সম্ভাবনার মানবিক শুভাগমন by জাফরিন গুলশান

আধুনিক শিল্পকলার অর্জন নেহাত কম নয়। আধুনিক শিল্পীরা শিল্পকলার জন্য অর্জন করেছেন স্বায়ত্তশাসন। শিল্পীরা এখন স্বাধীনভাবে দাবি করতে পারেন শিল্পকর্মের স্বত্ব। বিশালায়তনের এই গণ্ডি মহাবিশ্বের মতোই সম্প্রসারিত হচ্ছে। আধুনিকতাকে আবার সমালোচনা করে উত্তরাধুনিকতা বিতর্কিত হয়েও স্থান করে নিয়েছে এই গণ্ডিতে।


এসব সমালোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টিশীলতার উত্তুঙ্গে উঠে শিল্পীরা শ্রেণী-সমাজ-সংস্কৃতি-দেশ-জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতাবোধে সক্রিয়। সময়ের সংকটে দায়িত্বশীলভাবে প্রতিবাদী। বেকারগ্রস্ত সমাজব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মতোই দুঃসাহসী—দার্শনিকের মতো সমাধান অন্বেষী। এই পরিক্রমায় শিল্প প্রদর্শনী শিরোনাম পায় ‘বিপন্ন সময় ও শান্তির অনুষঙ্গ’ (Peace in the Times of Disquiet)। শিল্পী মোহাম্মদ ইকবাল নিজেকে ‘উত্তরাধুনিক’ শিল্পী হিসেবে দাবি করেন। ৩০টি চিত্রকর্মের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য সহজ কথায় বলা যায়, শিল্পকর্মগুলোর ‘স্যাটেরিপল টেকনিক’ বা শিল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে ক্যানভাসে শিল্পীর রং-রেখা বিবিধ তলের ওপরে কৌশলগত নিরীক্ষা। এ ক্ষেত্রে নিজের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও নিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কিছু কৌশল নিজেই আবিষ্কার করেছেন। ক্যানভাসে আঁচর কেটে টোন তৈরি, বিশেষ মাধ্যম ব্যবহার করে বুদ্বুদের টেক্সচার ইত্যাদি নিয়ে তিনি অনেক সময় ব্যয় করেন। বছরব্যাপী চলতে থাকে কখনো একটি ক্যানভাসের শিল্পযজ্ঞ।
প্রকৃতপক্ষে টেক্সচার তৈরি, বিবিধ পরতে রঙের মিশ্রণ—এসব কর্মকাণ্ড শিল্পীর শিল্পভাবনাকে দৃশ্যগত ভাষায় রূপ-রস প্রদানের লক্ষ্যে। তেল রঙে করা শিল্পকর্মগুলো তিনটি চরিত্রে বিভক্ত। কিছু বিমূর্ত চরিত্রের, স্বাধীন ফর্ম, রেখা, রঙের সুনির্মাণ। অদৃশ্য অনুভূতির দৃশ্যায়ন নিরীক্ষা। ‘সন্ন্যাসী’ চরিত্রটি নিয়ে শিল্পী মোহাম্মদ ইকবাল দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করছেন। মূলধারাবিবর্জিত শ্রেণীটির দর্শন, জীবনযাপন, আধ্যাত্মিকতা আকর্ষণ করে শিল্পীকে। বন্ধনহীন, আধ্যাত্মিক অনুভূতির তাড়নাকে অনেক বেশি পরিমার্জন করেছেন সরলতর উপস্থাপনায়। স্পেস বা স্থান বিভাজন ঘটেছে কেন্দ্রভূমিতে, চরিত্রের অবতারণার মধ্য দিয়ে। সন্ন্যাসীদের ব্যবহূত অনুষঙ্গ দেখা মেলে। অনুভূতির অভিব্যক্তি ঘটেছে দক্ষ ড্রয়িংকেন্দ্রিক বিভিন্ন ধরনের রেখাকে নিয়ে প্রাণবন্ত খেলায়। এ দেশের একাডেমিক চারুশিল্প শিক্ষাকে বেশ রপ্ত করেছিলেন শিল্পী, তাঁর কাজে তা দৃশ্যমান। শিল্পী ইকবাল শিশু প্রতিকৃতিকে এঁকেছেন বিভিন্ন অভিব্যক্তিতে। অধিকাংশই কিছুটা নির্লিপ্ত। চোখে অনেক বেশি সূক্ষ্ম মনোযোগে সুচারু কাজ করেছেন। তেল রঙের তলে আঁচড় কেটে স্কেচের মতো আবহ নির্মাণ করেছেন। শিল্পী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পৃথিবীর সর্বত্র যে যুদ্ধের ভয়াবহতা, পরিবেশ দূষণসহ অন্তিম অর্থে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে। এ জন্য আসলে শিশুদের মনোস্তাত্ত্বিক গঠন বিনষ্ট হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ফলে মানবজাতির ভবিষ্যৎ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। এ বিষয়টি আমাকে ভাবায়। আমি এ বক্তব্যটিই পৌঁছে দিতে চাই যে, এই সংকটের সমাধানে বড়দের একত্র হয়ে কাজ করতে হবে।’ শিশু প্রতিকৃতি কম্পোজিশনের ক্ষেত্রে শিল্পী একসঙ্গে কয়েকটি প্রতিকৃতি, ‘ফোকাস, ডি-ফোকাস’-এর মতো কৌশল অবলম্বন করেছেন। কখনো একই প্রতিকৃতিতে ততোধিক চোখ এক ধরনের দৃষ্টি বিভ্রাট সৃষ্টি করে। অনেক ক্যানভাসেই বৃত্তাকার ফর্ম দেখা মেলে। এটিকে পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রসঙ্গে নিজের কাল্পনিক চরিত্র বলে দাবি শিল্পীর।
‘আউট সাইড অব সোশ্যাল বন্ডেজ’, ‘এক্সপ্রেশন-১’, ‘আননোন ফেসেস-১’, ‘ডেসট্রাকশন ৭১-১, ২’, ‘ল্যাংগুয়েজ অব পেইন’, ‘অরিজিনাল স্পেস’, ‘লস্ট সিভিলাইজেশন’ ইত্যাদি শিরোনামের শিল্পকর্মগুলোর ভেতরে পরিশীলিত আনন্দ ও বেদনা ভারাক্রান্ত সংমিশ্রণ। কখনো পরিমার্জিত একঘেয়েমির আবেদন।
‘লস্ট সিভিলাইজেশন’ শিল্পকর্মটি আফগানিস্তানে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের যুদ্ধে ঐতিহাসিক বামিয়ান বুদ্ধ মূর্তিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে, তার প্রতিক্রিয়ায় এ ছবিটি আঁকেন শিল্পী। তিনি মনে করেন, যেভাবে ইতিহাস ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে, এর সঙ্গে আমরাই আমাদের ধ্বংস করছি।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, শিল্প আজ যখন সংখ্যালঘিষ্ঠ ধনবান মানুষের বিলাসবস্তু, তাদের দ্বারাই প্রশংসিত, অনুগৃহীত হয়ে এসেছে এবং সমাজের চালিকা শক্তির কলকাঠি তাদের অর্থনৈতিক শক্তির কাছে কুক্ষিগত, তখন শিল্পীদের এই মানবিক ও দায়িত্বশীল বক্তব্য শিল্পকর্মের নান্দনিক নির্যাসভেদে সেই শ্রেণীর মগজে প্রবেশ করার মধ্যে নতুন পন্থার সাফল্য ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়।
বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে শিল্পী মোহাম্মদ ইকবালের একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনটি ৬ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে।

মোহাম্মদ ইকবাল: ১৯৬৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে এমএফএ ডিগ্রি অর্জন করে জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে জাপান যান। ২০১০ সালে টোকিও ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এ পর্যন্ত তাঁর ৩৩টি একক প্রদর্শনী এবং বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। ২০১০ সালে টোকিও অব দি আর্টস প্রদত্ত সম্মানজনক নোমুরা অ্যাওয়ার্ডসহ (গ্রান্ড প্রাইজ) আরও পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বর্তমানে চারুকলা অনুষদে (ঢাবি) সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।

No comments

Powered by Blogger.