চরাচর-পুণ্যস্নানে শুচি হোক ধরা by তারাপদ আচার্য্য

মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দের মহাস্নানে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হবে পৃথিবী_এই ধর্মবিশ্বাস বুকে ধারণ করে লাঙ্গলবন্দে জড়ো হয় বাংলাদেশসহ ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার হাজার হাজার পুণ্যার্থী। অশোকাষ্টমী তিথিতে এ মহাতীর্থে স্নানরত মানুষ হয়ে ওঠে দেবতা। দেবত্বের স্ফুরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ ঘটে আলোকিত মনুষ্যত্বের।


পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায়, ত্রেতা যুগের সূচনাকালে মগধ রাজ্যে ভাগীরথীর উপনদী কৌশিকীর তীরঘেঁষে এক সমৃদ্ধ নগরী ছিল, যার নাম ভোজকোট। এ নগরীতে গাধি নামে চন্দ্রবংশীয় এক রাজা ছিলেন। গাধির ছিল এক পুত্র ও এক কন্যা। গাধিপুত্র বিশ্বামিত্র পরে সাধনাবলে মহর্ষি হয়ে জগৎ আলোকিত করেন। ক্ষত্রীয়কুলে জন্ম হলেও মহর্ষির স্বীকৃতি লাভের জন্য বশিষ্ঠমুনির সঙ্গে বিশ্বামিত্রের দ্বন্দ্ব পৌরাণিক কাহিনীর এক চমৎকার সংযোজন। সেই দ্বন্দ্বে বশিষ্ঠমুনি ছিলেন অটল ও নির্বিকার। দ্বন্দ্ব চলার সময় ধীরে ধীরে বিশ্বামিত্রের মধ্যে ক্ষত্রীয়সুলভ ক্রোধের প্রশমন ও ব্রহ্মতেজের স্ফুরণ ঘটে। একদিন পরশুরামের মা রেনুকা দেবী জল আনতে গঙ্গার তীরে যান। সেখানে পদ্মমালী (মতান্তরে চিত্ররথ) নামের গন্ধর্বরাজ স্ত্রীসহ জলবিহার করছিলেন (মতান্তরে অপ্সরী দলসহ)। পদ্মমালীর রূপ এবং তাঁদের সমবেত জলবিহারের দৃশ্য রেনুকা দেবীকে এমনভাবে মোহিত করে যে তিনি তন্ময় হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। অন্যদিকে ঋষি জমদগি্নর হোমবেলা পেরিয়ে যাচ্ছে, সেদিকে তাঁর মোটেও খেয়াল নেই। সংবিৎ ফিরে পেয়ে রেনুকা দেবী কলস ভরে ঋষি জমদগি্নর সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ান। তপোবলে ঋষি জমদগি্ন সব জানতে পেরে রেগে গিয়ে পুত্রদের মাতৃহত্যার আদেশ দেন। প্রথম চার পুত্র মাকে হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু পরশুরাম পিতার আদেশে মা এবং আদেশ পালন না করা ভাইদের কুঠার দিয়ে হত্যা করেন। পরে পিতা খুশি হয়ে পরশুরামকে বর দিতে চাইলে তিনি মা ও ভাইদের প্রাণ ফিরে চান। তাতেই রাজি হন ঋষি জমদগি্ন। কিন্তু মাতৃহত্যার পাপে পরশুরামের হাতে কুঠার লেগেই থাকে। অনেক চেষ্টা করেও ওই কুঠার তিনি খসাতে পারেন না। পিতার কাছে জিজ্ঞেস করেন, তাঁর পাপমুক্তির উপায়ের কথা। পিতা বলেন, 'তুমি মাতৃহত্যা ও স্ত্রীলোক হত্যা_এই দুই পাপে আক্রান্ত হয়েছ, তাই তোমাকে তীর্থে তীর্থে ঘুরতে হবে, যে তীর্থের জলের স্পর্শে তোমার হাতের কুঠার খসে যাবে; মনে রাখবে সেই তীর্থই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম তীর্থস্থান।' পিতার কথামতো পরশুরাম তীর্থে তীর্থে ঘুরতে থাকেন। শেষে ভারতবর্ষের সব তীর্থ ঘুরে ব্রহ্মকুণ্ডের পুণ্য জলে স্নান করে তাঁর হাতের কুঠার খসে যায়। পরশুরাম মনে মনে ভাবেন, এই পুণ্য বারিধারা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে তারা উপকৃত হবে। তাই তিনি হাতের খসে যাওয়া কুঠারকে লাঙ্গলে রূপান্তর করে পাথর কেটে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে মর্ত্যলোকের সমভূমিতে সেই জলধারা নিয়ে আসেন। লাঙ্গল দিয়ে সমভূমির বুক চিরে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন তিনি। ক্রমাগত ভূমি কর্ষণজনিত শ্রমে পরশুরাম ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার সোনারগাঁয়ে এসে তিনি লাঙ্গল চালানো বন্ধ করেন। এ জন্যই এ স্থানের নাম হয় লাঙ্গলবন্দ। সাধারণত চৈত্র মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে (যে বছর মলমাস না থাকে) অর্থাৎ বাসন্তী পূজার মহাষ্টমী তথা শ্রীশ্রী অন্নপূর্ণা পূজার দিনে এ স্নান অনুষ্ঠিত হয়। তিথি পরিক্রমায় বুধাষ্টমী যোগ ১২ বছর পর পর একবার আসে। পুণ্যার্থীরা এই পবিত্র লগ্নের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন বছরের পর বছর।
তারাপদ আচার্য্য

No comments

Powered by Blogger.