ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামি প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগ by শহিদুল ইসলাম

৯ জুন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দুই দিনব্যাপী 'গ্রাম-আদালত' সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রাম-আদালতের বিচারপ্রক্রিয়ার সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'গ্রাম-আদালতে বিচারকাজ পরিচালনার সময় মনে রাখতে হবে, কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অন্যায়ভাবে কারো প্রতি অবিচার কিংবা ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামিকে যেন প্রশ্রয় দেওয়া না হয়।' (সমকাল ১০-৬-২০১২)।


প্রধানমন্ত্রীর এই আন্তরিক উপদেশ যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে দেশবাসী সবাই খুশি হবে। কিন্তু প্রত্যেকের মনের মধ্যে একটা সন্দেহের বাতাবরণ ঘোরাফেরা করছে। সবার মনে একটাই প্রশ্ন- প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ যতই ভালো ও মানবিক হোক না কেন, বাংলাদেশের বর্তমান সমাজ-বাস্তবতায় সেটা কি বাস্তবায়নযোগ্য? যে সমাজ-বাস্তবতা এক দিনে বা কয়েক বছরে তৈরি হয়নি, সে বাস্তবতা তৈরিতে এককভাবে প্রধানমন্ত্রী কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দায়ী করা যায় না। হাজার বছর ধরে সামন্তবাদী অর্থনীতির শক্ত রশিতে বাঁধা এ দেশের সমাজে সে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে পৃথিবীর সব দেশেই একসময় এই সমাজ-বাস্তবতা বিরাজিত ছিল। সামন্তবাদী সে সমাজে ধর্মের নামে যে কত অপরাধ ধর্মীয় রীতিনীতির লেবাসে সম্পন্ন করা হয়েছিল, সেসব নৃশংস ও মর্মন্তুদ ঘটনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। ধর্মের নামেই এ দেশে একসময় 'সতীদাহ'-প্রথা চালু ছিল, ইউরোপে চালু ছিল 'ডাইনি' হত্যা, মধ্যপ্রাচ্যে চালু ছিল (এখনো আছে) চুরির অপরাধে হাত কেটে ফেলা কিংবা জিনার অপরাধে মাটিতে পুঁতে নারীদের পাথর মারার অমানবিক দণ্ডপ্রথা। পুঁজিবাদী অর্থনীতির আগ্রাসনে উন্নত বিশ্বে ক্রমান্বয়ে সেসব সামন্ত যুগীয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বহুলাংশে বিলুপ্ত হয়েছে। বুর্জোয়া আইন প্রণয়ন করে সেসব অমানবিক প্রথা বন্ধ করা হয়েছে। ভারতবর্ষেও ১৮২৯ সালে আইনের মাধ্যমে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করা হয় এই বিচারে যে তা অমানবিক, নৃশংস এবং ধর্মের সঙ্গে এর কোনো সংস্রব নেই। আইন রচিত হওয়ার পরদিন থেকেই যে সে আইন বাস্তবায়িত হয়েছিল তা নয়। তার পরও দীর্ঘকাল সতীদাহ প্রথা ধর্মের অঙ্গ হিসেবে পালিত হয়েছে। তবে আইনত দণ্ডনীয় বিধায়, তখন আর ঢাকঢোল পিটিয়ে 'সতীদাহ' সম্ভব হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়েই সে অপকর্মটি করতে হয়েছে। তেমনি একটি ঘটনার কথা লিখেছেন জুল ভার্ন তাঁর বিশ্ববিখ্যাত 'অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ' (আশি দিনে বিশ্ব পরিভ্রমণ) বইতে। একইভাবে ইউরোপের দেশে দেশে আইন করেই বন্ধ করতে হয়েছিল 'ডাইনি হত্যা'। 'ধর্মীয় কুসংস্কার' ও 'গোঁড়ামির' বিরুদ্ধে কি তেমন কোনো আইন প্রণীত হয়েছে বাংলাদেশে? কোনটা 'ধর্মীয় কুসংস্কার' ও 'গোঁড়ামি' তা কি সংজ্ঞায়িত হয়েছে? এখনো আমাদের দেশে মোল্লা-মুসল্লিদের কথার গুরুত্ব অশিক্ষিত নয় শুধু, শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও অপরিসীম। ফতোয়াবাজির ক্ষমতা যে কত, তা প্রায় প্রতিদিন কাগজ খুললেই চোখে পড়ে। ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে কোনো আইন কি আজও কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে? ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে রামমোহন রায় ও তাঁর সহকর্র্মীদের তীব্র আন্দোলন কি এ দেশে আজও সম্পন্ন হয়েছে? ধর্মের নাম ভাঙিয়ে মৌলানা সাহেবরা প্রতিদিন হাজার হাজার মসজিদে যেসব কথা নসিহত করেন, তা কি সবই ধর্মসম্মত?
দুই. আমাদের অর্থনীতি কি পুঁজিবাদী? নাকি সামন্তবাদী-পুঁজিবাদীর জগাখিচুড়ি? যদি নির্ভেজাল পুঁজিবাদী হতো, তাহলে আমরা হয়তো একটি বুর্জোয়া সমাজে বাস করতাম। আমাদের সমাজকে কি বুর্জোয়া সমাজ বলা যায়? যদি বুর্জোয়া সমাজ হতো, তাহলে এ দেশে 'ধর্মীয় কুসংস্কার' ও 'গোঁড়ামির' এমন বাড়বাড়ন্ত হতো না যে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে সে ব্যাপারে সাবধান করে দিতে হতো। অর্থনীতির কোন পর্যায়ে আছি, অর্থনীতিবিদরাই তা ঠিক করুন। আমি বলতে চাই, আমরা বুর্জোয়া সমাজ থেকে বহু দূরে অবস্থান করছি। তাই আমাদের মধ্যে আজও বুর্জোয়া মূল্যবোধের জন্ম হলো না। বরং আমরা একটি শক্তিশালী সামন্তবাদী সংস্কৃতির মধ্যে বাস করছি। তা প্রমাণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে গ্রাম আদালত উদ্বোধনকালে ওই উপদেশ না দিয়ে তাঁর চারদিকের স্যুটেড-বুটেড মানুষগুলোর দিকে চাইলেই পারতেন। আমাদের চারপাশে কেবলই 'ধর্মীয় কুসংস্কার' ও 'গোঁড়ামির' ঘন কালো অন্ধকার। আমাদের প্রতিদিনের কাগজ খুললেই চোখে পড়বে কেবল অযুক্তি আর অপবিজ্ঞানের প্রচারণা। আমাদের কাগজ ও টেলিভিশনে চোখ রাখলেই এমন সব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়, যার সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই, আছে বিজ্ঞানের নামে অপবিজ্ঞানের। প্রধানমন্ত্রীর কথায়- যেমন ধর্মের নামে 'ধর্মীয় কুসংস্কার', তেমনি বিজ্ঞানের নামে 'বৈজ্ঞানিক কুসংস্কার'। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ জর্জ সার্টন অ্যাসট্রোলজিকে অপবিজ্ঞান বলে উল্লেখ করেছেন। আমাদের কাগজগুলো যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে- কে কত সুন্দরভাবে সেই অপবিজ্ঞানটি প্রচার করে মানুষকে কপালের ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে। পাঠকের মনে আছে নিশ্চয়ই, নব্বইয়ের দশকে ভারতের বিজেপি ক্ষমতায় বসে বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাস্ট্রোলজি বাধ্যতামূলকভাবে চালু করার নির্দেশ দিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে খেপে উঠেছিল ভারতের বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। প্রতিবাদে প্রতিবাদে ভারত উত্তাল হয়ে উঠেছিল। শেষে বিজেপি সে নির্দেশ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল। তা ছাড়া বাংলাদেশের কোথাকার কোন ফকিরের কেরামতির খবর এত গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয় যে সাধারণ সহজ-সরল মানুষ তা সহজেই খায়। আজ যখন আলবার্ট আইনস্টাইনের বিশেষ ও সাধারণ তত্ত্ব ক্ল্যাসিক্যাল ফিজিকসে পরিণত হয়েছে, যখন সারা বিশ্ব কোয়ান্টাম জগতে ঢুকেছে, তখন আমাদের প্রচারমাধ্যমে বিজ্ঞানের কোনো খবর নেই, আছে অপবিজ্ঞানের। আমরা এগোবো কেমন করে?
তিন. খবরের কাগজগুলো বলতে পারে যে এ দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ 'রাশিচক্র' চায় ও খায়। অপবিজ্ঞান হলেও সেটা বন্ধ করে দিলে আমাদের ব্যবসা মার খাবে। তখন আমরা তাঁদের সে উপদেশ দিতে পারি না। কিন্তু একটি অসত্য ও অপবিজ্ঞানের এমন বহুল প্রচারে দেশে বিজ্ঞানচর্চার যে ক্ষতি হয় ও হচ্ছে, তার খেসারত কে দেবে? প্রধানমন্ত্রীর উপদেশের মধ্যে ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামিকে চিহ্নিত করে কেবল 'গ্রাম-আদালতেই' নয়, আমাদের উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র থেকে শুরু করে জীবনের সর্বক্ষেত্র থেকে অপসারণ দরকার। আমরা যেন যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠি, কাগজ ও টেলিভিশন কেন্দ্রগুলো সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শুক্রের একটি দিন তার বছরের চেয়েও বড় কেন, একজন পদার্থবিজ্ঞানের মাস্টার্স ডিগ্রিধারী ব্যক্তি বলতে পারেন না, তখন লজ্জায় মুখ নিচু হয়ে যায়। এই প্রশ্নটি আমি অনেককেই করেছিলাম। পার্থে আমার ৯ বছরের নাতি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিল। কারণ ওরা বিজ্ঞান-সংস্কৃতির মধ্যে বাস করে। আর আমরা বিজ্ঞানবিরোধী, আধা পুঁজিবাদী, আধা-সামন্তবাদী ও ধর্মান্ধ সমাজে বাস করি। এমন একটা সমাজ গড়ে তোলা দরকার, যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে অতটা উদ্বেগ প্রকাশ না করলেও চলত। ধর্মান্ধতা ও গোঁড়ামি হিংস্র বাঘের মতো। বাঘকে খাঁচার মধ্যে রাখতে হয়। ধর্মান্ধতা ও গোঁড়ামির খাঁচা হলো আইন এবং সে আইনের সার্থক প্রয়োগ।
লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.