বঙ্গবন্ধুর গৃহ আক্রমণ ও গ্রেপ্তার-প্রক্রিয়া by ডা. এম এ হাসান

২৩ মার্চ ১৯৭১ সালে যখন ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো হচ্ছিল, তখন পাকিস্তানি সেনারা যেমনি তীব্র অন্তর্জ্বালায় দগ্ধ হচ্ছিল; তেমনি পর্দার অন্তরালে ক্রূর হাসি হাসছিল। কেননা, ১৭ মার্চ রাতেই ২৫ মার্চের করণীয় বা অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অঙ্গুলি হেলনে দেশের মানুষ ছুটছিল ও দেশ চলছিল, তাঁকে খাঁচায় ঢোকানোর পরিকল্পনা করা হয় তখনই। এই সময় তাঁর সম্পর্কে মূল্যায়ন হয় নানাভাবে এবং নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। তাঁকে নিয়ে কী করা হবে, সে সম্পর্কে দ্বিধা থাকলেও, মোটা দাগের কয়েকটি সিদ্ধান্ত আগে থেকে নেওয়া হয়। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান এবং জেনারেল এ ও মিটঠা খান স্পষ্টত তাঁকে আঘাত করার বিপক্ষে ছিলেন। ভিন্ন অবস্থান থেকে জেনারেল ইয়াকুব একই মত পোষণ করতেন। সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর জন্য এবং সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার জন্য তাঁর বিচারের পক্ষে ছিল অনেকে। এ অবস্থায় বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধুকে একটি কমান্ডো অপারেশনের মাধ্যমে বন্দি করার পরিকল্পনা চলছিল পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে।
২৩ মার্চ মাঝদুপুরে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে খাবার ও ওষুধ নিয়ে সি-১৩০ জাতীয় একটি বিমান অবতরণ করে। ওই বিমানে পাকিস্তানি কমান্ডো অফিসার মেজর জেড এ খানকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ঢাকায় তাঁর সঙ্গে যোগ দেন মেজর বিল্লাল ও ক্যাপ্টেন হুমায়ুন। মার্শাল ল' হেডকোয়ার্টারের একটি কক্ষে কর্নেল এস ডি আহমদের তত্ত্বাবধানে ২৪ ও ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করার পরিকল্পনা নিয়ে তাঁদের কাজ শুরু হয়। ২৩ তারিখ বিকেল ও ২৪ তারিখ সকালে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ধানমণ্ডি সংযোগ সড়ক ও বঙ্গবন্ধুর বাড়ির আশপাশ পরিদর্শন করেন মেজর জেড এ খান ও বিল্লাল। জেড এ খান ২৪ মার্চ ১১টায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান তাঁকে একজন অফিসার ও একটি সিভিলিয়ান গাড়ি নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করার নির্দেশ দেন। এটি তাঁর কাছে কঠিন ও অসম্ভব মনে হয়। তখন তিনি ২৪ মার্চ বিকেলে জেনারেল এ ও মিটঠা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জেনারেল এ ও মিটঠা খান ২৫ মার্চ সকাল ৯টায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বললে জেড এ খান তা-ই করেন। এতে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান অসন্তুষ্ট হলেও পরিশেষে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদের হস্তক্ষেপে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়। জেনারেল আবদুল হামিদ তাঁকে এমন আদেশ দেন যে জেড এ খান এবং মেজর বিল্লাল এমন কিছু যেন না করে, যাতে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণের আশঙ্কা দেখা দেয়। এরপর প্রায় এক কম্পানি সৈন্য নিয়ে ২৫ মার্চ রাতে তিন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘেরাও করে মেজর জেড এ খানের কমান্ডো বাহিনী। ২৫ জন সৈনিকের একটি ছোট দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন সাঈদ। দ্বিতীয় প্লাটুনের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন হুমায়ুন। তাঁর দায়িত্ব ছিল দেয়াল টপকে বঙ্গবন্ধুর ঘরে ঢোকা। তৃতীয় গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর বিল্লাল। মেজর বিল্লালের দায়িত্ব ছিল শক্তিশালী টর্চ দিয়ে নিচতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত সব কয়টি ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজা এবং ভেতরের প্রতিরোধ ভাঙা। মেজর জেড এ খানের জিপটি এমনভাবে হেডলাইট জ্বালিয়ে পথে দাঁড়িয়ে ছিল, যাতে সামনে থেকে কেউ বুঝতে না পারে আলোর পেছনে কী আছে।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে গোলাগুলির মধ্যে মোটা পাইপ নির্মিত ব্যারিকেড সরিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে পেঁৗছে জেড এ খানের কমান্ডো বাহিনী। সেখানে ৩২ নম্বর বাড়ির বারান্দায় গ্রেনেড ফাটিয়ে এবং পিস্তলের গুলি ছুড়ে এক ধরনের ত্রাস সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করা হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কণ্ঠে তাঁদের বলেন, 'আমাকে বললেই হবে, আমি নিজেই যাব।' বঙ্গবন্ধু দৃঢ় ও অবিচল থেকে তাঁর পাইপটি নেন এবং তাঁর পরিবার থেকে বিদায় নেন। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে ১৪ ডিভিশন অফিসার্স মেসে রাখা হয়। দ্বিতীয় দিন জেনারেল এ ও মিটঠা খানের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুকে আদমজি ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের তৃতীয় তলায় রাখা হয়। সেখান থেকে বন্দি অবস্থায় তাঁকে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়।
লেখক : আহ্বায়ক, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক

No comments

Powered by Blogger.