চারদিক-মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় নাট্যোৎসবে by সুজাত শিমুল

ধোয়ামোছা আর চুনকাম করা দেখেই বোঝা গিয়েছিল, কিছু একটা হতে যাচ্ছে জাতীয় নাট্যশালায়। নাট্যশালার ভেতর-বাইরে বেশ ঝকঝকে, তকতকে হয়ে উঠেছে। পরিচিত অপরিচ্ছন্নতা কেটে গেল কেন, তা নিয়ে ভাবতে হলো না বেশি দিন। মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় নাট্যোৎসব হচ্ছে বলেই নতুন সাজে সেজেছে শিল্পকলার নাট্যশালা।


নাট্যশালার প্রবেশপথে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ, যাঁর আশপাশটাও কিছুটা বিধ্বস্ত, যা দেখে দর্শকেরা হঠাৎ থমকে যায় খানিকটা। কিন্তু ভালো করে দেখলেই বোঝা যায়, ওটা মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত একটি ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধের নাটক দেখার আগে যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের জীবনচিত্রের অনুভূতি হূদয়ে নিয়ে নাটকের হলে প্রবেশ করছে দর্শকেরা—বেশ চমৎকার ধারণা।
নব্বইয়ের দশকে হঠাৎ করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক নিয়ে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধের নাট্যোৎসব। উৎসবে অংশ নেয় বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সদস্য ও নাট্যদলসমূহ। সময় যেতে থাকে, বিস্মৃতি হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাট্যচর্চা।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আবারও শুধু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাট্যোৎসব। তবে এবারের আয়োজনের পরিধিটা আরও ব্যাপক। ১৩ দিনব্যাপী এই নাট্যোৎসবের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী। এই নাট্য আয়োজনে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। স্বাধীনতার ৪০ বছর ও শিল্পের আলোয় মহান মুক্তিযুদ্ধ স্লোগানে এই উৎসবের নাম দেওয়া হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় নাট্যোৎসব’। ২ জুলাই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালায় নাট্যোৎসবের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথমবারের মতো দেশের প্রতিটি জেলার কলেজ পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচিত ১০টি জেলায় জেলা শিল্পকলা একাডেমী থেকে নির্মিত হয়েছে আরও ১০টি নাটক। কলেজ পর্যায়ের নাটকসমূহ, জেলা শিল্পকলা একাডেমীর নাটকগুলোসহ বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সদস্যভুক্ত বিভিন্ন নাট্যদলের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকের প্রদর্শনী হচ্ছে এই নাট্যোৎসবে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালা, এক্সপেরিমেন্টাল হল এবং স্টুডিও থিয়েটার হলে প্রতিদিন যথাক্রমে সন্ধ্যা ছয়টা, সাতটা ও আটটায় প্রদর্শনী হচ্ছে উৎসবের নাটকসমূহের। এ ছাড়া প্রতিদিন প্রদর্শনী হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আবৃত্তি, সংগীত, মূকাভিনয়, নৃত্যনাট্য ও যাত্রাপালা। প্রতিদিন বিকেল গড়াতেই নাট্যমোদী, দর্শক ও সংবাদকর্মীদের ব্যাপক সমাগম লক্ষ করা যায় জাতীয় নাট্যশালা এলাকাজুড়ে। নেই জাতীয় নাট্যশালায় আগের সেই চেহারা।
উৎসবের উদ্বোধনী দিনে পাঁচটা ১৫ মিনিটে জাতীয় নাট্যশালায় লোকনাট্যদল সিদ্ধেশ্বরী মঞ্চায়ন করে নাটক মুজিব মানে মুক্তি। সন্ধ্যা সাতটায় একই মঞ্চে হবিগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমী প্রদর্শনী করে জ্যোতিসংহিতা নাটকের। একই সময়ে প্রাচ্যনাটের সার্কাস সার্কাস নাটকের প্রদর্শনী হয় এক্সপেরিমেন্টাল হলে। স্টুডিও থিয়েটার হলে প্রদর্শনী হয় কুমিল্লা, মেহেরপুর ও ঝিনাইদহের কলেজ পর্যায়ের তিনটি নাটকের। জাতীয় সংগীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে প্রদর্শন করা হয় ভোলা, রাজশাহী, ফরিদপুরের কলেজ পর্যায়ের আরও তিনটি নাটক।
বিভিন্ন জেলা ও কলেজ পর্যায় থেকে যাঁরা নাটকের প্রদর্শনী করতে এসেছেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে মনটা বেশ খারাপ হয়েছিল। কারণ, এই নাটকগুলো উৎসবে প্রদর্শনীর পর পুনরায় আর কখনো মঞ্চের আলো পাবে কি না সন্দেহ রয়েছে। কেননা সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে এ নাটকগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। আবার প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কোনো অর্থ তাঁদের দেওয়া হবে না। নাটকগুলোর একাধিক প্রদর্শনীর খরচের টাকা বরাদ্দের দাবি জানালেন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা নাট্যকর্মীরা।
উৎসবের কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা জসিমউদ্দীন জানালেন, ৬৪টি জেলার ৬৪টি কলেজের নাটক ছাড়াও ১০টি জেলার শিল্পকলা একাডেমী প্রযোজিত নাটক, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত দল, রেপার্টরি নাট্যদলসমূহ মোট ১০২টি নাটকের প্রদর্শনী হচ্ছে এই নাট্যোৎসবে। নাটকের দর্শনিমূল্য না থাকার কারণে প্রতিদিন নাটক দেখতে ভিড় করছে বিভিন্ন বয়সের নাট্যমোদী দর্শক। জাতীয় নাট্যশালার লবিতে দেখা হলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর সাবেক পরিচালক গোলাম সারোয়ারের সঙ্গে। তিনি জানালেন, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক নিয়ে শিল্পকলার আয়োজনে এটাই প্রথম বড় আয়োজন। সরকারের সহযোগিতা বহাল থাকলে ভবিষ্যতেও এর চেয়ে অনেক বড় উৎসবের আয়োজন করা সম্ভব হবে। উৎসব চলবে ১৪ জুলাই পর্যন্ত।
কথা হলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলীর সঙ্গে। বললেন, ‘স্বাধীনতার ৪০ বছর ও শিল্পের আলোয় মহান মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের নাট্যোৎসবটির আয়োজন করেছি। অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল, তার পরও আমরা সারা দেশের বিভিন্ন কলেজ পর্যায় এবং জেলা পর্যায়ে নাটক নির্মাণের ব্যবস্থা করেছি। আমরা চাই, নতুন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করতে।’
শিল্পকলা একাডেমী এখন নাটকে নাটকে ভরপুর। আপনিও দেখে আসতে পারেন নিজের পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো নাটক।
সুজাত শিমুল

No comments

Powered by Blogger.