চারুশিল্প-শূন্যতায় পূর্ণতার আভাস by সিলভিয়া নাজনীন

ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে বাংলার সবকিছুই যেন বদলে যাচ্ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী একচক্ষু রাক্ষসের মতো পিষে ফেলতে চেয়েছিল আপামর বাঙালি মানুষ এবং মানসিকতাকে। এই সময়ে জন্ম নেওয়া একদল শিশু তাদের কৈশোরের শুরুতেই শুনতে পায় রুখে দাঁড়ানোর আওয়াজ। পরে আশির দশকে এই তরুণেরা খুঁজেছিল


জীবনের ভিন্ন পাঠ; যা জীবন ঘনিষ্ঠ সমাজমুখী এবং সামষ্টিক স্বার্থের অভিমুখী ছিল এই প্রবণতার কেন্দ্র; সে সময় থেকে শৈল্পিক কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশ করা—এই তরুণেরা বর্তমান সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে স্ব-স্ব অবস্থানে স্থিত-প্রতিষ্ঠিত; তাদের সাম্প্রতিক অবস্থান-ভাবনা শিল্পকলা, স্থাপত্য এবং চলমান ছবিতে যেভাবে এসেছে, তা নিয়ে প্রদর্শনী ‘উইথ্ ইন উইথ্ আউট’। ১১ এপ্রিল এই প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ধানমন্ডির ঢাকা আর্ট সেন্টারে। এই প্রদর্শনী তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর আর রাজিউল হাসানকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
চিত্রশিল্পী-ভাস্কর-স্থপতি-চলচ্চিত্র নির্মাতা-আলোকচিত্রী-কবি এমনই শিল্পমাধ্যমের বিবিধ ক্ষেত্রে চেতনার ঐক্যতান তৈরি হয়েছিল তখনকার পরিস্থিতির প্রয়োজনে। তরুণ উন্মাদনা রক্ষণশীল মানসিকতাকে পেছনে ফেলে নতুন সৃষ্টিতে মেতে উঠেছিল। শিল্পধারায় কোনটি শ্রেষ্ঠ আর গ্রহণযোগ্য সে বিতর্ক তৈরির চেষ্টা ছিল তাদের।
আয়োজকদের একজন শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এই হঠাৎ আয়োজন খুব পরিপাটি-গুছিয়ে করা সম্ভব হয়নি সময়ের স্বল্পতার জন্য। তবে আমরা একটু খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি সে সময়ে গতানুগতিক ভাবনার বাইরে কিছু হয়েছিল কি না। শিল্পকলায় সময় গ্রুপ, স্থপতিদের মধ্যে চেতনা গ্রুপ, চলচ্চিত্রে তারেক মাসুদ; সাহিত্যে গাণ্ডিব-পুরোনো ধ্যান-ধারণার বাইরে এসে নতুন কিছু করার চেষ্টা করছিল। এখানে একটা ক্যারেক্টার পাওয়া যায়। কারণ, ’৬০-এ জন্ম, ’৬৫ যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষ-বন্যা, ’৭১-এ স্বাধীনতাযুদ্ধ, ’৭৫-এ পটপরিবর্তন—এটা ন্যাশনাল কন্টেকস, আবার ইন্টারন্যাশনাল কন্টেক্সে আফ্রিকার দেশগুলোর স্বাধীনতা, ইম্পেরিয়ালিজমের শুরু, ’৭২ ভিয়েতনামের যুদ্ধ—এই অবস্থাতে যাদের বেড়ে ওঠা—সচেতন বা অসচেতনভাবে এই প্রজন্মের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে। ভিজুয়্যাল আর্টে এই সময়ের ছেলেমেয়েদের কাজের কোনো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে কি না তা খুঁজে দেখা—তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পর্যবেক্ষণ—এই প্রজন্মকে যাচাইয়ের প্রথম পদক্ষেপও বলা যেতে পারে এই প্রদর্শনী।’
এই প্রদর্শনীতে স্থপতি রাশিদুল হাসান ‘মাদার ভিলা’ শীর্ষক একটি ভিন্নধর্মী উপস্থাপনা করেছেন। তিনি তাঁর একটি প্রজেক্টকে সিম্বলাইজ করার চেষ্টা করেন কাঠের একটি স্ট্রাকচার, কিছু ড্রয়িংয়ের সমন্বয়ে। তিনি বলেন, একটি প্রজেক্ট শেষ করার পর সেখানে প্রবেশ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এই হতাশাবোধ প্রত্যেক স্থপতির মধ্যেই রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা বিভক্তিকরণও তাকে বেশ প্রভাবিত করেছে। বিভিন্ন প্রতীকের মাধ্যমে তিনি তা ব্যক্ত করেছেন।
শিল্পী নিসার হোসেন একাত্তরের ঘাতক-দালাল এবং যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিত্রকর্মে তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করে চলেছেন। এই প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত তাঁর শিল্পকর্ম এই ধারাবাহিকতারই অংশ। তিনি এই চিত্রকর্মে তাদের প্রতি ধিক্কার ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
‘...তারা কেউ এসেছিল চারুকলা চর্চায়, কেউ সাহিত্য রচনায়, কেউ চলচ্চিত্র তৈরিতে, কেউ স্থাপত্য নির্মাণে, কেউ গান বাধতে। কিন্তু তারা অচিরেই উপলব্ধি করেছিল শিল্পকলার মতো জীবনও স্তরবহুল। তাই তারা ছাপিয়ে যেতে চেয়েছে নিজ নিজ মাধ্যমের গণ্ডিকে। আক্রমণ করেছে শিল্পকলার চেনা সীমানার ওপর। নিজেদের সময়কে বুঝতে চেয়েছে অনেকের জীবনের পটে। আত্মতার মধ্যে তারা টেনে আনতে চেয়েছে বৃহত্তর জগৎকে। তারা বুঝতে পেরেছিল, এখনো দানা না-বাঁধা নতুনতর উপলব্ধিকে প্রকাশ করার জন্য দরকার নতুনতর ভাষা। চারুশিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, স্থাপত্য ও গান উপভোগের এক অভাবিত পথে তাঁরা যাত্রী করেছিলেন শিল্পভোক্তাদের।’ এভাবেই প্রদর্শনীর মূলভাবনা লিখেছেন আশির দশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি সাজ্জাদ শরিফ।
শিল্পী ঢালী আল মামুন বলেন, ‘কৈশোরের এক্সপেরিয়েন্স মানুষকে তাড়িত করে। এ দেশের শিল্পে চিন্তার ক্ষেত্রটি দৃশ্যমান হয় আশির দশকে। আমাদের একাডেমি কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে তেমন সাহায্য করেনি সে সময়। আমাদের নতুন রাষ্ট্র-সম্ভাবনা-স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গ—সব মিলে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। আমাদের অভিজ্ঞতাকে শিল্পকর্মের মধ্যে বিস্তৃত করার প্রয়াস ছিল। কবিতার ক্ষেত্রেও একটা বড় পরিবর্তন হয় এ সময়ে। চিত্রকলায় আমরা যখন অর্থহীনতা থেকে অর্থের দিকে ঢুকতে চেষ্টা করছি, সে সময় কবিতা উল্টো দিকে যায়; অ্যাবসার্ডিটি শুরু হয়েছিল কবিতায়।’ শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘আশির দশকের পূর্ববর্তী শিল্পকর্ম দেখে কোনো প্রশ্নের উদ্রেক হতো না। আমরা চেয়েছি আমাদের শিল্পকর্ম প্রশ্ন তৈরি করুক।’ এই প্রদর্শনীতে ‘শিরোনামহীন’ শীর্ষক শিল্পকর্মে তিনি জীবনের সবকিছুই অর্থহীন পণ্যে রূপান্তরিত হওয়াকে এক ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনায় সামনে নিয়ে এসেছেন। বর্তমান সময়ে হাসি বা কান্না বা মানুষের অনুভূতিগুলোকেও কিনতে পাওয়া যায় তিনি মনে করেন। ভাস্কর তৌফিকুর রহমানের ‘ফিঙ্গার প্রিন্ট’ শীর্ষক ভাস্কর্য রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। তিনি মনে করেন, মূলত ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়েই একজন মানুষের আইডেনটিটি জানা যায়। এই ভাবনা থেকে পাঁচটি বিভিন্ন ভঙ্গির আয়রন কাস্টিংয়ের মুখাবয়বের সঙ্গে একটি অবজেক্টকে সমন্বয় করে তিনি এই শিল্পকর্মটি করেছেন।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের এই নতুন করে একত্র হওয়া বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় নতুন কোনো সম্ভাবনা তৈরি করবে বলেই আশাবাদী হওয়া যায়।
অংশগ্রহণকারীরা হলেন ঢালী আল মামুন, দিলারা বেগম জলি, জালাল আহমেদ, নাহাজ আহমেদ খলিল, নিসার হোসেন, রাশিদুল হাসান, রাজিউল হাসান, সাইদুল হক জুঁইস, সাইফুল হক, শিশির ভট্টাচার্য্য, তৌফিকুর রহমান, ওয়াকিলুর রহমান, প্রয়াত তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর প্রমুখ। প্রদর্শনী চলবে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত।

No comments

Powered by Blogger.