এখনও এলো না ফেরি by নাহিদ নলেজ

চিলমারী নদীবন্দরের গুরুত্বের কথা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। আব্বাসউদ্দিনের ভাওয়াইয়া গান যিনি শুনেছেন, তার কাছে চিলমারী স্বপ্নভূমি। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে ৭০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, সুলতানি আমল, ব্রিটিশ পর্ব, পাকিস্তান আমলসহ ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে চিলমারী বন্দরের ইতিহাস নির্ধারক ভূমিকা সকলের জানা।


তবুও স্মরণ করিয়ে দিতে হয়, কারণ এ দেশকে রাষ্ট্র হিসেবে আত্মসচেতন, আত্মকর্তব্যপরায়ণ ও ইতিহাসের নির্মাতা হতে গেলে তা করতে হবে।
যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের নাড়ি-শিরা-উপশিরার মতো আর রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হলে নিজ পায়ের ওপরই দাঁড়াতে হবে, নিঃশ্বাস নিতে হবে নিজ দেশের জল-হাওয়াতেই। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ, নদীর গতিপথকে কেন্দ্রে রেখে যোগাযোগ মাধ্যম গড়ে তুলতে হবে। তার ওপর যদি এই নৌপথই হয় সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও নিরাপদ, তাহলে আমরা হাতের লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলব কোন স্বার্থে? এসকাপ ও ইউএনডিপির যৌথ গবেষণায় দেখানো হয়েছে, টন-কি.মি.তে সড়কপথে যেখানে খরচ হয় ২১৭ টাকা, রেলপথে যেখানে ৮৫ টাকা, সেখানে নৌপথে মাত্র ২৫ টাকা। তবুও উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ, পৃথিবীর উর্বর ভূমি নষ্ট হচ্ছে, ঘনবসতিপূর্ণ দেশে রাস্তায়, আমদানিকৃত তেল-মবিলের গাড়িতে সৃষ্টি করছি দীর্ঘতম যানজট, ঋণ করে ঘি খাওয়ার অশ্লীল সংস্কৃতি নির্মিত হচ্ছে। বর্ষা নামলেই বিশাল বিশাল ভারতীয় জাহাজগুলো চিলমারী বন্দর হয়ে চলাচল করে, শুষ্ক মৌসুমে ফেরি চলাচলের সুযোগ না থাকলে মেঘনা-যমুনা কোম্পানির তেলবাহী বিশাল ট্যাঙ্কারগুলো কীভাবে ডিপোতে আসে। ভারত সরকার ট্রানজিট-করিডোর হিসেবে যে নৌরুটের প্রস্তাব দিয়েছে, তার কেন্দ্রেও আছে চিলমারী নদীবন্দর। ভারতীয় জাহাজগুলোকে পথ করে দেওয়ার জন্য ড্রেজিং ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও বাংলাদেশ বছরে পায় মাত্র ৫ কোটি টাকা। নৌপথে কত দ্রুতগতির জলযান আবিষ্কৃত হয়েছে, কিন্তু চিলমারী-রৌমারী-রাজীবপুর-বাহাদুরাবাদঘাট-আরিচা ইত্যাদি রুটে চলছে কাঠের তৈরি শ্যালো নৌকা। এক নদী হাজার ক্রোশ_ এই তত্ত্বায়নের পাটাতনে দাঁড়িয়ে সম্প্রতি সরকার কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী- রাজীবপুর উপজেলাকে দুর্গম এলাকা ঘোষণা করেছে। অথচ ২০-২৫ বছর আগেও এই অঞ্চলেও ফেরি যোগাযোগ ছিল, উপজেলা দুটিকে কুড়িগ্রাম জেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপরই যারা উত্তরাঞ্চলের ভূগোল সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন, তারা এটা বুঝবেন।
আজকের উত্তরবঙ্গের মঙ্গা নিয়ে যারা চিন্তিত, তারা এই বিষয়টি নিয়ে অবগত কিনা জানি না, যখনই এই অঞ্চলকে উন্নত নৌ ও রেল যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, মঙ্গা আসলে শুরু হয়েছে তখন থেকেই। ব্রহ্মপুত্র সাক্ষী, এই অঞ্চলটি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল, সে সঙ্গে ছিল বর্ধিষ্ণু এলাকা। জনশ্রুতি আছে, শুধু জন্মাষ্টমীর স্নানের মেলাই হতো ১৮ দিনব্যাপী। এ থেকেও বোঝা যায় ব্যবসা-বাণিজ্য কী মাত্রায় হতো। পাটের ব্যবসা নারায়ণগঞ্জের পরই ছিল চিলমারীর স্থান।
শোনা কথা, খুলনা শিপইয়ার্ডে চীনসহ বিভিন্ন দেশের যুদ্ধজাহাজ বানানোর অর্ডার নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, আর জানা কথা আমাদের দেশীয় জাহাজ চলাচলক্ষম নাব্যতাসম্পন্ন গভীর খাত তৈরিতে সক্ষম_ এ রকম ড্রেজার বানানো দক্ষতা বেশ ভালোই আছে এই শিপইয়ার্ডের। যে বাংলাদেশ জাহাজ রফতানি করছে ভিনদেশে আর নিজেদের যেখানে ড্রেজার কারখানা আছে, তবে আর কেন নদীমাতৃক বাংলাদেশের বিপক্ষে সড়কপথ নিয়ে এত হুজ্জতি? রাষ্ট্র করার মতো খবর হলো, কুড়িগ্রামে ধরলা ব্রিজ প্রতিষ্ঠার পর অবহেলায় পড়ে আছে দু'দুটি ফেরি, অব্যবহারে নষ্ট হচ্ছে জনগণের সম্পদ। অন্যদিকে চিলমারীর-রৌমারীর জনগণ চেয়েও ফেরি পাচ্ছে না_ আশ্চর্য বৈপরীত্য!
আমরা যদি এই অঞ্চলকে সত্যিই বর্ধিষুষ্ণ অঞ্চলে পরিণত করতে চাই, তাহলে এই বন্দরকে গতিশীল জীবনের স্রোতে ভেড়াতে হবে। আর সে পথে প্রথম পদক্ষেপ হবে ফেরি যোগাযোগ পুনরায় চালু করা। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশকেই নৌপথে ভিড়তে হবে।
nahiduttar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.