ইতিউতি-অস্থির আফ্রিকার শিক্ষা by আতাউস সামাদ

মিসরের শাসক হোসনি মুবারক গতকাল শুক্রবার ভোরে আবারও বললেন যে তিনি আগামী সেপ্টেম্বরের আগে ক্ষমতা ত্যাগ করবেন না। তিনি এর আগে একই কথা একটু ঘুরিয়ে বলেছিলেন এভাবে_আগামী সেপ্টেম্বরে মিসরে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য যে নির্বাচন হবে, তিনি তাতে প্রার্থী হবেন না।


তাঁর কথার অর্থ ছিল, তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করবেন, তবে সেপ্টেম্বরে নির্বাচিত নতুন প্রেসিডেন্টের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের মাধ্যমে। সোজা কথা, তিনি একজন বিতাড়িত বা পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত হতে চান না।
কিন্তু হোসনি মুবারকের বিরোধীরা তিন সপ্তাহ ধরে কায়রোর তাহরির স্কয়ার ও অন্যান্য শহরে বিশাল জনসমাবেশ করছেন। তাঁরা চান এই প্রেসিডেন্ট এখনই গদি ছাড়ুন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে মুবারককে ক্ষমতা ছাড়তে বলেছেন। কিন্তু তবুও হোসনি মুবারক টলছেন না, যদিও তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে বর্ণিত তাঁর ছেলে এবং অন্য আত্মীয়স্বজন মিসর ছেড়ে গেছেন ইতিমধ্যে।
তাহলে ৮২ বছর বয়স্ক এই সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান, যিনি ৩০ বছর ধরে মিসর শাসন করছেন তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছেন কেন? এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে অর্থাৎ মুবারক বারবার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন এমন এক রাজনৈতিক পদ্ধতিতে, যাতে মাত্র একজনই প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচিত হওয়ার জন্য দাঁড়াতে পারতেন। ২০০৫ সালে একাধিক প্রার্থী প্রতিযোগিতা করার ব্যবস্থা থাকলেও এমন সব বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়, যাতে অন্য কোনো জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনে না দাঁড়াতে পারেন। দ্বিতীয়ত, মিসরে ১৯৮০ সাল থেকে জরুরি অবস্থা জারি রয়েছে। তৃতীয়ত হোসনি মুবারক তাঁর দীর্ঘ স্বৈরশাসনামলে ব্যক্তিগতভাবে ও তাঁর আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে দুর্নীতি করিয়ে বিশাল বৈভবের মালিক হয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবিসি নিউজ জানায়, এই সম্পদের পরীমাণ ৪০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৭০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। চতুর্থত, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইসরায়েল প্রতিবেশী মিসরের রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে হোসনি মুবারকের জায়গায় কাকে ক্ষমতায় বসাতে চায়, সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। মোবারকের আগে রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত মিসরকে তৎকালীন সোভিয়েত প্রভাব-বলয় থেকে বের করে এনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে দুই রাষ্ট্রই সফর করেন। তিনি নিহত হওয়ার পর হোসনি মুবারক তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে মিসরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের অনুগত মিত্রে পরিণত করেন। পঞ্চমত, হোসনি মুবারকের শাসনামলে মিসরের সশস্ত্রবাহিনী দেশ শাসনে তাদের প্রভাব বাড়িয়েছে এবং বহু সামরিক অফিসার এই প্রভাবের মাধ্যমে দুর্নীতি করে ধনী হয়েছেন। হোসনি মুবারক একটি বেসামরিক ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীও সৃষ্টি করেছেন। এখন তিনি প্রচণ্ড গণরোষের মুখেও ক্ষমতা ত্যাগ করছেন না কেন, তার সম্ভাব্য উত্তর উলি্লখিত উপাদানগুলোর মধ্যে খোঁজা যেতে পারে।
প্রথমত, মিসরের সশস্ত্রবাহিনী ও ধনী সমাজ নিশ্চিত করতে চাইছে যে হোসনি মুবারক ক্ষমতা ত্যাগ করলেও তাঁর জায়গায় এমন একজন বসবেন, যিনি তাদের গোষ্ঠীস্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখবেন ও সেগুলো রক্ষা করবেন। হয়তো এমন ব্যক্তি বাছাই করার লক্ষ্যে প্রাসাদ রাজনীতির-প্রক্রিয়া এখনো পূর্ণ হয়নি। তাই হোসনি মুবারককে বসিয়ে রাখতে হবে। আর তিনিও তাঁর নিজস্ব নিরাপত্তা ও তাঁর বিশাল ধন-দৌলত নিরাপদ জায়গায় পাচার সম্পন্ন করার জন্য এই খেলায় অংশ নিচ্ছেন। এখানে লক্ষণীয় যে মোবারক যে ব্যক্তিকে নতুন উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়েছেন, তিনি মিসরে ৩০ বছর ধরে চলে আসা জরুরি অবস্থা জারি রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুখে যা-ই বলুক, তারা ভেতরে ভেতরে মিসরের বর্তমান অত্যাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকেই সমর্থন করছে। আর এটা তাদের করতেই হবে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ইরান ও আল-কায়েদার বিরুদ্ধে মার্কিন-ব্রিটিশ-ফরাসি ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ চালানোর নামে তারা মিসরকে তাদের নিজস্ব আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান আইনের দরুন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ যেসব সন্দেহভাজনদের নিজ দেশে তাদের মতো যথেষ্ট শারীরিক নির্যাতন করতে পারত না, তাদের যে কটি অন্য দেশে চালান করে সেখানে নির্যাতন করত, তার একটি হলো মিসর। আমেরিকায় এই বন্দি চালান প্রক্রিয়ার নাম ৎবহফরঃরড়হ (রেন্ডিশন)। আর মিসর সেসব লোককে এভাবে তাদের হাতের মুঠোয় পেতে চাইত, যাঁরা হোসনি মুবারক বা তাঁর সরকারের বিরোধিতা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই জঘন্য, অমানবিক, বেআইনি, মানবাধিকারবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক অপরাধের বিস্তারিত বিবরণ কয়েক কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল বিখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন নিউইয়র্কারে। পুলিৎজার-বিজয়ী অনুসন্ধানী সাংবাদিক সেইমুর হার্স এটি লিখেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গোপন স্বার্থ রয়েছে মিসরে। কোনো গণতান্ত্রিক-প্রক্রিয়া ও শক্তি এসে সেসব গুটিয়ে দেবে_ওয়াশিংটন তা মেনে নেওয়ার মতো নরম, সরল বা নীতিবান কোনোটাই নয়। আর ইসরায়েল তো প্রকাশ্যেই বলে দিয়েছে যে মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড দলটি ক্ষমতায় আসুক_এমনকি নির্বাচনের মাধ্যমে, তা-ও তারা মেনে নেবে না। কাজেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুই দিক থেকেই মিসরে বহু প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়েছে বলে মনে হচ্ছে এ লেখার সময় পর্যন্ত (১১.০২.১১ সকাল)। আর আগে যা বলেছি, হোসনি মুবারক সম্ভবত তাঁর অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ অপসারণের নিশ্চয়তা খুঁজছেন এবং কালক্ষেপণ করে যদি মসনদে থাকা যায়, সেই দুরাশাও করছেন। তিনি আদতেই খুব ধূর্ত ও নৃশংস।
তাহলে এই যে মিসরজুড়ে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ, তা সম্ভব হলো কিভাবে? মিসর থেকে যেসব খবর আসছে ও নির্বাসিত মিসরীয় নেতারা অন্য জায়গা থেকে যা বলছেন, তা হলো যে মিসরে এবার স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে এবং তার প্রধান কারণ হলো, অসহনীয় মূল্যস্ফীতি। লন্ডনের এক বিনিয়োগ গবেষক বলেছেন, মিসরে মূল্যস্ফীতির হার এ মুহূর্তে সম্ভবত ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি। মিসরে গরিব লোকের সংখ্যা বেশি, এমনকি শিক্ষিতদের মধ্যেও। তারা এবার পেটের দায়ে শান্তিপূর্ণ বিদ্রোহে নেমেছে। দ্বিতীয়ত, মিসরে এখন বেকারত্ব ব্যাপক। একদিকে খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের গগনচুম্বী মূল্যস্ফীতি, আর অন্যদিকে বেকারত্বের জন্য আয়ের অভাব। এ দুই মিলে সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত করে ফেলেছে। কাজেই মিসরে জনগণের এবারের আন্দোলন অনেকের জন্যই এক জীবন-মরণ প্রশ্ন। সম্ভবত সে কারণেই সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত জনগণকে সরাসরি আক্রমণ করেনি। তৃতীয়ত, হোসনি মুবারক, তাঁর আত্মীয়স্বজন ও মিলিটারি এস্টাবি্লশমেন্টের দুর্নীতি এবং ওইসব লোকের আয়েসি ও চাকচিক্যময় জীবনযাত্রা সে দেশের সাধারণ মানুষকে খুবই বিরক্ত করে তুলেছে। আর এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করার আকাঙ্ক্ষা, যার মধ্যে অন্যতম মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবিটি। দেশে এবং বিদেশে মিসরীয় চিন্তাবিদ ও পণ্ডিতরা তাই এবারের আন্দোলনকে বারবার বর্ণনা করছেন 'মুক্তির সংগ্রাম' হিসেবে। তাঁরা এ জন্য ইংরেজি যে শব্দটি ব্যবহার করছেন তা হচ্ছে 'ঋৎববফড়স'। তাঁরা মুবারক ও দলবলের হাত থেকে মুক্তি চাইছেন গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাজুড়েই এই আন্দোলনের বাতাস বইছে। আলজেরিয়া দিয়ে শুরু, তিউনিসে তুঙ্গে ওঠা সেই ঝড়ের গতিপথ নিয়ে অনেকেই চিন্তিত।
এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, তা হলো আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বহু বছর ধরে ক্ষমতায় থেকেছেন এমন শাসক বা রাষ্ট্রনায়কদের প্রায় কেউই দেশের মঙ্গল করতে পারেননি, বরং ক্ষতিই করেছেন। যেমন_জুলিয়াস নায়ারে প্রথমে তাঙ্গনিয়াকা ও পরে তানজানিয়ার শাসক ছিলেন ১৯৬১ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত ২৪ বছর। এই সময়ের মধ্যে একদলীয় শাসন ও তার সৃষ্ট অদ্ভুত এক অর্থনীতির প্রচলন করে একদা সমৃদ্ধ দেশটিকে অনুৎপাদন ও দারিদ্র্যের গভীর খাদে ফেলেছেন। উগান্ডায় ইদি আমিন ক্ষমতা দখল করে যে আট বছর রাজত্ব করেন, সেই সময় দেশটিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক নির্যাতন, জাতিগত নিপীড়ন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, স্বজনপ্রীতি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থা গেড়ে বসে। মজার ব্যাপার হলো, প্রথমে ব্রিটেন এবং পরে ব্রিটেনের কথিত শত্রু মুয়াম্মার গাদ্দাফির লিবিয়া ইদি আমিনকে সমর্থন করত। ইদি আমিনের আগে ও পরে যে মিল্টন ওবোতে দুই দফায় ১৪ বছর উগান্ডা শাসন করেছেন, তাঁর দ্বিতীয় শাসনামল স্বেচ্ছাচারিতায় রূপ নিয়েছিল। তিউনিসিয়ায় জাইন এল আবিদিন বেন আলী এক প্রাসাদ ষড়ন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে ২৩ বছর দেশ শাসন করে দেশটিকে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে ডুবিয়েছেন। তিনি এক গণ-আন্দোলনের জোয়ারে গত মাসে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হন। তিউনিসিয়ার জনগণ এখন গণতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির পুনর্গঠন করতে চাইছে। এদিকে জোসেফ মবুতুর দীর্ঘ ২৬ বছরের নৃশংস এবং অপশাসনের ফলে খনিজসম্পদে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ কঙ্গোর মানুষ আজ দুনিয়ার দরিদ্রতমদের মধ্যে বলে গণ্য হচ্ছে। অর্থাৎ কোনো দেশে কারো শুধু দীর্ঘস্থায়ী শাসন (বিশেষত সেনা শাসকদের ক্ষেত্রে) সে দেশের উন্নতি, সমৃদ্ধি ও শান্তি নিশ্চিত করে না। নির্বাচিত সরকারগুলোর বেলায়ও গণতন্ত্রের সুফল পাওয়া যায় না, অর্থনীতি অগ্রসর হয় না এবং দেশে স্থিতিশীলতা আসে না_যদি নির্বাচিতরা গোষ্ঠীতন্ত্র, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি কায়েম করেন এবং আইনের বদলে গায়ের জোরে ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। আর সেই সঙ্গে তাঁরা পরাশক্তি ও বৃহৎ শক্তিদের তাঁবেদারি করলে দেশটির সার্বিক সর্বনাশ হয়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.