নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-আওয়ামী লীগের শিশুরা কবে বড় হবে? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের বিভক্তি ও কোন্দল নিয়ে পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। এ ব্যাপারে দলের হাইকমান্ড যে অবহিত ও উদ্বিগ্ন, শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বক্তব্য ও উদ্যোগ থেকেই তা বোঝা যায়। কয়েক দিন আগে চট্টগ্রাম সফরকালে প্রধানমন্ত্রী এখানকার তিনজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে কোন্দল মেটানোর দায়িত্ব দিয়েছেন।


দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকেরা এ উদ্যোগের সাফল্য দেখতে উদ্গ্রীব। কিন্তু যাঁরা সর্বক্ষণ ‘তালগাছ আমার’ ফর্মুলা আঁকড়ে থাকতে চান, সেই নেতাদের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
গত জানুয়ারিতে নগর আওয়ামী লীগের মহিউদ্দিন অনুসারীদের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সহসভাপতি সাংসদ নুরুল ইসলাম, যুগ্ম সম্পাদক আফছারুল আমীনসহ চারজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। এর মাত্র কয়েক দিনের মাথায় নুরুল ইসলাম ও আফছারুল আমীনের অনুসারীরা সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক এনামুল হককে বহিষ্কার করেন। বলা বাহুল্য, এই পাল্টাপাল্টি কর্মকাণ্ডের কোনোটিই দলের গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এ কারণেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক সভায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আপনারা কি গঠনতন্ত্র পড়েন না?’
কয়েক মাস ধরে নগর আওয়ামী লীগে চলছে অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য মেরুকরণ। একদিকে দীর্ঘদিনের বিরোধ ভুলে সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন দলে প্রভাবশালী অথচ পদবঞ্চিত নেতা আ জ ম নাছিরউদ্দিন এবং বর্তমান সাংসদ এম এ লতিফ। অন্যদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফছারুল আমীন ও নুরুল ইসলামের হাত ধরেছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেনের মতো মহিউদ্দিনের কাছের মানুষেরা। সাবেক জাতীয় ছাত্রলীগ সভাপতি খোরশেদ আলম ওরফে সুজনের মতো অনেকেই আছেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়। ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ ভেবে না পেয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন অনেক নেতা-কর্মী।
নগর আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক মেরুকরণকে কেন অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য বলা হলো, তা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। ভেবে দেখুন, চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যখন মহিউদ্দিনের প্রবল প্রতাপ চলছে, তখন তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে রাজনীতিতে টিকে ছিলেন আ জ ম নাছিরউদ্দিন। এ দুজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিশ্চয়ই অসম ছিল, কিন্তু এই উপদলীয় বিভাজনের কারণেই তো দলে একচ্ছত্র হয়ে উঠতে পারেননি মহিউদ্দিন। সেই মহিউদ্দিন ও নাছির হঠাৎ দীর্ঘদিনের শত্রুতা ভুলে একত্র হয়েছেন—এই সংবাদ হয়তো স্বস্তিকর, কিন্তু মাঠপর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের শত্রুতা কি সহজে বন্ধ হবে?
সাংসদ লতিফের সঙ্গে মহিউদ্দিনের বিরোধের ইতিহাস দীর্ঘ না হলেও এতে আছে অনেক দুঃখজনক ঘটনা। চট্টগ্রামে লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থার কর্তৃত্ব নিয়ে এ দুজনের বিরোধের জের ধরে মহিউদ্দিনের উপস্থিতিতেই সাংসদ লতিফকে লাঞ্ছিত করেছিলেন তাঁর কর্মী-সমর্থকেরা। দেশ ও জাতির স্বার্থে না হোক, দলীয় রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার স্বার্থে যে নেতারা সবকিছু ভুলে যেতে পারেন, এটা তারই উদাহরণ!
অন্যদিকে কিছুদিন আগেও ব্যবসায়ী-রাজনীতিক আবদুচ ছালামের জন্য কী না করেছেন মহিউদ্দিন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নগরের একটি আসনে (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) তাঁকে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তাঁকে সিডিএ চেয়ারম্যান পদে নিয়োগের জন্য হাইকমান্ডের কাছে মহিউদ্দিনই তদবির করেছেন বলে শোনা যায়। আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষের পদও মিলেছিল ছালামের। কিন্তু হঠাৎ সে সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ল। মহিউদ্দিনের কাছাকাছি যাঁরা থাকেন তাঁরা জানেন, ঘনিষ্ঠ লোকজনের উপকার যেমন তিনি করেন, তেমনি তাঁদের সঙ্গে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে দুর্ব্যবহার করা তাঁর অধিকার মনে করেন, এতে অন্যের মর্যাদায় আঘাত লাগে কি না, তা ভাবতে অভ্যস্ত নন তিনি। এ কারণেই তাঁর সঙ্গ ছেড়েছেন ছালাম, ইব্রাহিম হোসেনসহ এককালের ঘনিষ্ঠজনেরা।
এ যোগ-বিয়োগের রাজনীতির সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ হচ্ছে মাঠপর্যায়ের কর্মী-সমর্থকেরা। নেতাদের মধ্যে হঠাৎ বিচ্ছেদের ফলে মাঠের কর্মীদের মধ্যে সৌহার্দ্য থাকা সত্ত্বেও ভাঙনের সুর বেজে উঠেছে। আবার অন্যদিকে নেতাদের মধ্যে হঠাৎ মিলন সত্ত্বেও তাঁদের মাঠের কর্মীরা পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস সরিয়ে কাছে আসতে পারছেন না সহজে। এ বিভ্রান্তি দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রামের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কারের ঘটনায় ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ‘বহিষ্কারের নামে আপনারা শিশুর মতো আচরণ করছেন, আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের জন্য এটা লজ্জাকর।’
চট্টগ্রামের ‘বুড়ো খোকা’রা তাঁর এই বক্তব্য কতটা অনুধাবন করেছেন জানি না কিন্তু এখনো তাঁদের শিশুসুলভ আচরণ পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, এসব নেতাকে ঢাকায় ডেকে নিয়ে সমঝোতা বৈঠক করা হবে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগেও সে রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ফল যে কিছু হয়নি তার প্রমাণ নির্বাচনের সময় দলীয় নেতাদের কর্মকাণ্ড এবং সর্বোপরি নির্বাচনের ফল। এবারও সে রকম নিষ্ফলা বৈঠক করলে নগর আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব ঘুচবে না। দলীয় হাইকমান্ডকে এ ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। বুড়োরা যখন শিশুদের মতো আচরণ করেন, তখন তাঁদের জন্য একটু কড়া শাসনই দরকার।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.