ন্যাটোর রসদ সরবরাহের পথ খুলে দিল পাকিস্তান

পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে আফগানিস্তানে ন্যাটোর রসদ সরবরাহের পথ সচল করা নিয়ে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘ সাত মাসের বৈরিতা অবশেষে সমঝোতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। গত বছর ন্যাটোর বিমান হামলায় ২৪ পাকিস্তানি সেনা নিহত হওয়ার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন দুঃখ প্রকাশ করার পরপরই পাকিস্তান কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসে।


গত মঙ্গলবার রাতে রসদ সরবরাহের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। ওই পথ গতকাল বুধবার থেকেই চালু হওয়ার কথা ছিল। তবে পাকিস্তানি তালেবান রসদ সরবরাহের পথ চালু হওয়ামাত্রই পণ্যবাহী ট্রাকের ওপর হামলার হুমকি দিয়েছে।
রসদ সরবরাহের পথ খুলে দেওয়ার জন্য পাকিস্তান ন্যাটোর কাছে অতিরিক্ত কোনো শুল্ক বা আর্থিক সুবিধা দাবি করছে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য বাবদ ১১০ কোটি ডলার দেবে।
হিলারি গত মঙ্গলবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। এরপর এক বিবৃতিতে হিলারি বলেন, 'পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা এবং আমি দুজনেই সম্মত হয়েছি যে পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের নিহত হওয়ার ঘটনায় দুই পক্ষেরই ভুল ছিল। তাদের মৃত্যুর ঘটনায় আমরা দুঃখিত। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার ব্যাপারে এবং এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে_সে ব্যাপারে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। হিনা ন্যাটোর রসদ সরবরাহের পথ খুলে দেওয়ার খবর জানানোয় আমি খুশি।'
গত নভেম্বরে পাকিস্তানের আফগান সীমান্তবর্তী মোহমান্দ জেলায় ন্যাটোর হামলায় ২৪ পাকিস্তানি সেনা মারা যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান সরকার নিজ ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে ন্যাটোর রসদ সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা ও পণ্যবাহী ট্রাকপ্রতি উচ্চহারে শুল্ক দাবি করে। এসব শর্তকে পাস কাটিয়ে পথ খুলে দেওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানকে রাজি করাতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। চিঠি, ই-মেইল বা ফোনের পাশাপাশি উচ্চপর্যায়ের মার্কিন কর্মকর্তারাও দফায় দফায় পাকিস্তান সফর করেন। সম্মতি আদায়ের লক্ষ্যে গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় ন্যাটোর সম্মেলন শুরুর শেষ মুহূর্তে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারিকে আমন্ত্রণ জানায় তারা; কিন্তু পাকিস্তানকে তার অবস্থান থেকে সরাতে ব্যর্থ হয়।
রসদ সরবরাহের পথ খুলে দেওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সমঝোতায় পেঁৗছানোর বিষয়টি গত সোমবার থেকে আলোচনায় ছিল। আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর কমান্ডার জন আর অ্যালেন পাকিস্তানি সেনাপ্রধান আশফাক পারভেজ কায়ানির সঙ্গে বৈঠক করেন। এর পরই সমঝোতায় পেঁৗছানোর তথ্য জানান তাঁরা। তবে হিলারির ফোনের পরই আনুষ্ঠানিকভাবে অবরোধ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেয় পাকিস্তান। পাকিস্তানি তথ্যমন্ত্রী কামার জামান কাইরা বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি আমাদের নীতিগত অবস্থানকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা নমনীয়তা দেখিয়েছে।' পথ খুলে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো আর্থিক শর্ত আরোপ না করার ব্যাপারে তিনি বলেন, 'এটা অর্থের ব্যাপার নয়, বরং আমাদের সার্বভৌমত্বের বিষয়।' পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, 'রসদ সরবরাহ পথ আবার চালুর ফলে আফগানিস্তান থেকে ন্যাটোর সেনা প্রত্যাহারের কাজ ত্বরান্বিত হবে এবং তা পাকিস্তানের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হবে।'
পথ খুলে দেওয়ার শর্ত হিসেবে পাকিস্তান এর আগে ট্রাকপ্রতি পাঁচ হাজার ডলার শুল্ক দাবি করেছিল। কিন্তু সমঝোতা অনুযায়ী অবরোধ জারির আগের হার, ট্রাকপ্রতি ২৫০ ডলার শুল্কই কার্যকর থাকছে। পুরনো পথ চালু হওয়ায় প্রতি মাসে ন্যাটোর ১০ কোটি ডলার খরচ কমে যাবে। অবরোধ চলার সময় রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো হয়ে বিকল্প পথে আফগানিস্তানে রসদ সরবরাহের চেষ্টা করছিল তারা। পাকিস্তান অবরোধ তুলে নেওয়ায় বড় ধরনের খরচের হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে ন্যাটো।
পাকিস্তানি তালেবানের হুমকি : পাকিস্তান সরকার ন্যাটোর রসদ সরবরাহের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই হুমকি দিয়েছে পাকিস্তানি তালেবান। তাদের মুখপাত্র এহসানুল্লাহ এহসান বলেন, 'কোনো ট্রাককেই আফগানিস্তানে যেতে দেওয়া হবে না। আমরা শুধু ট্রাকেই নয়, চালকদের ওপরও হামলা চালাব।' পথ খোলার ঘোষণা আসার পর সীমান্তে অপেক্ষমাণ ট্রাকচালকরা আনন্দ শুরু করেন। কিন্তু তালেবানের হুমকি তা থামিয়ে দেয়। তাঁরা সরকারকে এ ব্যাপারে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
ধর্মীয় দলগুলোর আপত্তি : পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো ন্যাটোর রসদ সরবরাহের পথ খোলার সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছে। জামিয়াত উলেমা-ই-ইসলাম দলের প্রধান মাওলানা ফজলুর রেহমান জানান, অবরোধ তুলে নেওয়ার অধিকার শুধু পার্লামেন্টেরই আছে। প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী কেউই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। জামায়াত-ই-ইসলামীর আমির সৈয়দ মুনাওয়ার হাসান বলেন, 'শত্রুদের শক্তিশালী করার এই সিদ্ধান্ত জাতি কখনোই ক্ষমা করবে না।' এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে পাকিস্তান সরকার দুর্বলতার প্রমাণ রেখেছে বলেও সমালোচনা হচ্ছে। সূত্র : এএফপি, বিবিসি, ডন।

No comments

Powered by Blogger.