মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-জামায়াত নেতা মীর কাসেম গ্রেপ্তারের পর কারাগারে

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এবার গ্রেপ্তার হলেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী। বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল রোববার মীর কাসেমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।


বেলা আড়াইটায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। সোয়া চারটায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে। পরে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। আজ সোমবার তাঁকে আবার ট্রাইব্যুনালে হাজির করার কথা রয়েছে।
এ নিয়ে জামায়াতের মোট সাতজন নেতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলো। এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার বিচার শুরু হয়েছে। সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হবে কি না, এ বিষয়ে আদেশের দিন ধার্য আছে। জামায়াতের সাবেক সদস্য (রুকন) মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলে তিনি পালিয়ে যান। এ ছাড়া বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আবদুল আলীমেরও বিচার চলছে ট্রাইব্যুনালে।
মীর কাসেম আলী বর্তমানে দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের পরিচালক। তিনি ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান, ইবনে সিনা ট্রাস্টের সদস্য (প্রশাসন) এবং কেয়ারি হাউজিং ও ইডেন শিপিং লাইনসের চেয়ারম্যান। তিনি রাবেতা আলম আল ইসলামীর এদেশীয় পরিচালক ছিলেন।
গতকাল সকালে মীর কাসেমকে গ্রেপ্তার ও আটকাদেশ চেয়ে করা আবেদন ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে জমা দেয় রাষ্ট্রপক্ষ। বেলা দুইটার দিকে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি রানা দাশগুপ্ত বলেন, একাত্তরে মীর কাসেম আলী জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন। চট্টগ্রামের মহামায়া ডালিম হোটেলে তাঁর নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র গড়ে ওঠে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সাহায্যকারী ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনের শিকার কয়েকজন ব্যক্তির জবানবন্দি এবং এ-সংশ্লিষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ তদন্তে পাওয়া গেছে।
রানা দাশগুপ্ত আরও বলেন, মীর কাসেম আলী নিজে এবং সহযোগীসহ চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সাহায্যকারী ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করা হতো। চট্টগ্রামের গহিরা, জগৎমল্লপাড়া, পাহাড়তলী, দামপাড়া পুলিশ লাইনসহ বিভিন্ন স্থানে বধ্যভূমির সৃষ্টি হয়, যা মুক্তিযুদ্ধকালের যুদ্ধাপরাধের সাক্ষী হয়ে আছে।
এ পর্যায়ে কাসেম আলীর বিরুদ্ধে তদন্তে পাওয়া কয়েকটি ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি। তিনি বলেন, একাত্তরের ১৯ নভেম্বর বেলা দুইটার দিকে দুই ব্যক্তিকে (ট্রাইব্যুনালে ঘটনার শিকার ব্যক্তির আদ্যক্ষর উপস্থাপন করা হয়) পাকিস্তানি সেনারা অ্যামবুশ করে আটক করে। পরে তাঁদের কাসেম আলীর নেতৃত্বাধীন ডালিম হোটেলের নির্যাতন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দিন সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করার পর তাঁদের চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁরা ছাড়া পান। তাঁদের মধ্যে একজনকে নির্যাতনের সময় বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছিল।
রানা দাশগুপ্ত আরও বলেন, একাত্তরের ২৩ নভেম্বর এক ব্যক্তিকে তাঁর চট্টগ্রামের কদমতলীর ভাড়া বাসা থেকে ডালিম হোটেলের নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে আলবদররা প্রস্তাব দেয়, তিনি যেন রেডিওতে বলেন, ‘যারা বিপথগামী হয়েছ, তারা ফিরে এসো। তোমাদের ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ তিনি এতে রাজি না হলে তাঁকে নির্যাতন করা হয় এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।
আরেকটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে কৌঁসুলি বলেন, ২৪ নভেম্বর রাত চারটার দিকে এক ব্যক্তিকে আজিজ কলোনির বাসা থেকে এবং আরও কয়েকজন ব্যক্তিকে বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করে হাত-পা বেঁধে আসামির নিয়ন্ত্রণাধীন ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দুই-তিন দিন নির্যাতনের পর তাঁদের কারাগারে আটকে রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে আরও অনেকের সঙ্গে তাঁরা মুক্তি পান।
এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল কৌঁসুলিকে বলেন, তদন্তে পাওয়া এসব তথ্য আর পড়ার দরকার নেই।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, কাসেম আলী অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং এই ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে বিরূপ প্রচারণা চালিয়েছেন। তিনি চট্টগ্রামে নির্যাতিত ও ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে মামলায় সাক্ষ্য না দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তাঁর হুমকিতে তদন্তের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে। গ্রেপ্তার এড়াতে যেকোনো সময় তাঁর পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল জানতে চান, ঘটনার শিকার ও নির্যাতিত ব্যক্তিরা জীবিত আছেন কি না।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, অধিকাংশ ভিকটিম জীবিত আছেন।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে এক সাক্ষী যে মহামায়া ডালিম হোটেলের নাম বলেছিলেন, এটা কি সেই ডালিম হোটেল?
রানা দাশগুপ্ত হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন।
গত ২৭ মে এই ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের তৃতীয় সাক্ষী সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরু বাঙালি জবানবন্দিতে বলেছিলেন, চট্টগ্রামে সাকা চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণাধীন আলশামস বাহিনী ছাড়াও ইসলামী ছাত্র সংঘের একটি ক্যাডার গোষ্ঠী ছিল, যার নাম ছিল আলবদর। ডালিম হোটেলে ছিল আলবদরের নির্যাতনকেন্দ্র। ছাত্র সংঘের নেতা মীর কাসেম আলী এর নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর কাছে নির্যাতিত হয়েছেন এমন দুজন ব্যক্তি হলেন হাটহাজারীর ন্যাপ নেতা ও চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির একাধিকবার নির্বাচিত সভাপতি শফিউল আলম ও সাইফুদ্দিন আহমেদ খান।
শুনানির পর ট্রাইব্যুনাল কাসেম আলীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য অনুসারে আসামির বিরুদ্ধে তদন্তে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং সাক্ষীরা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা যেতে পারে।
ট্রাইব্যুনাল কার্যপ্রণালি বিধিমালার বিধি ৩৪(১) পালনের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন। এই বিধি অনুসারে, গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে সরাসরি ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে হয়।
পুলিশের মতিঝিল জোনের উপকমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ পাওয়ার পর মীর কাসেমকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ অভিযান চালায়। বিকেল পৌনে চারটার দিকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।’ বিকেল চারটার দিকে মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগ থেকে মুঠোফোনে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানানো হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, মতিঝিলে দিগন্ত মিডিয়া লিমিটেডের প্রতিষ্ঠান দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার তৃতীয় তলায় মীর কাসেম আলীর নিজস্ব কক্ষ থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসেন।
বিকেল চারটা ১০ মিনিটে মীর কাসেমকে পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে স্থাপিত ট্রাইব্যুনালে এনে হাজতকক্ষে রাখা হয়। এ সময় ট্রাইব্যুনালে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল।
মীর কাসেমকে ট্রাইব্যুনালে আনার কিছুক্ষণের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের আটক নেতাদের আইনজীবী তাজুল ইসলামসহ সাত-আটজন আইনজীবী ট্রাইব্যুনালে আসেন। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরাও গিয়ে এজলাসে বসেন। তবে ট্রাইব্যুনাল আর বসেননি।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি রানা দাশগুপ্ত সাংবাদিকদের জানান, দাপ্তরিক সময় অতিবাহিত হওয়ায় আজ (গতকাল) আর ট্রাইব্যুনাল বসছেন না। এ জন্য গ্রেপ্তার হওয়া মীর কাসেমকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আগামীকাল (আজ সোমবার) তাঁকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে এ বিষয়ে শুনানি হবে।
আসামিপক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, মীর কাসেমের জামিনের জন্য কাল (সোমবার) আবেদন করা হবে।
রাতে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানা থেকে মীর কাসেমকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। কারাধ্যক্ষ মাহাবুবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রাত নয়টার দিকে তিনি কারাগারে এসে পৌঁছেছেন।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামের পিডব্লিউডির কর্মচারী মৃত তৈয়ব আলীর চার ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় মীর কাসেম আলী। তাঁর পারিবারিক নাম পিয়ারু। কিন্তু মিন্টু নামে তিনি পরিচিত। পিতার চাকরির সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের আগে চট্টগ্রামে ছিলেন তিনি। ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র। সেখান থেকেই ইসলামী ছাত্র সংঘের চট্টগ্রাম জেলার দায়িত্ব পান। যুদ্ধের পর আত্মগোপন করেন মীর কাসেম আলী।
প্রতিবাদ: মীর কাসেম আলীকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর মিরপুর ও মৌচাক এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির। মীর কাসেম ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে মীর কাসেম আলীকে গ্রেপ্তারের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.