংবাদ সংগ্রহের জন্য ঘুরে বেড়াতাম- এর উল্লেখ আগেও করেছি। তবে যেটি করিনি সেটি হচ্ছে, এসব ঘোরাঘুরি ছিল সম্পূর্ণ পদযুগলনির্ভর। সত্যিকথা বলতে গেলে আমি কলকাতার প্রায় সব পাড়া, সব রাস্তা, এমনকি গলিঘুঁজিও চষে বেড়িয়েছি ওই সময়। এসব জায়গার বেশির ভাগই এখনো স্পষ্ট মনে আছে আমার। এই পরিণত বয়সে আমার সঙ্গে কোনো কলকাতাবাসীর প্রথম সাক্ষাতেই আমি তাদের বলি, I know Kolkata like the back of my palm. এই ঘোরাঘুরির সময় বাংলাদেশি হিসেবে বিরল সম্মান দেখিয়েছে কলকাতাবাসী আমাকে। ট্রাম-বাসে একদম খালি পকেটে অবলীলায় উঠে যাওয়া যেত। বাংলাদেশ থেকে এসেছি বললে কখনো টিকিটের পয়সা চাইত না ওরা। বাল্যকাল থেকেই কলকাতা আমার পছন্দের শহর। একাত্তরে কলকাতা হয়ে গেল আমার ভালোবাসার শহর।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় কেবল যে কলকাতার সাধারণ মানুষই বাংলাদেশিদের প্রতি সব সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, পরম সংবেদনশীলতা এবং ভালোবাসায়, তা-ই নয়, তখনকার কলকাতার সব প্রখ্যাত মানুষ বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সংগঠন করতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়, যিনি লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ওপর সেই বিখ্যাত চরণ- 'যত দিন রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরি-যমুনা বহমান/তত দিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।' তাঁরই আহ্বানে এগিয়ে এসেছিলেন কবি বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নিরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, জনকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ জাস্টিস মাসুদ, লেখক-সাংবাদিক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মৈত্রেয়ী দেবী, ইলা মিত্র, রমেন মিত্র, ডা. নৃপেন সেন, যামিনী রায়, প্রসূন বসু, মানিক সেন, ইন্দ্রজিৎ গুপ্তসহ আরো অনেকে। তাঁরা বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির পতাকাতলে সমবেত হন এবং ভারত সরকার ও বিশ্বে গণতন্ত্রমুখী সব মানুষের কাছে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। আমার পাঠকদের মধ্যে হয়তো অনেকেই শ্রীমতি ইলা মিত্রের নাম শুনে থাকবেন। এই সেই অগ্নিকন্যা, যিনি তেভাগা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং সাঁওতালদের নাচোল বিদ্রোহের সময় পাকিস্তানি পুলিশের অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন আমার কাছে একেকজন মহামানব। জীবনে কখনো তাঁদের সান্নিধ্যে আসতে পারব- এ কথা কল্পনাও করিনি। হতবাক হয়ে গেছি তাঁদের সারল্য দেখে, মানুষের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা দেখে। কলকাতার অদূরে সল্টলেক সিটিতে যে শরণার্থী শিবির ছিল, সেখানে লাখ লাখ মানুষের মানবেতর জীবনযাপনে যে সাহায্য-সহযোগিতা কলকাতার সব মানুষ উদারচিত্তে করেছিলেন, তার পেছনে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির অবদান অনস্বীকার্য ছিল।
এই সময় শহীদ জহির রায়হান বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করার জন্য স্টপ জেনোসাইড নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন। সাদাকালোয় অতি অল্প খরচে তৈরি এই ডকুমেন্টারি ফিল্মটি সর্বত্র সাড়া জাগায়। এই ছবিটি নির্মাণের সময় জহির রায়হানের দক্ষিণ-হস্ত ছিলেন তাঁরই পরম সুহৃদ প্রয়াত আলমগীর কবির। তখনো জহির ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। হঠাৎ একদিন কবির ভাই বেতারের স্টুডিওতে কাজ শেষে আমায় বললেন, 'চলো, টালিগঞ্জে যাই।' আমি জিজ্ঞেস করলাম, টালিগঞ্জ কেন? উনি বললেন, গেলেই বুঝতে পারবে। প্রসংগত উল্লেখযোগ্য, টালিগঞ্জ হলো কলকাতার ফিল্ম স্টুডিওপাড়া। টালিগঞ্জে পৌঁছে কবির ভাই আমাকে নিয়ে সরাসরি একটি ডাবিং স্টুডিওর ভেতরে ঢুকে গেলেন। সেখানেই পরিচয় হলো জহির রায়হানের সঙ্গে। ছোটখাটো মানুষটি। খুব কম কথা বলতেন। আর যখনই বলতেন, তাঁর চোখ দুটি তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে শ্রোতার মুখের ভাষা অবলোকন করত। একেবারে মর্মভেদি দৃষ্টি ছিল তাঁর। প্রথমেই কবির ভাই বললেন, আমরা একটা ডকুমেন্টারি শুট করেছি, দেখো। তারপর সদ্য সম্পাদনা করা স্টপ জেনোসাইডের নির্বাক ফুটেজ চালিয়ে দেওয়া হলো। কোনো শব্দ নেই, কোনো সংগীত নেই। কেবল চলমান ছবি এত বাক্সময় হতে পারে, তা কখনো দেখিনি। এরপর কবির ভাই বললেন, এই ছবিটি বহির্বিশ্বের জন্য ইংরেজিতে ডাব করা হবে। ছবিটির মূল কণ্ঠস্বর ছিল কবির ভাইয়ের, আর দুটো ছোট্ট খণ্ডাংশ ছিল ভিন্ন গলায়, যার একটি ছিল আমার। দ্বিতীয়টি কার হবে জানতে যখন চাইলাম, জহির ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'একটি নারীর কণ্ঠ হলে ভালো হতো। পরিষ্কার ইংরেজি বলতে পারে এমন কোনো বাংলাদেশি মেয়ে কি কলকাতায় আছে?' আমার হঠাৎ মনে পড়ল মিলিয়ার কথা। মিলিয়া গনি। রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। শরণার্থী হয়ে মিলিয়াও তখন কলকাতায় এবং মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী সংস্থার স্কোয়াডের সদস্য। আমি জহির ভাইকে বললাম, মনে হয় আমি একজনকে চিনি, যে এই কাজটি করতে পারবে। পরদিন মিলিয়াকে বলতেই সে আগ্রহভরে রাজি হয়ে গেল এবং স্টপ জেনোসাইডে এখন আমাদের তিনজনের কণ্ঠই শোনা যায়। এই একটি ঐতিহাসিক দলিল, যার সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি। এই ছবিটি যত দিন থাকবে, তত দিন আমরাও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যক্ষ অংশীদার হিসেবে বেঁচে থাকব।
(চলবে.....)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.