পবিত্র লাইলাতুল বরাত-মহিমান্বিত রজনী by মাওলানা মোহাম্মদ নূরুল মোস্তফা

'শবেবরাত' বা 'লাইলাতুল বরাত' একটি বরকতময় ও পুণ্যময় রজনী। কোরআন-সুন্নাহ এবং ইসলামের মনীষী ও ফকিহদের মতামতের ভিত্তিতে শবেবরাত অকাট্যভাবে প্রমাণিত বরকতমণ্ডিত, সৌভাগ্যময় ও সমৃদ্ধিশালী রাত। এই রাতে ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আজকার ইত্যাদি অত্যন্ত পুণ্যময়।
মানবজাতির মুক্তির লক্ষ্যে মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে কিছু উপলক্ষ দেওয়া হয়েছে। কিছু দিবস ও রজনী এমন মহিমান্বিত যে ওই দিনগুলোতে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালে অতীত জীবনের পাপরাশি মোচন হয়, সব পঙ্কিলতা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। এমনই একটি রজনী পবিত্র শবেবরাত। বছরের অন্যতম সেরা বরকতময় রজনী শবেবরাতে আল্লাহর কাছে যা কিছুই চাওয়া হয়, যত কামনা-বাসনা বান্দার পক্ষ থেকে পেশ করা হয়, মহান আল্লাহ পাক দয়াপরবশ হয়ে তা কবুল করবেন নিঃসন্দেহে- এ আশা পোষণ করা যায়। শবেবরাত তাই মুসলমানদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ অনুগ্রহের এবং মুক্তির রজনী। এই দিনটিকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানানোর মাধ্যমে পূত-পবিত্র হওয়ার প্রয়াসী হতে হবে সব মুমিন মুসলমানকে।
শবেবরাত কী
'শব' শব্দটি ফার্সি, যার অর্থ রাত। আর 'বরাত' আরবি শব্দ, যার অর্থ পবিত্রতা, মুক্তি, উদ্ধার, আশ্রয়, অব্যাহতি, নিষ্কৃতি, দায়মুক্তি, বণ্টন, বরাদ্দ ইত্যাদি। সুতরাং শবেবরাত বা লাইলাতুল বরাতের অর্থ হবে- বণ্টন, বরাদ্দ বা পবিত্রতা অথবা নাজাত ও পরিত্রাণের রাত। মূলত যুগ, কাল, মাস, দিন, রাত, ক্ষণ- এককথায় প্রতিটি সময় মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালারই সৃষ্টি এবং সবই বরকতময়। এতদসত্ত্বেও কিছু মাস, দিন ও রাতকে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা অন্য মাস, দিন এবং রাতের ওপর বরকত ও সওয়াব অর্জনের জন্য গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মর্যাদার দিক দিয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন। যেমন- মাসগুলোর মধ্যে পবিত্র রমজানকে, সপ্তাহের দিনগুলোর মধ্যে পবিত্র জুমার দিবসকে, রাতগুলোর মধ্যে পবিত্র শবেকদর, শবেবরাত, দুই ঈদের রাত ও জুমার রাত ইত্যাদিকে মর্যাদাবান করেছেন। কিন্তু সব মাখলুকাতের মধ্যে প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সর্বোৎকৃষ্ট মাখলুক হিসেবে তাঁর শুভাগমনের রাত মুবারকটি খোদা প্রদত্ত বিশেষ রাতগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান রাত, যেহেতু তাঁর শুভাগমনের বিনিময়ে আমরা শবেবরাত, শবেকদর, দুই ঈদের রাত, জুমা এবং আরাফার রাতসহ শ্রেষ্ঠ বরকতময় রাতগুলো পেয়েছি। (তাফসিরে রুহুল মায়ানি, ষোলো খণ্ড, পৃ- ৩৪৮)
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক শবেবরাতকে 'লাইলাতুম মুবারাকা' অভিহিত করে বরকতময় রাত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।
শবেবরাতের তারিখ
এই পবিত্র বরকতময় রাত শাবান মাসের ১৪ তারিখ সন্ধ্যা থেকে আরম্ভ হয়ে সুবহে সাদিক (আজ বৃহস্পতিবার মাগরিবের আজানের পর) থেকে ফজর পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে।
শবেবরাতের ফজিলত, গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব অনেক। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ কোরআনের সুরা আদ-দুখানের শুরুতেই ইরশাদ করেছেন- 'হা-মীম! শপথ ওই সুস্পষ্ট কিতাবের। নিশ্চয়ই তা আমি অবতীর্ণ করেছি বরকতময় রাতে।' তাফসিরে কাশ্শাফ, তাফসিরে কাবিরসহ ইত্যাদি তাফসির গ্রন্থে এই আয়াতের 'লাইলাতুম মুবারাকা'কে মুফাসসিরিনে কিরাম শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত অর্থাৎ 'লাইলাতুল বরাত' বা শবেবরাত বলে মত প্রকাশ করেছেন। এই মহিমান্বিত রজনীকে লাইলাতুল বরাত, লাইলাতুল সা-ইক, লাইলাতুম মুবারাকা এবং লাইলাতুল রহমতও বলা হয়। হজরত ইকরামাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু 'লাইলাতুল বরাত' বলেও উল্লেখ করেছেন। হাদিসের আলোকে ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- 'যখন শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত আসে, তখন ওই রাতে তোমরা (ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে) রাত জাগরণ করো এবং দিনে রোজা রাখো। কেননা আল্লাহ পাক সূর্যাস্তের পর এই রাতে প্রথম আসমানে তাঁর জালওয়া বিচ্ছুরিত করেন এবং ঘোষণা করেন- 'কে আছ আমার কাছে স্বীয় গুনাহ্র ক্ষমাপ্রার্থী? আমি তার গুনাহ ক্ষমা করে দেব। কে আছ রিজিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিজিক দান করব। কে আছ আরোগ্যের আবেদনকারী? আমি তাকে (রোগ থেকে) মুক্ত করব। কে আছ অমুক প্রার্থী, কে আছ অমুক প্রার্থী- এভাবে সুবহে সাদিক হওয়া পর্যন্ত (ডাকতে থাকেন)'। বিশিষ্ট সাহাবা সায়িদ্যুনা হজরত মু'আয ইবনে জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- 'আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে স্বীয় মাখলুকের দিকে রহমতের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, মুশরিক এবং অন্তরে বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সব মাখলুককে ক্ষমা করে দেন। আমিরুল মুমিনীন খলিফাতুল মুসলিমীন সায়্যিদুনা সিদ্দীক-ই-আকবর হজরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান- 'শাবান মাসের রজনীতে আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে আগমন করেন এবং আপন বান্দাদের ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মুশরিক এবং নিজ ভাইয়ের সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণকারীকে ক্ষমা করেন না।' হজরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'শাবানের মধ্য রাতে প্রিয়নবী (সা.) আমার হুজরা শরিফ থেকে গভীর রাতে বিছানা ত্যাগ করে উঠে গেলেন। আমি ধারণা করলাম, প্রিয়নবী হয়তো অন্য কোনো বিবির কাছে তাশরিফ নিয়ে গেছেন। তাই আমি তাঁর খোঁজে যেতে চাইলে একপর্যায়ে আমার হাত তাঁর পা মুবারক স্পর্শ করে। তখন আমি বুঝতে পারলাম, তিনি নামাজের সিজদায় আছেন।' হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বলেন, 'প্রিয়নবী (সা.) ওই রাতে সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত ইবাদত-বন্দেগিতেই লিপ্ত ছিলেন। অধিক ইবাদতের ফলে তাঁর মুবারক পদযুগল ফুলে গেলে আমি তাঁর পা মুবারক টিপতে টিপতে আরজ করলাম- (আমার মাতা-পিতা আপনার তরে উৎসর্গিত হোক) আল্লাহ তায়ালা কি আপনার উম্মতের পূর্বাপর সব পাপরাশি ক্ষমা করে দেননি। প্রিয়নবী উত্তরে ইরশাদ ফরমালেন, হে আয়েশা, আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী বান্দা হব না। আয়েশা, তুমি কি জানো, আজ কোন রাত? আমি বললাম, দয়া করে আপনি বলুন। প্রিয়নবী উত্তর দিলেন, এই পুণ্যময় রজনীতে আগামী এক বছর যেসব সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে, তাদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। আর এই এক বছরে যেসব মানুষ মৃত্যুবরণ করবে, তাদের নামও তালিকাভুক্ত করা হয়। এই রাতে মানবজাতির আমলনামা সৃষ্টিকর্তার কাছে উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং এই রাতেই আল্লাহ্র কাছ থেকে সৃষ্টির রিজিক বণ্টন করা হয়।' ইমাম আব্দুর রায্যাক 'মুসনাদে আব্দুর রায্যাক'-এ কিতাবুস সিয়াম, বাবুন নিস্ফ মিন শাবান অধ্যায়ে একটি হাদিস বর্ণনা করেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এমন পাঁচটি রাত আছে, যেগুলোতে দোয়া ফেরত হয় না। ওইগুলো হলো- ১. জুমার রাত, ২. রজব মাসের প্রথম রাত, ৩. শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত অর্থাৎ আজ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত, ৪. ঈদুল ফিতরের রাত, ৫. ঈদুল আজহার রাত।
বরাত রজনীতে আমাদের করণীয়
বরাতের পুণ্যময় রজনী বছরে একবারই আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে মুক্তি, ক্ষমা ও পুরস্কারের বার্তা নিয়ে। প্রিয় পাঠক, চাঁদ দেখা রাতের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে ইবাদতে মশগুল থাকা। বিশুদ্ধ অন্তঃকরণে একাগ্রচিত্তে মহান রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জনের মানসে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে এই বরকতময় রজনী অতিবাহিত করা মুসলিম নর-নারীর একান্ত কর্তব্য।
আমাদের প্রিয়নবী সরকারে-কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- রাতের শেষ ভাগে হজরত জিবরাইল আলাহিস সালাম আমার কাছে এসে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি দয়া করে আপনার নূরানি শির মুবারক আকাশপানে উত্তোলন করুন। আমি আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম এবং দেখতে পেলাম, বেহেশতের দরজাগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। প্রথম দরজায় একজন ফেরেশতা উচ্চ স্বরে ঘোষণা করছে- ওই ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ, যে ব্যক্তি আজ রাতে রুকু করছে। দ্বিতীয় দরজায় আরেক ফেরেশতা ঘোষণা করছে- সুসংবাদ ওই ব্যক্তির জন্য, যে আজ রাতে সিজদা করছে। তৃতীয় দরজায় আরেক ফেরেশতা বলছে- সুসংবাদ ওই ব্যক্তির জন্য, যে আজ রাতে মুনাজাত করছে। চতুর্থ দরজায় আরেকজন ফেরেশতা ঘোষণা করছে- সুসংবাদ ওই ব্যক্তির জন্য, যে আজ রাতব্যাপী আল্লাহর জিকির-আজকার করছে। পঞ্চম দরজায় আরেকজন ফেরেশতা সুসংবাদ প্রদান করছে তাদের জন্য, যারা আল্লাহর ভয়ে আজ রাতে আরামের ঘুম হারাম করে রাত জাগরণ করছে। ষষ্ঠ দরজায় আরেক ফেরেশতার ঘোষণা- সব ইমানদারের জন্য আজ আনন্দের রাত, নিয়ামত ও বরকতে পূর্ণ রাত। সপ্তম দরজায় আরেকজন ফেরেশতা চিৎকার করে ঘোষণা দিচ্ছে- আজ রাতে প্রার্থনাকারী কেউ আছ কি? তার সব দোয়া-মোনাজাত কবুল করা হবে। অষ্টম দরজায় আরেকজন ফেরেশতা ঘোষণা করছে_আপন গুনাহ ক্ষমা চাইবে, এমন কেউ আছে কি? আজকের এই পুণ্যময় রাতে করুণাময় আল্লাহ সব বান্দার গুনাহ মাফ করে দেবেন, আলহামদুলিল্লাহ।
আমল
শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে গোসল করে অজুসহকারে দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল অজু নামাজ পড়বেন। প্রতি রাকাতে সুরা ফাতিহার পর আয়াতুল কুরসি একবার এবং সুরা ইখলাস ১৫ বার করে পড়বেন। সালাম ফেরানোর পর দরূদ শরিফ ১০০ বার পড়ে রিজিক (জীবিকা) বৃদ্ধির জন্য দোয়া করবেন। ইনশাআল্লাহ রিজিক বৃদ্ধি পাবে। এই পুণ্যময় রাতে যাদের মা-বাবা নেই, তাদের নাজাতের জন্য দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে তাদের মাগফিরাতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন।
যাদের মা নেই, তাদের জীবন বড় দুঃখের, বড় যাতনার। আর এ জন্য সেটা এত কষ্টের যে,ওই মা-বাবা না থাকার জন্য কাউকে অভিযোগ করারও নেই। আল্লাহ ওই সব মা-বাবাহারা সন্তানদের দোয়া কবুল করুক, আমিন। মহান আল্লাহ আমাদের কল্যাণের এই শ্রেষ্ঠ রাতে কোরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ-তাহ্লিল, জিকির-আজকার, নামাজ, দোয়া-দরূদ শরিফ পাঠ এবং পিতা-মাতাসহ মরহুম আত্মীয়স্বজনদের কবর জিয়ারত ইত্যাদি ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করার তাওফিক দান করুন।

No comments

Powered by Blogger.