প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরঃ বাংলাদেশের প্রাপ্তি নেই by শওকত মাহমুদ

প্রতিটি মানুষ, আমার বিশ্বাস, তার অন্তঃপ্রদেশে স্বাধীন, সার্বভৌম, স্বয়ম্ভর ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ধারণায় সুস্থিত; বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য ও সংস্কৃতি বোধের অসতর্কতার বিরুদ্ধে যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম মরিয়া প্রহরায় বিনিদ্র আছেন।
এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, বাংলাদেশের সকল নাগরিকেরই তো এই রাষ্ট্রের স্বার্থানুগ হওয়ার কথা। বিশ্বায়নের শোরগোলে জাতীয়তার মধ্যে আন্তর্জাতিকতার পরিপূরণকে ক’টি লোকই বা মুখ্য মনে করে? বাঙালি বুদ্ধিজীবীর মননে আন্তর্জাতিকতাবোধ আলোচনা করতে গিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক দীপেন্দু চক্রবর্তী ১৯৯৯ সালে এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, “কথিত আছে যে আমাদের নবজাগরণের প্রধান নায়ক রামমোহন রায় ইংল্যান্ডে যাত্রার সময় ফরাসি জাহাজে ফ্রান্সের বিপ্লবী তেরঙ্গা পতাকাকে সশ্রদ্ধ সেলাম জানানোর জন্য তড়িঘড়ি তাঁর জাহাজের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে আঘাত পান এবং বাকি জীবন খোঁড়া হয়ে থাকেন। রামমোহনের উত্তরাধিকারী আমরাও আন্তর্জাতিক হওয়ার দ্রুততায় বারবার সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গেছি এবং এখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে চলেছি।” কানেকটিভিটি নামক ধূম্রজালে বাংলাদেশের মান-মর্যাদা আর ঐতিহ্যকে সঁপে দেওয়ার মাধ্যাকর্ষণবিহীন ওই মানসিকতা ক্রমেই পেকে উঠছে এবং মিডিয়া মারফত আমাদের লিভিং স্পেসে দ্রুত ছড়াচ্ছে বলেই উপর্যুক্ত উদাহরণটা টানলাম।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের প্রাক্কালে বিপুল অর্থব্যয়ে ভারতের প্রধান প্রধান দৈনিকগুলোতে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের সাফল্য নিয়ে প্রচারণা, ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রয়োজনীয়তার নানা বয়ান ওই ক্রোড়পত্রে দেখা যায়। ‘ডিপ্লোমেটিস্ট’ নামের একটি অভিজাত ম্যাগাজিনের পুরো সংখ্যা ক্রোড়পত্র হিসেবে ছাপা হয়। যাতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ‘জয়বাংলা জয় হিন্দ’ স্লোগানের পাশাপাশি বাংলাদেশের অ-আওয়ামী শাসনকালকে অন্ধযুগ হিসেবে উল্লেখ করেন। এরই ক্রোড়পত্রে একটি অদ্ভুত নিবন্ধ দেখা যায়, বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ যার রচয়িতা। ‘দি ইমপারেটিভ ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন’ শিরোনামের এই লেখায় ড. সাদিক সফর শুরুর আগে যা বলেছেন, তার অনেকটাই যৌথ ইশতেহারে স্থান পেয়েছে। এতে বোঝা যায়, গোপনে গোপনে দুই সরকার জাতিকে না জানিয়ে লম্বা সময় ধরে এর খুঁটিনাটি তৈরি করেছে। তিনি বলেন, The north-east sub-region of South Asia encompasses the four countries of India, Bhutan, Nepal and Bangladesh. Both Bhutan and Nepal are land locked, presently their main access to seaport in through Kolkata. ভারতের নয় বরং বাংলাদেশ সরকারের স্পন্সর করা ওই লেখায় উত্তর-পূর্ব সাব রিজিয়নে একক বিদ্যুত্ গ্রিড ও কানেকটিভিটির ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, The range of cross-border transport project is large. The highest priority is the conversion of Chittagong, Mongla and Kolkata into modern international seaports to serve the needs for the reunite sub-region. The port traffic needs to be better connected through appropriate road-rail-inland water networks. Secondly give the pecularity of geopraphy, the north-east states of India can benefit tremendously through road-rail-inland waterway connections that link these states to the rest of India running through Bangladesh.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর দেশজুড়ে আলোচনা-উত্তাপ ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশে ফিরে জিয়া বিমানবন্দরে দলীয় সংবর্ধনা নিয়েছেন এবং বলে চলেছেন, তিনি এই সফরে শতভাগ জয়ী। এটা কি দেশের পরাজয়ের বিপরীতে তার ব্যক্তিগত জয়—এ প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে।
প্রথমেই একটি সীমাবদ্ধতার কথা না বলে পারছি না। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছে কতকগুলো শর্তে। এর একটি, বৈদেশিক সম্পর্ক যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বিশ্বের মাত্র দুটি সংবিধানেই এমন শর্ত দেখা যায়। একটি হচ্ছে ভারত, অপরটি বাংলাদেশ। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু তার `Discovery of India` গ্রন্থে ভারতের ভূগোলকে মধ্যএশিয়া থেকে কম্বোডিয়া পর্যন্ত সংজ্ঞায়িত করে বলেছিলেন, ক্ষুদ্র জাতিগুলো অস্তিত্ব বজায় রাখার যোগ্য নয়, বড়জোর তারা সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। এ লক্ষ্যে তিনি এমন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেন, যাতে স্বাধীনচেতা মিডিয়াও যেন খোলামেলা পর্যালোচনায় যেতে না পারে এবং ১৯৫১ সালে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে ওই বিষয়টি আনেন। যদিও ভারতের সংবিধানে ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’ বলে কোনো শব্দ নেই। বাংলাদেশের সংবিধানে ১৯৭২ সাল থেকেই এ শর্ত জুড়ে দেওয়া আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একমুখী করতে বা এ রাষ্ট্রকে ব্যর্থ, মৌলবাদী বলে ভারতীয় মিডিয়া ও রাজনৈতিক সমাজ আকছার গালাগাল দিলেও ভারতের সাংবিধানিক মহল ইচ্ছাকৃতভাবেই নিশ্চুপ। বাংলাদেশের অবস্থানটা ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত প্রেস কমিশনের রিপোর্টে স্পষ্ট। বর্ষীয়ান রাজনীতিক আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন এই কমিশনের পর্যবেক্ষণ ছিল এমন : `The restrictions on the Press in the interest of friendly relations have been opposed by many on the ground that the Press had displayed a keen and subtle perception of the susceptibilities involved in the foreign relations of Bangladesh.... stories critical of foreign states or certain aspects of the foreign policy of the National Government are found in newspapers of many countries. We are also of the view that the press should be free to express opinion and analyse development on relations with foreign state`.
হালের বাংলাদেশে শাসকদল ও সরকারের পরমতসহিষ্ণুতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সাংবাদিক-নির্যাতনের ঘটনা যেভাবে বাড়ছে, ‘আমার দেশ’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের জামিন বাতিলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার নজিরবিহীন বিরোধিতা সর্বোপরি ২০১০-এর ১/১১তে দিল্লি বনিবনার মুক্ত মূল্যায়নকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে দেখার ঘটনায় অনেকেই আজ উদ্বিগ্ন যে, সাংবিধানিক খড়্গ নেমে আসে কিনা। ভারতের সঙ্গে সই করা সন্ত্রাসবাদ দমনের চুক্তিতে ‘মিলিট্যান্ট’ শব্দটির সংজ্ঞার আড়ালে ভিন্নমতাবলম্বীদের এক হাত নেওয়ায় সুযোগ করা হয়েছে কিনা—কে জানে।
এ সত্য শিরোধার্য যে, প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ অধ্যুষিত দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত বৃহত্তম দেশ এবং পড়শীদের সঙ্গে তার গড়পড়তা সম্পর্ক অবিশ্বাসের। বোধ করি বিশ্বের আর কোনো বৃহত্ দেশ প্রতিবেশীদের অমন মাত্রার সন্দেহের শিকার নয়। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত ইতিহাসের নানা সময়জুড়ে অশান্ত থাকছে। গবেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় Inter and Intra state conflict মূলত ভারতেরই সৃষ্টি। শ্রীলংকায় এলটিটিই ও বাংলাদেশে ‘শান্তি বাহিনী’কে আশ্রয়, প্রশিক্ষণ ও গণহত্যায় ব্যবহার করতে ভারত ছিল সক্রিয়। তার ওপর কেন্দ্রের রক্ষচক্ষু শাসনের কারণে ভারতের নানা রাজ্যে সশস্ত্র আন্দোলনের জন্ম হয়েছে এবং ভারতকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা খাতে প্রচুর ব্যয় করতে হচ্ছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বৈষম্য দরিদ্র রাজ্যগুলোতে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
দক্ষিণ এশীয় মুক্ত সাংবাদিক সমিতি বা সাফমা’র মহাসচিব ইমতিয়াজ আলম এক প্রবন্ধে বলেছেন : `Most glaring aspect of poverty is that it is increasingly concentrated in the regions that have left behind in the course of an unequal development and growth. The phrase two India(s) exemplifies this difference in regional development outcomes. In 2002-2003, all India per-capita GDP was $ 480, the poorest seven states (accounting for 55 per cent of the population) had a per-capita GDP that was two thirds the national average, while in the richest seven states (33 per cent of the population) per-capita GDP was nearly double that of the poorest seven states`. মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান সংলগ্ন ভারতীয় অঙ্গরাজ্যগুলোতে দারিদ্র্য এবং তত্সূত্রে সৃষ্ট জঙ্গি তত্পরতার মাত্রা তীব্র। এসব গেরিলা তত্পরতাকে ভারত সীমান্তের ওপার থেকে সৃষ্ট বা আন্তর্জাতিক মৌলবাদী জঙ্গি অপপ্রয়াস বলে দাবি করে এলেও স্বনির্ভর সশস্ত্র মাওবাদী তত্পরতা বিশ্বের চোখ খুলে দিয়েছে। সুলেখিকা অরুন্ধতী রায় তো পরিষ্কার বলেছেন, চরম গরিবির কারণে ঝাড়খণ্ড থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যন্ত মাওবাদীরা ঘরে ঘরে।

নিরাপত্তা চুক্তি
২০১০-এর ১/১১তে দিল্লিতে বাংলাদেশ-ভারত বৈঠকে অপরাধ দমনে পারস্পরিক আইনি সহায়তা, দণ্ডপ্রাপ্তদের প্রত্যর্পণ, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সংঘটিত অপরাধ ও অবৈধ মাদক পাচার মোকাবিলা সংক্রান্ত তিনটি চুক্তি সই হয়েছে। চুক্তি তিনটির পূর্ণ বিবরণ সরকার এখন অব্দি প্রকাশ না করলেও জনমনে ধারণা, এসব ভারতের প্রয়োজন থেকেই হয়েছে। প্রয়োজনটা কী? দু’দেশের গোয়েন্দাদের নিয়ে যৌথ কমিটি হবে এবং গ্রেফতারকৃতদের তালিকা বিনিময় হবে। ১. বিচ্ছিন্নতাবাদী খোঁজার নামে বাংলাদেশের জন-শৃঙ্খলা, অপরাধবিষয়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভারত পুরো নজরদারিতে নিতে চায়। ২. সন্ত্রাসবাদ দমনে সার্কের সিদ্ধান্ত ও প্রটোকলগুলোর বাইরে ভারত বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান নিয়ে Cooperative Security System গড়তে চায়। জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সি রাজা মোহনের মতে : `Cooperative security recognizes the reality of profound interdependence among South Asian Nations in both economic and security realms`.—বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ওই কৌশলে ধরা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির তরফে এ চুক্তি পর্যালোচনায় বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইসরাইল ও ভারত সন্ত্রাসবাদের যে সংজ্ঞা (মুসলিম দমন) নিরূপণ করেছে, আওয়ামী লীগ সরকার নিরাপত্তা চুক্তির মাধ্যমে তাকে বাংলাদেশ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে টেনে আনল। ১৯৯৬ সাল থেকে একই চেষ্টা আওয়ামী লীগ করেছে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সময়। এটা নির্ভেজালভাবেই সংকীর্ণ রাজনৈতিক কৌশল। অর্থাত্ বাংলাদেশের ব্যাপকসংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে এক ধরনের উপজাতীয় অনুভূতিতে বিদীর্ণ করে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করা। এ তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক প্রামাণিকতার প্রয়োজন নেই এজন্য যে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পবিহীন বাংলাদেশে ক্রমাগত সাম্প্রদায়িকতার কথা বলে যাওয়ার রাজনীতিও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের খামোকা পশ্চাত্-মানসিকতায় নিক্ষেপ করে। আরেকটি জ্বলজ্যান্ত অভ্যন্তরীণ কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নিরাপত্তাজালে বন্দি হয়েছেন। ‘আমাকে বুলেট তাড়া করে ফিরছে’— প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্বেগের পুরো ফায়দা তুলতে ব্যস্ত ভারত। প্রধানমন্ত্রী একরকম গৃহবাসী নজিরবিহীন নিরাপত্তাবেষ্টিত, রাজধানীর বাইরে না বেরুনো এবং অধিক বিদেশ সফরে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা এক সরকারপ্রধানে পরিণত হয়েছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে কি ঘরে বসে ভিডিও কনফারেন্সিং? বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তার নির্মম হত্যাকাণ্ডের তুলনায় সে সময়ে তার সরকার উত্খাতের ষড়যন্ত্রকে বড় করে দেখেছেন কিনা জানি না, তবে বিদ্রোহী হত্যাকারীদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে একান্ত বৈঠক জনগণকে হতবাক করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে ভারতকেন্দ্রিক মাইন্ডসেটের কথা অথবা জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে ভারতকে জড়িয়ে ফেলার দৃষ্টান্ত নতুন কিছু নয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের গণরায় প্রত্যাখ্যান করে অক্টোবর মাসে এক দলীয় সভায় শেখ হাসিনা ভারতকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে কোনো বিদেশি প্রভুকে সন্তুষ্ট করার জন্য গ্যাস রফতানি করিনি। জানি না, এটাই আমাদের কাল হলো কিনা।’ তাহলে কি সেই আশঙ্কা থেকেই তিনি এখন ভারতের সব চাওয়া পূরণ করছেন?

ভারতের সঙ্গে চলো নীতি
১/১১-তে বাংলাদেশ-ভারতের দিল্লি সমঝোতাকে যদি সার্বিক মূল্যায়নে আনা হয়, তবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতি, জাতীয় নিরাপত্তা, অবকাঠামো, বিদ্যুত্ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশকে রহঃবমত্ধঃব করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার সাব্যস্ত করেছে, এখন থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ হাঁটবে ভারতের পিছু পিছু, একটি উপগ্রহ রাষ্ট্রের মতো। বাংলাদেশকে ভারতের ‘আস্থা’ অর্জন করতে হয়েছে এই অপরিমেয় বিনিময় মূল্যে। অথচ ভারতের কাছ থেকে আমাদের কোনো নগদ প্রাপ্তি নেই। এই সিদ্ধান্তটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপনে, একতরফাভাবে, ক্যাবিনেট বা সংসদে আলোচনা ছাড়াই নিয়েছেন। এটি কতখানি যুক্তিসঙ্গত ও জাতীয় স্বার্থবাহী? সেজন্যই প্রশ্ন উঠেছে, দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশ্চাত্যের বাজারি গণতন্ত্র ও অর্থনীতির প্রণোদনার মুখে চীন ও ভারতের মতো দুটি বিকাশমান অর্থনীতির মাঝে দাঁড়িয়ে বালাদেশের যেখানে ভারসাম্যমূলক অবস্থানকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা, সেখানে বাংলাদেশ একশ’ ভাগ ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এটাই হয়তো শতভাগ সত্য। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পুনর্গঠনে ভারতকে আগাম সমর্থন জানিয়ে বসেছে, যেখানে চীন ভারতের প্রার্থিতাকে নাকচ করেছে। এই যুক্ত ইশতেহার পড়লে যে কোনো পর্যবেক্ষকের ধারণা হবে, চীনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে ব্যবহারের পথে চলেছে বাংলাদেশ।
রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক মুক্তির জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর যে জাতি সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে, তার নাম বাংলাদেশ। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, ভারতের লাগাতার পানি-পরিবেশ-বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের মুখেও বাংলাদেশের মানুষ অনন্ত আয়ত্তির প্রেরণায় বিভোর, অর্থনীতিতে চমকপ্রদ সাফল্যের জন্য উন্মুখ, পরিশ্রমী, গণতান্ত্রিকভাবে সোচ্চার ও উদার জাতি হিসেবে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে, তখন এ ধরনের সিদ্ধান্ত জাতীয় মনস্তত্ত্বে এক বিরূপ প্রভাব ফেলবে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অনেক দুর্বল হয়ে যাবে।
ভারত সফরের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, নিরাপত্তা সংক্রান্ত তিনটি চুক্তি হবে। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, এ সফরটি আস্থা অর্জনের। বড় কোনো চুক্তি হবে না। অথচ আড়ালে ভারতের সঙ্গে যে ব্যাপক ও একমুখী সমঝোতা পাকাপাকি হচ্ছে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা দেওয়া হয়নি। কেন এই গোপনীয়তা? বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যথার্থই বলেছেন, ‘ভারত সফরে যাওয়ার আগে জাতীয় স্বার্থ ও সব সংবেদনশীল বিষয়ে আলোচনা করে একটি জাতীয় ঐকমত্য স্থাপন করা প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য ছিল। আমরা সে আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং জাতীয় অঙ্গনে প্রতিহিংসা ও বিভাজনের রাজনীতি এবং উত্তেজনাকেই তিনি উস্কে দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও আমরা একতরফাভাবে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও পরামর্শ তুলে ধরেছিলাম। তিনি সেসবও উপেক্ষা করেছেন।’ সাধারণত বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ সফরের আগে বিরোধী দলের মতামতকে সরকারপ্রধান বিদেশি সরকারপ্রধানের সঙ্গে আলোচনায় দরকষাকষিতে ব্যবহার করে থাকেন।
কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী দিল্লি যাওয়ার আগে বিরোধী নেত্রীর বক্তব্যকে পরিহাস করে নিজের দরকষাকষির শক্তিকে দুর্বল করে ফেলেছেন। বাংলাদেশের মানুষের কাছে আজ স্পষ্ট, তুলনামূলক বিচারে জননেত্রী শেখ হাসিনার চাইতে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বরাবর বাংলাদেশের স্বার্থকে ভারতের কাছে তুলে ধরেছেন। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে গণমানুষের অনুভূতিকে ধারণ করে বেগম জিয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত প্রতিবাদ করেছেন। অথচ আমাদের সরকার প্রতিবাদ কেন, সামান্য আপত্তিও রুজু করতে পারেনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু যেন না হয়, তা তিনি দেখবেন। তার এ উপলব্ধির কৃতিত্ব অথবা ভারত যদি টিপাইমুখ প্রকল্প থেকে সরে আসার ঘোষণাও ভবিষ্যতে কখনও দেয়, সে সাফল্যের শতভাগ কৃতিত্ব হবে বেগম খালেদা জিয়ার। বরাকের ওপর জলাধার নির্মাণের ব্যাপারে ২৫-২৬ জুন, ১৯৭২ এবং ২৮-৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২ যৌথ নদী কমিশনের যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ শাসন আমলে অনুষ্ঠিত প্রতিটি যৌথ নদী কমিশন মিটিংয়ে আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে একটি যৌথ সমীক্ষা দল গঠনের কথা ছিল। তা কখনো হয়নি। পরবর্তীকালে যৌথ নদী কমিশনের কোনো মিটিংয়ে এ বিষয়ে আর আলোচনা হয়নি। বরং ১৯৮৭-৮৮ সালে উপর্যুপরি দু’বছর বাংলাদেশে প্রলয়ংকরী বন্যার পর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বন্যা ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স দু’দেশের পানিসম্পদ সচিবদের নেতৃত্বে গঠিত হয়। ওই রিপোর্টে বাংলাদেশ সুস্পষ্টভাবে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের বিরোধিতা করে এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়, টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের সিলেট এলাকায় বন্যা প্রশমনে কোনো ভূমিকা রাখবে না।
২০০১-০৬ সালে চারদলীয় বিএনপি জোট সরকারের আমলে যৌথ নদী কমিশনের ৩৬তম সভায় বাংলাদশ।

No comments

Powered by Blogger.