'অর কারণে অনেক ছেলে নষ্ট অইছে'-পুরান ঢাকায় স্বস্তি, সঙ্গে আতঙ্কও by এস এম আজাদ

পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মর্গের সামনে উৎসুক জনতার ভিড়। সময় গতকাল বুধবার দুপুর ১টা ৩৫ মিনিট। এক নারীর বিলাপে একপর্যায়ে থেমে গেল সব শোরগোল, 'অয় আমার দুইডা পোলারে শেষ করছে। আল্লাহর কাছে কইছি, অর যেন এমন মরণ অয়। অর লাশটা আমারে একটু দেখতে দেন।


আমার কলিজাটা ঠাণ্ডা করি...।' মর্গের সামনে গ্রিলের দরজার এপারে দাঁড়িয়ে এভাবেই বিলাপ করছিলেন কালো রঙের বোরকা পরা এক মধ্যবয়সী নারী। উপস্থিত এলাকাবাসী, ভুক্তভোগী, সাংবাদিক, পুলিশসহ সবাই ঘিরে ধরেন ওই নারীকে। সবার কৌতূহল, কে এই নারী?
শিরিন আক্তার নামের ওই নারী নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, 'আমি রাজীব ও সজীবের মা। সকালে টেলিভিশনে দেখছি, ডাকাত শহীদ মরছে। বিক্রমপুর থেইকা চইলা আইছি। আমি ওর লাশটা নিজের চোখে দেখতে চাই। অর কারণে অনেক ছেলে নষ্ট অইছে।'
কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে শিরিন জানান, একসময় ডাকাত শহীদের হয়ে কাজ করত তাঁর দুই ছেলে রাজীব ও সজীব। ছয় বছর কারাভোগের পর ডাকাত শহীদের দলে কাজ না করায় বিপদে পড়ে সজীব। সেই ছেলে র‌্যাবের ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আর শহীদের লোকজন গুম করেছে অপর ছেলে রাজীবকে। সে সাত মাস ধরে নিখোঁজ। এরা দুজনই তাঁতীবাজারে শহীদের সহযোগী ভুট্টুর সঙ্গে কাজ করত।
মর্গে ঢুকে শহীদের লাশ দেখে শনাক্ত করেন শিরিন। এ সময় তিনি বলেন, 'আমার ছেলের (সজীব) কাছে আমি অর দাড়িওয়ালা ছবি দেখিছি। এইটাই ডাকাত শহীদ। অয় দাড়ি রাখছে। চশমাও পরে।' শিরিন বলেন, 'আমার পোলারে তো আমি দাফন করছি। অরে দাফন করব কে?'
শীর্ষ সন্ত্রাসী ডাকাত শহীদ সহযোগীসহ বন্দুকযুদ্ধ নিহত হওয়ার খবরে গতকাল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন পুরান ঢাকার মানুষ। ডাকাত শহীদের লাশ একনজর দেখার জন্য মর্গের সামনে ভিড় করেন পুরান ঢাকার অনেকে। সবার মুখেই ছিল ধিক্কার আর ঘৃণার অভিব্যক্তি। পুরান ঢাকার ব্যবসায়িক এলাকাগুলো ঘুরে একরকম স্বস্তির ছায়া দেখা গেছে।
পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর দক্ষিণাঞ্চলের আতঙ্ক ডাকাত শহীদ নিহত হওয়ার খবর এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না অনেকেই। এখনো ভয় আর সংশয় ছাড়ছে না তাঁদের। ডাকাত শহীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে তাঁরা এখনো দ্বিধাগ্রস্ত। ডাকাত শহীদের সহযোগীদের ভয়ে এখনো মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন চাঁদাবাজির শিকার ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ বলছেন, র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে যদি সত্যিই ডাকাত শহীদ মারা গিয়ে থাকে তাহলে তা র‌্যাবের জন্য একটি বড় সাফল্য।
গতকাল মর্গে কথা হয় সূত্রাপুর থানার এসআই মোহাম্মদ কাওসারের সঙ্গে। তিনি জানান, মর্গ এলাকায় নিরাপত্তার জন্য ৪০ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
জানা গেছে, মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশ ডাকাত শহীদ ও তার সহযোগী ছোট কালু ওরফে কেরঞ্চি কালুর লাশ মর্গে নিয়ে আসে। তবে গতকাল এ দুজনের লাশ শনাক্ত করতে বা নিতে কোনো স্বজন মর্গে যায়নি। কাঁচা-পাকা দাড়ির শহীদের শরীরে তিনটি গুলি বিদ্ধ হয়েছে। তার পরনে ছিল নীল রঙের জিন্সের প্যান্ট, গ্রামীণ চেক শার্ট ও লাল রঙের গেঞ্জি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত অনেক আগের শহীদের ছবির সঙ্গে বর্তমানের এই চেহারার অনেক অমিল। তবে র‌্যাবসহ নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, নিহত ব্যক্তি ডাকাত শহীদই।
ডাকাত শহীদের হাতে নিহত ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিনয় সরকার বীণার স্ত্রী সারিকা সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সৃষ্টিকর্তা তাঁকেও এভাবে মারলেন। আমি বিচার পাইছি।'
লাশ দেখে আরমানীটোলার মুক্তা বেগম বলেন, 'একজন মানুষ মরলে লোকজন দুঃখ করে, তার আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া করে। অথচ এই ব্যক্তির মৃত্যুতে উল্টো সবাই খুশি হয়েছে।' কথা হয় তাঁতীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী সাইদ আহমেদ রানার সঙ্গে। তিনি জানান, ২০০৬ সালের ৬ নভেম্বর তিনিসহ ছয়জনকে চাঁদার দাবিতে গুলি করে ডাকাত শহীদের সহযোগীরা। জিন্দাবাহার এলাকায় ওই গুলির ঘটনায় ডালিম নামের এক ব্যবসায়ী আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। রানা বলেন, 'দেখতে আসছি আসলেই ওই লোকটা মরেছে কি না।'
২০১০ সালের ৪ মার্চ ডাকাত শহীদের সহযোগীরা গুলি করে হত্যা করেছিল স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রেমকৃষ্ণ রায়কে। প্রেমের ভাই পরিচয় দিয়ে এক যুবক বলেন, 'আমার ভাইকে মারার পর আমার কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করেছিল। তার (শহীদ) অনেক সহযোগী আছে। নাম বইলা বিপদে পড়তে চাই না।' স্বপন নামের আরেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী বলেন, 'শহীদ যদি সত্যিই মরে থাকে তবে আমরা বাঁচলাম। সে রাতের ঘুম হারাম করে ফেলেছিল।'
চাপা আতঙ্ক : পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, কোতোয়ালি রোড, শাঁখারীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসা, ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসা, পাটুয়াটুলীর ঘড়ি ব্যবসা, বাদামতলীর ফল ব্যবসা, কেরানীগঞ্জের গার্মেন্ট পট্টি, চকবাজারের মনিহারিসহ বিভিন্ন পাইকারি ব্যবসা, মৌলভীবাজারের মসলাসহ নিত্যপণ্য, নবাবপুরের ইলেকট্রিক ব্যবসা, মিটফোর্ডের ওষুধ মার্কেট, ইমামগঞ্জের পাইকারি বাজার, নয়াবাজারের কাগজের ব্যবসা, ইংলিশ রোডের রড ব্যবসা, দোলাইখালের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, বাংলাবাজারের পুস্তক ব্যবসা, সদরঘাটের কাপড় ব্যবসা এবং বংশালসহ হাজার হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে ডাকাত শহীদ চক্র।
বাংলাদেশ পোদ্দার সমিতির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক (নির্বাহী সদস্য) আসাদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ডাকাত শহীদ নিহত হয়েছে শুনে আমাদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি এলেও অজানা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তার সহযোগীরা আছে। আর নিহত ব্যক্তি ডাকাত শহীদ কি না সে সংশয়ও কাটছে না।'

No comments

Powered by Blogger.