রঙ্গব্যঙ্গ-মনমোহন-গিলানির কাল্পনিক গোলটেবিল by মোস্তফা কামাল

উপমহাদেশের দুই পারমাণবিক শক্তির দেশ ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেটযুদ্ধ হয় ভারতের মাটিতে। সেই খেলা উপভোগ করার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণে সাড়া দেন তিনি।


ক্রিকেট খেলার ফাঁকে তাঁদের মধ্যে গোলটেবিল বৈঠক হয়। বৈঠকের কাল্পনিক কথাবার্তা আমরা পাঠকের উদ্দেশে তুলে ধরছি।
মনমোহন : (নমস্কারের ভঙ্গিতে দুই হাত তুলে) হিন্দুস্তানের পক্ষ থেকে আপনাকে সাদর সম্ভাষণ।
গিলানি : ইসলামিস্তানের (পাকিস্তান) পক্ষ থেকে আপনাকে লাল গোলাপ শুভেচ্ছা। আমরা আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করি। আপনার মতো নিরীহ ভদ্রলোকের বড় অভাব!
মনমোহন : আর বলবেন না। বুড়ো হয়ে গেছি। আর বোঝা বইতে পারছি না।
গিলানি : সোনিয়া আপনার কাঁধে বন্দুক রেখে তো বেশ ভালোই চালাচ্ছেন।
মনমোহন : না না। তিনিও মাইনক্যা চিপায় পড়েছেন।
গিলানি : এটা আবার কী!
মনমোহন : কেন, টের পাচ্ছেন না? ভারতীয় মন্ত্রীদের দুর্নীতির খবর মিডিয়ায় হেডলাইন হচ্ছে। আর এর দায় নিতে হচ্ছে কংগ্রেসকে। কংগ্রেস মানেই তো সোনিয়া!
গিলানি : আমার মনে হয়, আপনার কথা ঠিক না।
মনমোহন : কেন?
গিলানি : সোনিয়ার ভাবমূর্তি এমন দাঁড়িয়েছে যে তিনি যেন স্বর্গের দেবী। তাঁর কোনো দোষ নেই। তিনি অন্যায় কাকে বলে জানেন না। সব দোষ চেপেছে আপনার ঘাড়ে।
মনমোহন : তাই নাকি?
গিলানি : জি জি। কেন, আপনাকে কেউ বলেনি? সবাই তো আপনার সরকারকে দুর্নীতিবাজ সরকার বলে গালমন্দ করছে। সবাই আপনার ওপর দোষ চাপাচ্ছে।
মনমোহন : অথচ আমি কিছুই জানি না। সাদামাটা জীবনযাপন করি। আমার বেশভূষা দেখলে বোঝা যায় না? আসলে আমার কাছে এসে তো সবাই হুজুর হুজুর করে! এ কারণে কিছুই বুঝতে পারি না। দুনিয়ায় এত তেলবাজ লোক! তারা সব সময় আমাকে মিসগাইড করে। এটা একটা বড় সমস্যা।
গিলানি : হ্যাঁ, এখন যুগটাই তো তেলবাজদের! আচ্ছা শোনেন, আপনার ক্রিকেট কূটনীতিটা বেশ জুতসই হয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব খুশি হয়েছি।
মনমোহন : এবার বলেন, চিরদিনই কি আমাদের মধ্যে বৈরিতা থাকবে? নাকি আমরা এবার নিজেদের ভুলগুলো শুধরে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যাব?
গিলানি : অবশ্যই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমাদের কথা কি আমলারা শোনে? আমরা তো চাই-ই। আমলারা কেন জানি সমস্যাটা জিইয়ে রাখতে চায়।
মনমোহন : আমার মনে হয়, শুধু আমলারাই দায়ী নয়। এর পেছনে অনেক বড় দুরভিসন্ধি রয়েছে। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী চায় না, দুই পারমাণবিক শক্তি একসঙ্গে মিলেমিশে থাকুক।
গিলানি : সে জন্যই তো ব্রিটিশরা সমস্যাটা জিইয়ে রেখে গিয়েছে। ওরা যদি তখন সঠিকভাবে বিভাজনটা করত তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা থাকত না।
মনমোহন : এটাই তো ব্রিটিশদের চাল! এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি না করে দ্রুত সমঝোতায় আসতে হবে। এ জন্য উভয়পক্ষকে কিছু না কিছু ছাড় দিতে হবে। আপনি কি ছাড় দিতে রাজি?
গিলানি : এই সিদ্ধান্ত তো আমি দিতে পারব না। এ জন্য আমাকে আর্মির কাছে ধরনা দিতে হবে। আপনিও নিশ্চয়ই এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না?
মনমোহন : হ্যাঁ, তাই তো! (মনে মনে) সাউথ ব্লক (ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর) রাজি না থাকলে তো কিছুই হবে না। দুই পক্ষের দুই সমস্যা! কিন্তু সমাধানে তো পেঁৗছতে হবে!
গিলানি : (মনমোহনকে উদ্দেশ করে) কী ভাবছেন বলেন তো? নিশ্চয়ই সাউথ ব্লকের কথা ভাবছেন!
মনমোহন : জি জি। আপনি কী করে বুঝলেন?
গিলানি : আমি সমস্যাটা জানি তো!
মনমোহন : আপনি নিশ্চয়ই সমাধানটাও জানেন!
গিলানি : জি জানি। এসব ক্রিকেট কূটনীতি, মত বিনিময়, বৈঠক করে কিছু হবে না। আমার মনে হয়, আমাদের আর্মি চিফ এবং আপনাদের পররাষ্ট্রসচিবের মধ্যে একটা বৈঠক হওয়া দরকার। তাঁদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো থাকলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
মনমোহন : হা হা হা! আন্ডারস্ট্যান্ডিং তো আছেই! আন্ডারস্ট্যাডিং হচ্ছে, সমস্যাটা জিইয়ে রাখার, সমাধানের নয়!
গিলানি : সেটা বুঝতে পেরেই তো তাঁদের মধ্যে বৈঠকের প্রস্তাব দিলাম।
মনমোহন : বৈঠক হবে, কিন্তু কোনো ফল হবে না। বৈঠকে বলা হবে, আরো আলোচনা প্রয়োজন। আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। দুই দেশের মধ্যে আসা-যাওয়া, ঘোরাফেরা হবে আর কি!
গিলানি : এখন তাহলে উপায় কী?
মনমোহন : উপায় একটা আছে। সেটা যদি সম্ভব হয় তাহলে সমাধানও সম্ভব হবে।
গিলানি : সেটা কী?
মনমোহন : আপনার আমার মেরুদণ্ডটা সোজা করতে হবে। এতে হয়তো উভয়কেই ক্ষমতা হারাতে হবে। তার পরও কাজটি হয়ে গেলে দুই দেশই বেঁচে যাবে।
গিলানি : এটা কি সম্ভব? আপনার কথার সঙ্গে যদি আমি একমত হই তাহলে দেশে গিয়ে দেখব আমার গদি নেই! আর্মি শর্ত দেবে, আমি ক্ষমতায় থাকলে জারদারি সরকারকে তারা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে। দেখছেন না, জঙ্গিরা কী বাড়াবাড়িটা করছে! আর্মির জন্য কিছু করতে পারি না। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জঙ্গিরা আমাদের দেশটাকে খেয়ে ফেলছে।
মনমোহন : ওহ! তাহলে টের পেয়েছেন? শুভ লক্ষণ!
গিলানি : কেন?
মনমোহন : জেনেশুনে আপনারা আর যাই হোক, জঙ্গি রপ্তানি করবেন না।
গিলানি : হঠাৎ এ কথা কেন বললেন?
মনমোহন : জঙ্গিদের যাতনা তো আপনি টের পাচ্ছেন, তাই না? কাজেই জঙ্গি রপ্তানি করে এই বুড়ো মানুষটার কষ্ট আর বাড়াবেন না।
গিলানি : কী যে বলেন! আমরা কি শুধু জঙ্গিই রপ্তানি করি! ভালোবাসাও তো করি!
মনমোহন : ও আপনি শোয়েব মালিকের কথা বলছেন তো! ধন্যবাদ। সানিয়া আর শোয়েবের পথ ধরে আমাদের দুই দেশ যেন সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ভালোবাসার টানে আমাদের যেন কাছে আনে।
গিলানি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে মনমোহনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.