সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী-বিপদে আছি, এটা গণতন্ত্রের বিপদ

প্রথম দিন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, ফারুককে ব্ল্যাকমেইল ও হাইজ্যাক করার জন্য গাড়িচালক পিলখানায় ঢুকে পড়ে। কিন্তু তিন দিন পর তিনি বললেন, এটা একটি ঐক্যবদ্ধ গোষ্ঠীর তৎপরতা। এই গোষ্ঠী ৪০ বছরের সুবিধাভোগী আমলা, রাজনীতিক ও ঠিকাদার।


সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদার ও রেলের পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা বিপুল পরিমাণ টাকাসহ ধরা পড়ার পর এ নিয়ে যখন দেশজুড়ে তুমুল হইচই, এমন সময় সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন রেলমন্ত্রী। কাল বৃহস্পতিবার রেলভবনে সাংবাদিকদের একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়েন তিনি। বলেন, এ ঘটনায় তিনি কঠিন অবস্থায় আছেন, বিপদের মধ্যে আছেন। তবে এটা তাঁর ব্যক্তিগত বিপদ নয়, এটা গণতন্ত্র ও সত্যের বিপদ। এই বিপদ কাটিয়ে উঠতে হবে।
দায় কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করবেন কি না কিংবা প্রধানমন্ত্রী আপনাকে পদত্যাগ করতে বলেছেন কি না—এমন প্রশ্নে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘একজন রাজনীতিকের কাছে পদ অর্জন সাংঘাতিক বিষয় নয়। ত্যাগ করাও সহজ। যদি অবস্থান এই দিকে নিয়ে যায়, আমার জন্য সহজ। এক মুহূর্তও দেরি করব না। তবে শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করে যাব। প্রবীণ রাজনীতিবিদের কাছে মন্ত্রিত্ব স্থায়ী কোনো পদ নয়। মন্ত্রিত্বে থাকা-যাওয়া বড় ঘটনা নয়। স্থায়ী পরিচয় হচ্ছে রাজনীতিবিদ ও সাংসদ।’ গত মঙ্গলবার প্রথম দিনেই তিনি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন বলে জানান। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে পদত্যাগ করতে বলেছেন কি না, তা তিনি খোলাসা করেননি।
সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয় কাল বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায়। ঠিক সময়ই হাজির হন মন্ত্রী। এসেই তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে খারাপ আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। বলেন, তাঁর এপিএসের টাকাসহ ধরা পড়ার ঘটনাটি একেবারেই অনভিপ্রেত। সংবাদ সম্মেলনে তিনি কখনো হেসেছেন, কখনো ছিলেন বিমর্ষ। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর কী কী উন্নতি করেছেন, বক্তব্যের শুরুতে তিনি তার বর্ণনা দেন।
সাংবাদিকেরা জানতে চান, টাকাসহ ধরা পড়া চারজনই গণমাধ্যমে স্বীকার করেছেন যে, তাঁরা মন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য বলুন। মন্ত্রী বলেন, ‘মধ্যরাতে আমার বাসায় যাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি রাত ১০টার সময় ঘুমাই। ১২টার সময় কারও সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ নেই। এপিএসের বাড়ি মোহাম্মদপুরে। সেদিকেই হয়তো যাচ্ছিল তারা।’ খবর বেরিয়েছে, সোমবার রাতে এপিএসসহ আটক কর্মকর্তাদের ছাড়িয়ে আনতে আপনি পিলখানায় গিয়েছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী বলেন, ‘ধরে রাখা বা ছেড়ে দেওয়ার তদবির করার মতো লোক আমি নই।’
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। দুর্নীতির সঙ্গে আপস করব না। মন্ত্রীর বাড়িতে থাকি না। জিগাতলার বাড়িতেই থাকি। রেলের ৪০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে। শ্রমিক লীগও আছে। বিপদে-আপদে পড়লে তো সবাই সাহায্য নেবেই।’ তাঁর মন্তব্য, এপিএস ও রেলের জিএমের ব্যক্তিগত জীবনের খবর রাখা মন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব নয়।
মধ্যরাতের টাকা কেলেঙ্কারি সম্পর্কে রহস্য খোঁজার চেষ্টা করে মন্ত্রী বলেন, ঘটনার পরপরই টিভি ক্যামেরা উপস্থিত। তারপর চালকের বক্তব্য প্রচার। এরপর মন্ত্রীর পদত্যাগ ও গ্রেপ্তারের দাবি। এরপর বলা হবে সরকারের পদত্যাগ।
কেউ বলছে ৩৫ লাখ, কেউ ৭০ লাখ, আবার কারও দাবি চার কোটি ৭০ লাখ। এপিএসের গাড়িতে আসলে কত টাকা ছিল, টাকাগুলো এখন কোথায়? জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী হাসতে হাসতে বলেন, ‘চার কোটি ৭০ লাখের কথা তো শুনিনি। চার কোটি ৭০ লাখ টাকা চারজনে তো বয়ে নিতে পারবে না। টাকার অবস্থান কোথায়, এটা আমারও প্রশ্ন। এ জন্যই তদন্ত কমিটি হয়েছে। টাকা নিয়ে তারা বেশ কিছু সময় বিজিবির অধীনে ছিল। বিজিবি বলতে পারবে। কত টাকা ছিল সেটাও বিজিবি বলতে পারবে। তদন্ত কমিটিও জানতে পারবে।’
টাকার পরিমাণ যা-ই হোক, এত টাকা এপিএসের বহন করা অস্বাভাবিক কি না, জানতে চাইলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘এটা অস্বাভাবিক তো বটেই। তবে এপিএস এই টাকার মালিকানা দাবি করেছে। এখন তাকে প্রমাণ করতে হবে এটা তার টাকা কি না। আর যদি অঘোষিত টাকা হয় তাহলে সেটা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে চলে যাওয়ার কথা।’
টাকা কেলেঙ্কারির পর এপিএসের সঙ্গে কথা বা দেখা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী বলেন, ‘ফারুকের সঙ্গে দেখা হয়নি। না আসার জন্য কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত বক্তব্য দিতে বলা হয়েছে।’
একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, সারা জীবন আপনি অন্যের দিকে তির ছুড়েছেন। এবার সব তির আপনার দিকে—অনুভূতি কেমন? হাসতে হাসতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘আজীবন আমি খালি তির ছুড়েছি। তিরের কী ব্যথা আমি বুঝিনি। এবার তির আমার দিকে। তিরের বেদনা বুঝেছি। এরপর আসবে বন্দুক। তবে তির ছোড়ার কাজে ছিলাম। বাকি জীবনও চলবে।’
প্রশ্নের জবাবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, নিয়োগ-বাণিজ্য তদন্তে নিরপেক্ষ কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। রেল মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি তদন্ত কমিটি করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করতে চাইলে মন্ত্রণালয় সহায়তা করবে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন নয়। হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করতে পারেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও তদন্ত করতে পারে।
রেলের বড়কর্তার টাকাসহ ধরা পড়ার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ইউসুফ আলী মৃধার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার তাঁর নেই। এটা উচ্চতর কর্তৃপক্ষের অধীন।

No comments

Powered by Blogger.