দেখার ভেতরে বাইরেঃ বিতর্ক চাই ঝগড়া নয় by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান

‘তর্ক’ শব্দটি, ‘কথায় কথায় তর্ক করে’—এমন না হলে, বেশ প্রশংসার। তার্কিক, তর্কবাগীশ, তর্করত্ন, তর্কালঙ্কার, তর্কশাস্ত্রী—এসব বিশেষণ যাদের নামের আগে ব্যবহৃত হয়, তারা সবাই মহান ব্যক্তিত্ব। এই সবগুলো বিশেষণই প্রশংসাসূচক। কিন্তু ‘ঝগড়া’ শব্দ থেকে যে একটাই বিশেষণের জন্ম হয় তা হলো ‘ঝগড়াটে’।
ঝগড়াটে শব্দটি সন্দেহাতীতভাবে নিন্দার্থেই ব্যবহৃত হয়। আমাদের জাতীয় সংসদে তর্ক-বিতর্ক হওয়ার মতো, কথা হওয়ার মতো অসংখ্য জ্বলন্ত বিষয় আছে। দ্রব্যমূল্যের আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে বাজার। ‘দশ টাকা’র প্রতিশ্রুতি মরীচিকা হয়ে গেছে, ত্রিশ টাকা ছাড়িয়ে গেছে মোটা চালের দাম। পেঁয়াজ-মরিচ-আদা-রসুন-সবজি-মাছ সবই সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। ডাল তো দরিদ্রের কাছে জাদুঘরে রক্ষিত সম্পদের মতো শুধু চেয়ে দেখার। জনগণের প্রতিনিধিরা এ নিয়ে কথা বলেন না কেন জাতীয় সংসদে? গত তিন বছর ধরে গ্যাস-বিদ্যুতের উত্পাদনে কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। গ্যাস সঙ্কটে করুণ অবস্থা বিভিন্ন অঞ্চলে বিরাজ করছে। মোটামুটি বিত্তবানেরাও কিনছেন বৈদ্যুতিক চুলা, ওভেন, রাইস কুকার। অনেক পরিবার রাতে যখন গ্যাস আসে তখন রাত জেগে রান্নাবান্না করে রাখছে সারাদিনের জন্য। এতে চাপ বাড়ছে বিদ্যুতের ওপর। এদিকে বিদ্যুত্ পরিস্থিতির উন্নয়ন না ঘটিয়ে, সেচে বিদ্যুত্ দেয়ার জন্য শহরে লোডশেডিংয়ের ঘোষণা দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী। গ্যাস এবং বিদ্যুত্ উভয় ক্ষেত্রেই আগামী গ্রীষ্মে অবস্থা হয়ে উঠবে ভয়াবহ। এ নিয়ে বিতর্ক হয় না কেন সংসদে? জনমনে সন্দেহ আছে যে এই সঙ্কট জিইয়ে রাখা হচ্ছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। অবস্থা দুঃসহ হয়ে উঠলে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের নামে জনগণের দুর্ভোগকে জিম্মি করে, বিদেশি কোম্পানির কাছে বিক্রির শর্তে, বিনা টেন্ডারে গ্যাস উত্তোলনের চুক্তি করাটাই সেই উদ্দেশ্য। টেন্ডারে প্রতিযোগিতা থাকায় নেপথ্যের লেনদেনের সুযোগ অনেকাংশেই কমে যায়। বিনা টেন্ডারে কাজ পাইয়ে দেয়ার ঘটনা এরই মধ্যে ঘটেছে এবং তা নিয়ে খবর প্রকাশিত হওয়ায় পত্রিকা এবং সাংবাদিকের ওপর হামলা-মামলাও হয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুত্ নিয়ে সংসদে উত্তপ্ত বিতর্ক হলে জনমনের সন্দেহ দূর হতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে সংসদে চলেছে প্রশংসার পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলছেন শতভাগ সফল হয়েছে তার সফর। সাফল্যের প্রাপ্তি কী? এক. ১০০ কোটি ডলার ঋণ প্রাপ্তি। ঋণের সুদ বিশ্বব্যাংকের সুদের দ্বিগুণেরও বেশি, মেয়াদ বিশ্বব্যাংকের মেয়াদের অর্ধেক। অর্থাত্ বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নিলে যে সুদ দিতে হতো তার দ্বিগুণ সুদ দিয়ে অতিদ্রুত এই ঋণ শোধ করতে হবে। এটা কি ঋণ, না সুদ ব্যবসা? ব্যাংকে অলস রিজার্ভ ফেলে রেখে এই ঋণ গ্রহণ আর যাই হোক, বাংলাদেশের স্বার্থে হতেই পারে না। দ্বিতীয় প্রাপ্তি. ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ আমদানির সুযোগ। কিন্তু কবে? ত্রিপুরায় নতুন বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপিত হলে এবং আন্তঃদেশীয় বিদ্যুত্ সঞ্চালন লাইন প্রতিষ্ঠিত হলে। যদি কখনও নয় মণ তেল পোড়েও, তবু রাধার নাচতে তিন বছর কমপক্ষে লাগবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশেতহার ও পরবর্তী বিভিন্ন সময়ের সরকারের ঘোষণা থেকেই তো আমরা জেনেছি, ততদিনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে বিদ্যুতে ঝলমল করবে বাংলাদেশ। ২৫০ মেগাওয়াট আমদানি করা হবে তা হলে কার স্বার্থে? কী প্রমাণ করার জন্য? তৃতীয় প্রাপ্তি. বাংলাদেশের কয়েকটি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার লাভ। শুল্কের ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা ও দ্বৈত অবস্থানের কথা আমরা জানি। তাছাড়া ওই কয়েকটি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশ ঘটলেও বাণিজ্য ঘাটতির বিন্দুমাত্র রকমফের হবে না। এসব নিয়েও উত্তপ্ত বিতর্ক হয় না সংসদে। ফারাক্কার প্রভাবে এদেশে মরুকরণের ক্ষতিপূরণের দাবি কেন করেন না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? কেন গজলডোবায় বাঁধের জন্য তিস্তা নদীর দূরবস্থার কথা তুলে ধরেন না প্রধানমন্ত্রী? এ নিয়ে তর্ক হয় না সংসদে। অনেকেই বলতে পারেন, বিরোধী দল সংসদে গিয়ে বিতর্ক তুলতেই তো পারে। হ্যাঁ, ঠিক কথা। বিরোধী দলের অবশ্যই সংসদে যাওয়া ও এসব প্রসঙ্গে তীব্র প্রতিবাদ করা উচিত। কিন্তু তার পরও কথা থেকে যায়—তা হলো, বিবেক কি শুধু বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদেরই থাকতে হবে?

সরকারদলীয় সদস্যের সবাই ‘জ্বী হুজুর’ বলার জন্যই কি? এসব বিষয়সহ আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, দলীয়করণ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখল যা সরকারের ভাবমূর্তিকেই ক্ষুণ্ন করছে তা নিয়ে কথা বললে তাকে তর্ক বলা যেত। জিয়ার কবরে জিয়ার মরদেহ আছে, না বাক্স আছে এ নিয়ে কথা বলা ঝগড়া বাধানোর চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়। জিয়ার মরদেহ খালেদা জিয়া দেখেছেন, দেখেছেন সেদিন ক্যান্টনমেন্টের বাসায় উপস্থিত হাজারো মানুষ। বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে লাখ লাখ শোকার্ত মানুষের অংশগ্রহণে এক নজিরবিহীন জানাজা। প্রমাণ হয়েছে, ঘাতক যা-ই করুক, আল্লাহ যাকে সম্মান দিতে চান, চক্রান্তের অপচেষ্টা তাকে মুছে ফেলতে পারে না। একটি ব্যাপারে বেগম জিয়াকে ধন্যবাদ দিতেই হয়—তা হলো, জিয়ার মরদেহ নিয়ে করা কটূক্তি তিনি আমলেই নেননি এবং কোনো ঝগড়ায় লিপ্ত হননি। কথাবার্তার অসংযম বড় রাজনীতিকের পরিচয় নয়। কিন্তু বেগম জিয়ার দলেও তো অপরিণত মস্তিষ্কের ছোটখাটো নেতাকর্মী আছেন। ভয় হয়, তারা না আবার বঙ্গবন্ধুর কবর নিয়ে ঝগড়া সৃষ্টি করেন!
আমরা তা চাই না। আমরা প্রয়াত নেতাদের সম্মান করতে চাই। কারণ কাউকে ছোট করে অন্য কাউকে বড় করা যায় না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যারে তুমি নীচে ফেল, সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,/পশ্চাতে রেখেছো যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’
লেখক : কবি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.