যেভাবে 'মৃত্যুফাঁদে' ডাকাত শহীদ by রেজোয়ান বিশ্বাস

প্রায় দুই দশক ধরে পুরান ঢাকার অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণকারী দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ডাকাত শহীদ র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। কিন্তু এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে তার শতাধিক ক্যাডার সন্ত্রাসী। এই দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীকে পাকড়াও করতে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নসহ (র‌্যাব) দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী


দীর্ঘদিন ধরেই তৎপরতা চালিয়ে আসছিল। অবশেষে র‌্যাব সফল হয়েছে। জীবিত ধরতে না পারলেও এই কুখ্যাত খুনি-চাঁদাবাজ আর কোনো দিন কোনো মায়ের বুক খালি করার সুযোগ পাবে না।
র‌্যাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, দীর্ঘদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিতে পারলেও সর্বশেষ গত সপ্তাহে র‌্যাবের ফাঁদে পা দেয় ভয়ংকর সন্ত্রাসী ডাকাত শহীদ। সহযোগীদের ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমেই র‌্যাব নিশ্চিত হয় ডাকাত শহীদের গতিবিধি। তার অবস্থান সম্পর্কে চূড়ান্ত খবর সংগ্রহে মাঠে নামে র‌্যাবের চারটি গোয়েন্দা দল। আধুনিক ট্র্যাকিং প্রযুক্তির সহায়তায় র‌্যাব নিশ্চিত হয়েই মঙ্গলবার রাতে চূড়ান্ত অভিযানে নামে। আর মাঝরাতেই মিলে যায় সাফল্য।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক এম সোহায়েল কালের কণ্ঠকে বলেন, র‌্যাবের ধারাবাহিক অভিযানের মুখে ডাকাত শহীদ ২০০৫ সালে সপরিবারে ভারতে পাড়ি জমায়। এরপর ভারত ও নেপালে বসেই পুরান ঢাকায় চাঁদাবাজি, হত্যাকাণ্ডসহ অপরাধ-জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। তার হয়ে এসব অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায় শতাধিক নৃশংস সহযোগী। ডাকাত শহীদ দুই মাস আগে ভারত থেকে দেশে ঢুকে সহযোগীদের নিয়ে মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করে। তিন দিন আগে সে আসে পুরান ঢাকায়। একান্ত সহযোগী কাঞ্চি ও কালুসহ আত্মগোপন করে সদরঘাট-সংলগ্ন এলাকায়।
র‌্যাবের ইনটেলিজেন্স উইং পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, ডাকাত শহীদ দলবল নিয়ে পুরান ঢাকায় অবস্থান করার খবর নিশ্চিত হয়েই অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়। মঙ্গলবার রাতে সহযোগীদের নিয়ে ডাকাত শহীদ লক্ষ্মীবাজারে ঢুকবে- এমন খবর পেয়ে র‌্যাব সদস্যরা 'ফাঁদ' পেতে অবস্থান নেন। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তার অবস্থান ঘিরে র‌্যাবের একাধিক চেকপোস্ট বসানো হয়। রাত ১২টার দিকে শহীদ ও তার সহযোগীরা তিনটি মোটরসাইকেলে লক্ষ্মীবাজারে ঢোকার সময় ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। এ সময় একটি মোটরসাইকেল থেকে নেমে ডাকাত শহীদ ও কালু পালানোর চেষ্টা করলে র‌্যাব সদস্যরা তাদের ধরার চেষ্টা করেন। এ সময় র‌্যাবকে লক্ষ্য করে তারা গুলি করলে র‌্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। এতে শহীদ ও কালু ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে দুটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। তবে মোটরসাইকেল তিনটিসহ বাকি আরোহীরা পালিয়ে যায়।
র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, ডাকাত শহীদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মধ্যে কালু ছিল ভয়ংকর প্রকৃতির। এ ছাড়া জোয়ার্দার মামুন, মেহের, রাসেল, তপনসহ কমপক্ষে ১০ জন দুর্ধর্ষ অপরাধী এখনো পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ডাকাত শহীদের হয়ে চাঁদাবাজিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ডাকাত শহীদ নিহত হওয়ার পর এবার তার শতাধিক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান শুরু হয়েছে। তবে দলনেতা নিহত হওয়ায় সহযোগীরা আগের মতো তৎপর হতে পারবে না বলেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন র‌্যাব কর্মকর্তারা।
ডাকাত শহীদের নানা অপকর্ম : শহীদুল ইসলাম ওরফে ডাকাত শহীদের (৪৮) বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের আদ্দিপাড়া গ্রামে। ঢাকায় একসময় থাকত ওয়ারী থানা এলাকার টিপু সুলতান রোডের ১৬/২ নম্বর ভবনে। শহীদের বাবা শামসুল হক ভূঁইয়া ওরফে ইসমাইল ছিলেন কৃষক।
গোয়েন্দা পুলিশের সূত্রে জানা যায়, ১৭ বছর বয়সেই মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন নদীতে ট্রলার ও লঞ্চ ডাকাতি শুরু করে শহীদ। অল্প বয়স থেকেই তার কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। এলাকায় নাম হয়ে যায় 'ডাকাত শহীদ'। ১৯৯৮ সালে মুন্সীগঞ্জ এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নেয় ঢাকায়। এ সময় পুরান ঢাকা ও কেরানীগঞ্জে সে ডাকাত বাহিনী গড়ে তোলে। চাঁদাবাজি, হত্যা, হুমকিসহ নানা অপকর্ম চলতে থাকে তার নামে। পুলিশের খাতায় ডাকাত শহীদ ও বাহিনীর নামে প্রতিবছর জমা হতে থাকে শতাধিক অভিযোগ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে ধরতে ব্যাপক চেষ্টা চালায়। একপর্যায়ে সে পালিয়ে ভারতে চলে যায়। এরপর সেখান থেকেই সহযোগীদের মাধ্যমে সে ঢাকায় চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। প্রতিবছর গোপনে সে ঢাকায় এসে বড় ধরনের অঘটন ঘটিয়ে আবার দেশের বাইরে চলে যেত চলে পুরান ঢাকায় জনশ্রুতি রয়েছে।
পুলিশ ও র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সাগির আহমেদ, অ্যাডভোকেট হাবিব মণ্ডল, ওয়ার্ড কমিশনার বিনয় সরকার বিনা, বাদামতলীর সিমেন্ট ব্যবসায়ী রতন, কেরানীগঞ্জের ছাত্রদল নেতা লাসানি চৌধুরী এমনকি নিজের স্ত্রী ববিও নির্মমভাবে খুন হয় ডাকাত শহীদের বাহিনীর হাতে। কাউন্সিলর আহমেদ হত্যাকাণ্ডেও ডাকাত শহীদের নাম ওঠে আসে। চার মাস আগে ভুট্টু ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার ঘটনায় র‌্যাবকে সহায়তার অভিযোগে সহযোগীরা শহীদের স্ত্রী ববিকে হত্যার পর বস্তাবন্দি লাশ ফেলে রাখে আল-রাজ্জাক হোটেলের সামনে। কেরানীগঞ্জের পারগেণ্ডারিয়া ও মিরেরবাগ এলাকায় দুটি ট্রিপল মার্ডারসহ রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যা ও চাঁদাবাজিসহ অর্ধশতাধিক মামলায় ডাকাত শহীদের সম্পৃক্ততার কথা ওঠে এসেছে। তার অন্যতম ক্যাডার মহসিন, শাহাজাদা, কিরন, ভুট্টু, ভোলা, সাইদ, নাদিম মোস্তফা, শামিম, টাইগার বাবু, টেরা হাবিব ও ক্যাডার আনু চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করত।
ডাকাত শহীদ তার পরিবার নিয়েই ভারতে অবস্থান করছিল। তার দ্বিতীয় স্ত্রী ইরানী থাকেন কামরাঙ্গীর চরে। ডাকাত শহীদের গ্রুপ এক থেকে সাত দিনের আলটিমেটাম দিয়ে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি করে। উঠতি সন্ত্রাসীদের দলে ভেড়ানোর জন্য কাজ করে সহযোগীরা।
প্রায় দুই ডজন আলোচিত হত্যা মামলার আসামি ডাকাত শহীদ। কেবল শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী ও কোতোয়ালি থানায়ই তার বিরুদ্ধে আটটি হত্যাসহ ২৫টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে চারটি মামলায় সে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি। এ ছাড়া বিভিন্ন হুমকি ও চাঁদাবাজিসহ রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে আড়াই শতাধিক জিডি রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া ও কমিউনিটি সার্ভিস) মাসুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ডাকাত শহীদ কুখ্যাত হয়ে ওঠার পর পুলিশের হাতে কখনো ধরা পড়েনি। আত্মগোপনে থেকে সহযোগীদের দিয়ে সে টেলিফোনের মাধ্যমে নিয়মিত দেশে চাঁদাবাজি করত। পুরান ঢাকার স্বর্ণপট্টিসহ বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সে নিয়মিত চাঁদা আদায় করত বলে অভিযোগ রয়েছে।
মর্গে পড়ে আছে লাশ : সূত্রাপুর থানার এসআই জালাল উদ্দিন জানান, ডাকাত শহীদের মৃত্যুর ঘটনায় সূত্রাপুর থানায় একটি জিডি করেছে র‌্যাব। মঙ্গলবার দিবাগত রাত পৌনে ১টার দিকে লক্ষ্মীবাজারের ৫৩ নম্বর সুভাষ বোস এভিনিউর পূর্ব পাশের গলির মুখ থেকে ডাকাত শহিদ ও তার সহযোগী কালুর লাশ উদ্ধার করা হয়। শহীদের গলা, ডান কানের ওপরে ও পিঠে গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। আর ডাকাত শহীদের ঘনিষ্ট সহযোগী কালুর চোখের পাশে, বুকে ও পিঠে তিনটি গুলি বিদ্ধ হয়। লাশ উদ্ধারের পর গতকাল রাত পর্যন্ত তাদের স্বজনরা মর্গে লাশ নিতে আসেনি।

No comments

Powered by Blogger.