এই দিনে-সাতই মার্চের স্মৃতি by শর্মিলা সিনড্রেলা

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ অন্য রকম একটি দিন। বলা যায়, এই দিনে এক বাঁশিওয়ালা শুনিয়েছিলেন তাঁর বাঁশি। কিংবা বলা যায়, এক কবি সারা জাতিকে শুনিয়েছিলেন মহাকাব্যের মতো এক কবিতা। তখনকার রেসকোর্স ময়দানে জড়ো হওয়া মানুষ সেদিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো আবিষ্ট হয়েছিল সেই বজ্রকণ্ঠে।


দেশের মানুষ সেদিন একটি দণ্ডে একাত্ম হয়েছিল—সেদিনই প্রথম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ভাষণটি কখনো পুরোনো হওয়ার নয়। একটি রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
সেদিন কারখানা থেকে উঠে এসেছিলেন শ্রমিক, চষা জমি থেকে কাদামাখা খালি পায়ে এসেছিলেন কৃষক। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছিল ছাত্ররা, অফিস ফেলে জনসভায় যোগ দিয়েছিলেন চাকুরেরা।
মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে যাদের জন্ম, তারা কেবল কল্পনায় দেখতে পারে সেই সময়টা। তাই যাঁরা সেদিন রেসকোর্স ময়দানে শুনেছিলেন সেই ভাষণ, তেমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। এঁরা সেই শ্রেণীর মানুষ, যাঁরা রাজনীতি করেন না, জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে মুগ্ধ করতে পারেন না শ্রোতাকে, জীবনসংগ্রামেই যাঁদের কেটে যায় দিন-রাত। কিন্তু এঁদের চোখগুলো স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে দিনবদলের। একাত্তরেও এঁদের চোখে স্বপ্ন ভর করেছিল।
সত্তরের নির্বাচনের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা শেখ মুজিবুর রহমানের। ক্ষমতায় আসার কথা আওয়ামী লীগের। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১ মার্চের বেতার ভাষণে স্থগিত করলেন পরিষদের সভা। এ যেন বারুদে লাগল আগুন। দুই দশকের বেশি সময় ধরে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলার মানুষকে শোষণ করেছে। বাংলার মানুষ হয়েছে বঞ্চনার শিকার। দেয়ালে ঠেকেছে পিঠ। তাই এবার এসপার-ওসপার হওয়ার সময় এসেছে। সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সেই দিকনির্দেশনাই দিয়েছে।
যাঁরা ১৯৭১ সালে দেশের ভয়াবহ সংকটের সময় এই ভাষণ শুনেছিলেন, তাঁদের অনুভূতি কেমন ছিল? জানতে হলে শুনতে হবে তাঁদেরই কথা, যাঁরা সেই সময়ে শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য জড়ো হয়েছিলেন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে, সাক্ষী হয়ে আছেন সেই মহাক্ষণের।
ফার্মগেটের গ্রন্থকুটিরে বই দেখছিলেন রিয়াজ মোর্শেদ। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চাকরি থেকে এখন অবসর নিয়েছেন। স্মৃতিকাতর হয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সাল। আমি কেবল বিকম পরীক্ষা দিয়েছি। সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন। আমরা কয়েকজন বন্ধু ভাষণ শুরুর আগেই ময়দানে গিয়ে হাজির। অনেক অপেক্ষার পর বঙ্গবন্ধু যখন এলেন, তখন জনতার কী উচ্ছ্বাস! সেই ভাষণের পরে যে পরিবর্তন দেশে এসেছে, তাতে আমিও শামিল হয়েছি।’
কারওয়ান বাজারের কাঁচামালের ব্যবসায়ী সাহেব আলীর কাছে দিনটি এখনো জীবন্ত। তিনি বলেন, ‘আমার তখন বয়স ১৬ কি ১৭। ভাষণ শুনে শরীরের রক্ত গরম হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, এখনই দেশটাকে স্বাধীন করার কাজে নেমে পড়ি। এখনো রেডিও বা টিভিতে ওই ভাষণ যখন শুনি, তখন মনে হয় বঙ্গবন্ধু জীবিত আছেন। ভাষণটা এতটাই জীবন্ত।’
পান্থপথের বেতের আসবাবের দোকানগুলোর সামনে দেখি তিনজন প্রবীণ গোল হয়ে বসে গল্প করছেন। এগিয়ে গিয়ে ৭ মার্চে তাঁদের অনুভূতি কেমন ছিল তা জানতে চাই। তিনজনই পান্থপথে ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এঁদের একজন আলী আকবর বলেন, ‘ওইটাই ছিল বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালো ভাষণ। আর কেউ অমন ভাষণ দিতে পারে নাই। তখন আজিমপুরে থাকতাম। একটা গ্লাস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতাম। শেখ মুজিবকে কখনো দেখিনি আগে, তাই ফ্যাক্টরির সবাই মিলে গেছি ভাষণ শুনতে।’ আড্ডার আরেকজন সঙ্গী আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘শেখ মুুজিবের ভাষণ শুনলে পশম দাঁড়িয়ে যায়। যুদ্ধ শব্দটা শুনলেই ভয় হয়, তার পরও এই ভাষণই অনেককে যুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেছিল।’ লিয়াকত আলীর সৌভাগ্য হয়নি সেই সময়ে ভাষণটি শোনার। কিন্তু এখনো যখন শোনেন, তখন মনে হয়, ‘দেশের যে পরিবর্তন সবাই চেয়েছিল, শেখ মুজিবের ভাষণ সেই পরিবর্তন আনতে সাহায্য করেছিল।’
শাহবাগের বংশীবাদক লাবু মিয়া বলেন, ‘সাতই মার্চের ভাষণ শুনে ছোট বাচ্চারাও চেয়েছে যুদ্ধে যেতে। আমারও যুদ্ধে যাবার আগ্রহ ছিল। বাবা-মা যেতে দেয়নি। কিন্তু আমার ভাই আমজাদ হোসেন এই ভাষণটি শোনার পর সেই যে যুদ্ধে গেছেন, আর ফিরে আসেননি। শুধু ঢাকার মানুষই নয়, দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষ তখন গাড়িঘোড়ায় চেপে নদী-নালা পাড়ি দিয়ে এসেছিল শুধু এই ভাষণ শুনতে।’ পাশেই বসে ছিলেন আর এক প্রবীণ মমিন আলী মৃধা। তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ সরাসরি শুনেছি। ভাষণের ছবিতে যে লক্ষ-কোটি মাথা দেখা যায়, সেখানে আমারও মাথা আছে। সেদিনের আর কারও ভাষণের কথা মনে পড়ে না, কেবল ওনার ভাষণটাই কানে বাজে। এই রকম একটা সময়ের সাক্ষী আমি—এটাই অনেক বড় সৌভাগ্য আমার।’
বাঙালির জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর একটি দিন ছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে যে দেশটির দেখা মেলে, তার অবয়ব তৈরির কাজটি করেছিল ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ।

No comments

Powered by Blogger.