কৃষি-তামাক নয়, খাদ্যফসলেই চাষির তুষ্টি by ফরিদা আখতার

শীতে বা রবি মৌসুমে আমাদের দেশে ধানসহ প্রচুর খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়, বিশেষ করে ডাল, আলু, গম, সরিষা আর নানা রকম সবজি; যেমন—টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি এবং আরও অনেক খাদ্যফসল। সেদিক থেকে শীতকাল কৃষকের জন্য আনন্দের মৌসুম। একদিকে গোলায় নতুন ধান, অন্যদিকে মাঠে নানা রকমের খাদ্যফসল।


এ সময় ফসলের মাঠের দিকে তাকিয়ে চোখে শর্ষে ফুল দেখে ভয় লাগে না বরং মনে খুব আনন্দ হয়। কিন্তু দেশের কিছু জেলায় গত কয়েক বছরে এই দৃশ্যের পরিবর্তন হয়েছে। কুষ্টিয়া, যশোর, ঝিনাইদহ, রংপুর, মানিকগঞ্জ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটিতে আমরা শীতের মৌসুমে খাদ্যফসলের জমিতে তামাক উৎপাদন করতে দেখেছি এবং এ বছরেও দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া আরও অনেক জেলায় তামাক চাষ শুরু করা হচ্ছে। তামাকের পাশাপাশি শীতের মৌসুমে পাল্লা দিয়ে শহরের কাছে, ধানি জমি বা খাদ্যফসলের জমিতে ইটভাটার চুল্লিগুলো নির্লজ্জভাবে ধোঁয়া তুলতে শুরু করে। পরিবেশবাদীরা এ বিষয় নিয়ে কিছু কথা বললেও নির্মাণ সংস্থাগুলো নির্বিঘ্নে কোনো নিয়ন্ত্রণ বা নীতি না মেনেই তাদের কাজ চালিয়ে যায়।
দেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে বলে আমরা প্রায়ই শুনতে পাই। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বছরে গড়ে এক শতাংশ আবাদি জমি কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবমতে, ১৯৮৩-৮৪ সালে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল দুই কোটি এক লাখ ৯৭ হাজার ৫৬৪ একর, ২০১০ সালে এসে তা হয়েছে এক কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার ৫৪৪ একর (যুগান্তর, ২০ ডিসেম্বর ২০১০) অর্থাৎ প্রায় ১১ লাখ একর জমি ফসলের আবাদ থেকে কমে গেছে। সাধারণত আবাদি জমি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি নির্মাণকে চিহ্নিত করা হয়। এর ফলে খাদ্যঘাটতির আশঙ্কা যে রয়েছে, তা তুলে ধরা হয়। যুগান্তর-এর এই প্রতিবেদনে কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের বরাতে বলা হয়, ২০০৯ সালে আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক কোটি ৩০ লাখ মেট্রিক টন, কিন্তু উৎপাদিত হয়েছে এক কোটি ২০ লাখ টন, অর্থাৎ ১০ লাখ টনের ঘাটতি ছিল। আমন ধানের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়নি। ২০০৯ সালের বোরো মৌসুমের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও উৎপাদিত হয়েছে মাত্র এক কোটি ৪০ হাজার মেট্রিক টন। ঘাটতি হয়েছে প্রায় নয় লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। এই যখন খাদ্যঘাটতির অবস্থা, তখন খাদ্যফসলের জমিতে অখাদ্যফসল তামাকের চাষ দিনে দিনে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেভাবে ছুটছে এবং খাদ্য উৎপাদনের উর্বর জমি দখল করে নিচ্ছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এ এক মারাত্মক হুমকি। এই সরাসরি সম্পর্কের দিকটি সরকারি কোনো পরিসংখ্যানে তুলে ধরা হচ্ছে না। গত বছর (২০১০) তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের পাতার দাম বেশি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কারণে চাষ ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল, প্রায় এক লাখ ৮২ হাজার ৭৮০ একর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য এবং গবেষণাপ্রতিষ্ঠান উবিনীগের তথ্য থেকে জানা গেছে। এসব জমিতে খাদ্যফসল চাষ হওয়ার কথা ছিল। শুধু বান্দরবান জেলার দুটি উপজেলা লামা ও আলীকদমের সাত হাজার ২১১ একর জমিতে তামাক চাষ করার কারণে ১৪ কোটি ৭৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকার খাদ্যফসল করা যায়নি বলে উবিনীগ গবেষণায় জানা গেছে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় ২০ হাজার একর জমিতে তামাক চাষের কারণে ১৪ কোটি ২৪ লাখ টাকার খাদ্যফসল আবাদ হয়নি। এই হিসাব দেশব্যাপী করা হলে যে সংখ্যা দাঁড়াবে, তা দেখে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কেউই স্বস্তি বোধ করবেন না। কৃষিজমিতে অকৃষিকাজ করলে আবাদি জমির পরিমাণ কমছে বলে সহজভাবে চোখে পড়ে, কিন্তু খাদ্যফসলের জমিতে তামাক কোম্পানির ভাষায় ‘সবুজের সমারোহ’ দেখে মুগ্ধ হলেও তা যে খাদ্যঘাটতির জন্য হুমকি, তা নীতিনির্ধারকেরা দেখেও কেন দেখেন না?
গত বছর (২০১০) ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া এবং ঢাকা থেকে বান্দরবানে যাওয়ার সময় হাইওয়ের দুই পাশে এবং বিভিন্ন ফসলের মাঠে শুধু তামাক আর তামাক দেখে আতঙ্কিত হয়েছিলাম। আরিচা দিয়ে যেতে পাটুরিয়া ঘাটের আগে মানিকগঞ্জের খাদ্যফসলের জমিতে, চলনবিলে, নাটোরের বনপাড়ায় এবং কুষ্টিয়ার মিরপুর ও দৌলতপুরে যেন তামাক চাষের ধুম লেগেছিল। একইভাবে চট্টগ্রাম পার হয়ে কক্সবাজারের পথে চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদীর পাড়ে এবং বান্দরবানে ব্যাপক তামাক চাষ দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। কারণ ছিল, তামাকের পাতার দাম ১২০ থেকে ১৫০ টাকা কেজিপ্রতি দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। আমি এরপর মার্চ-এপ্রিল মাসে কুষ্টিয়া ও বান্দরবানে গিয়ে কৃষকের মধ্যে ক্ষোভ দেখেছি, কোম্পানির ক্রেতারা তামাকের পাতা সরবরাহ বেশি দেখে দাম কমিয়ে দিয়েছেন। কৃষক তামাক বিক্রি করতে এসে প্রতারিত হয়েছেন। চকরিয়ায় কৃষকেরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন, কুষ্টিয়ায় কোম্পানির কুশপুত্তলিকা গাছে গাছে ঝোলানো দেখা গেছে। দৌলতপুরের একটি গ্রামে একজন কৃষক নির্দিষ্ট দামে বিক্রি করতে না পেরে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গত বছর তামাক বিক্রি করতে না পেরে এখনো অনেক কৃষকের বাড়িতে তামাকপাতা রয়ে গেছে, তামাকপাতা থেকে বের হওয়া গ্যাস বাড়ির মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে আছে। কৃষকেরা বলেন, ‘তামাক এমনই জিনিস যে মেখে দুটো ভাত খাব, তারও উপায় নেই বা ঘরের কোনো কাজে লাগানোও সম্ভব নয়।’ এর ব্যবহারকারী এবং ক্রেতা একমাত্র তামাক কোম্পানি, তারা না নিলে কৃষকের সর্বনাশ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তামাক বিক্রি হলে নগদ টাকা আসে, বিক্রি না হলে ঘরে রাখা তামাকের গ্যাস ফুসফুস আক্রান্ত করে। তামাক চাষ করলেই সব কৃষকের কাছ থেকে কোম্পানি পাতা কেনে না, একমাত্র কোম্পানির কার্ডধারীদের সঙ্গেই তাদের ভালোবাসার সম্পর্ক আছে। অন্য চাষিরা তামাক কার্ডধারীদের পক্ষে চাষ করেন এবং পাতা বিক্রি করতে পারলে ভালো, না হলে কিছু করার নেই। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দেখেছি, শেষে তামাকের গোড়াটাও জমি থেকে তোলেননি। কারণ এর মধ্যে অন্য ফসল চাষ করার সময়ও পার হয়ে গেছে আর ইতিমধ্যে তামাক চাষের জন্য সার-কীটনাশকসহ নানা খরচের কারণে ঋণগ্রস্ত কৃষক মাথায় হাত দিয়ে বসে থেকেছেন।
যেকোনো কৃষিফসলের মতো আগের বছরের অভিজ্ঞতা থেকে শিখে এই বছর, অর্থাৎ ২০১০-১১ রবি মৌসুমে, তামাক চাষে অতিষ্ঠ হাজার হাজার কৃষক খাদ্য উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাই এবার চলনবিলে তামাক চাষ দেখা যায়নি বললেই চলে, সেখানে রসুন, পেঁয়াজ, সরিষা, গমসহ রকমারি ফসল; নাটোরের বনপাড়ার রাস্তার দুই পাশে অনেক গমখেত, কুষ্টিয়ায় বোরো ধান, রাই সরিষা, মসুর, আলু, মটর, গম—নানা রকম ফসল চোখে পড়েছে। তামাক নেই তা নয়, তবে লালন সেতু পার হওয়ার পর দুই পাশে যেভাবে তামাক আর তামাক ছিল, এবার তা না দেখে চোখে শান্তি লেগেছে। বান্দরবানের আলীকদমেও কৃষকেরা তামাক চাষ বন্ধ করে দিয়ে মুলা, আলু, রঙিমা শিম, ফেলন, বেগুন, মরিচ ইত্যাদি চাষ করেছেন। উল্লেখ্য, ২০১০ সালের আগস্ট মাসে বান্দরবানের আদালতে দুজন সাংবাদিকের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এই জেলায় এক হাজার একরের বেশি জমিতে তামাক চাষ না করতে কোম্পানির ওপর নির্দেশ দিয়েছেন জেলা জজ আদালত। ধানি জমিতে এবং সাংগু ও মাতামুহুরী, বাকখালীর চরে সব আবাদযোগ্য জমিতে তামাক চাষ হওয়ার কারণে ধান ও অন্যান্য খাদ্যশস্য কমে গেছে বলে এই জেলার মানুষ অন্য এলাকা থেকে খাদ্যশস্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। তাই জনস্বার্থে করা এই মামলার প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল। কোম্পানির কার্ডধারী কৃষক ছাড়া বেশির ভাগ কৃষক তামাক চাষ বন্ধ করে দিয়েছেন। যাঁরা তামাক চাষ করেছেন, তাঁদের তামাকের পাতা খুব ভালো হয়নি, কুঁচকে গেছে কিংবা পাতার ওপর সাদা চিতার মতো হয়েছে। স্থানীয়ভাবে তাঁরা বলছেন, ‘ফওলা’ রোগ বা পাগলা রোগ ধরেছে। কেউ বলছেন, অক্টোবর মাসে আদালতের রায় কার্যকর হওয়ার আগে লাগাতে গিয়ে কোনো কোনো তামাকচাষি আমন ধান পাকার আগেই কেটে ফেলে তামাক লাগিয়েছেন, যেন আদালতের বিষয় এড়িয়ে যাওয়া যায়, ফলে ধানের অভিশাপ লেগেছে কিংবা পাপে ধরেছে। যাঁরা খাদ্য উৎপাদন করতে শুরু করেছেন, তাঁদের মধ্যে একধরনের স্বস্তির ভাব দেখলাম।
কুষ্টিয়াতেও তামাক চাষ বন্ধ করে নিজ উদ্যোগে খাদ্যফসল করতে দেখলাম। যাত্রাপথে এক জায়গায় থেমে বি আর-২৬ ধান চাষ করছেন এমন এক যুব বয়সের কৃষকের কাছে জানতে চাইলাম, তামাক বাদ দিয়ে কেন ধান করছেন? উত্তর এল, ‘কম বয়সে ছ্যাঁকা খেয়েছি, তাই তামাক আর করব না। গত বছর ১০ কাঠায় সাত হাজার টাকা খরচ করে পেয়েছি মাত্র পাঁচ হাজার টাকা।’ আরেকটি গ্রামে এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর সঙ্গে দেখা। সে তার বাবার চাষ করা আলুখেত দেখাল, যেখানে গতবার তামাক চাষ করেছে। সে জানাল, এবার তামাক চাষ করলে তার পক্ষে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হতো না, কারণ এ সময় পাতা তুলতে হয় এবং পরিবারের সবাইকে প্রচুর খাটতে হয়। তার চোখেমুখে আনন্দের হাসি, কারণ সে পরীক্ষা দিতে পারছে।
সরকার তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করার জন্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে সারের ভর্তুকি না দেওয়া, তামাক চাষের জন্য ব্যাংকের ঋণসুবিধা না দেওয়া এবং তামাক রপ্তানির ওপর ১০ শতাংশ কর আরোপ করা। কৃষকেরা এতে খুশি কিন্তু তাঁদের আরও কিছু সহায়তা প্রয়োজন। যেমন—বীজ ও ফসলের বাজারজাতের সুবিধা দেওয়া। তামাক কোনো শখের ফসল নয়, খাদ্যফসল উৎপাদনে সহযোগিতার অভাব ঘটলেই তাঁরা তামাক চাষে বাধ্য হন। এতে তাঁদের কোনো তুষ্টি নেই। আশা করি, খাদ্যঘাটতি মোকাবিলার প্রশ্নে খাদ্যের জমিতে তামাক চাষ বন্ধের জন্য সরকারের উদ্যোগ আরও বাড়বে।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.