প্রিয়তমেষু by হাসান ফেরদৌস

মোরশেদুল ইসলামের প্রিয়তমেষু ছবিটি কি আপনারা দেখেছেন? না দেখে থাকলে আমার অনুরোধ, দেখবেন।
একটি ধর্ষণের কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মিত। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার; অল্প ভাড়ায় একটি বাসাবাড়ি খুঁজছে স্বামী-স্ত্রী। স্বামীর এক ব্যবসায়ী বন্ধু কথা দিয়েছে, ভালো বাড়ি সে খুঁজে দেবে।


আপাতত এক পরিচিতের খালি বাড়িতে থাকার জায়গা পাওয়া গেছে। অল্প বয়সী মেয়েটির একটি শিশুপুত্র আছে, তারই সুবাদে আলাপ হয় পাশের বাড়ির অবস্থাসম্পন্ন দম্পতির সঙ্গে। কিছুটা অসম বয়সী হলেও খুব সহজেই দুই বাড়ির দুই মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এদিকে বাড়ি খুঁজে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে বন্ধুটি, মাঝেমধ্যে কোনো কিছু না জানিয়েই তরুণী স্ত্রীর বাসায় আসা শুরু করে। মেয়েটি বিব্রত, ভীত; কিন্তু বাকচতুর সেই যুবকের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেবে, সে সাহসও নেই। এই বন্ধুর সাহায্যে একটি ভালো বাড়ির খোঁজ এরই মধ্যে মিলেছে। এক দিন দুপুরে বন্ধুটি এসে হাজির। সেদিনই ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটে।
এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত, কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে নয়। আমি যেখানে থাকি, সেই আমেরিকায় তো নয়ই। এখানে, অর্থাৎ আমেরিকায় প্রতিবছর প্রায় সোয়া দুই লাখের মতো ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ, প্রতি দুই মিনিটে একটি করে ধর্ষণ। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধী ধর্ষক কোনো নিকটাত্মীয়, পরিচিত বন্ধু অথবা সাবেক প্রেমিক। প্রায় সময়েই লোকলজ্জা, আইনি ঝামেলা প্রভৃতি কারণে এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করা হয় না। আমাদের দেশে তো এমন ঘটনা লুকিয়ে রাখতে পারলেই আমরা বাঁচি। ফলে ধর্ষণের সঠিক সংখ্যা জানা প্রায় অসম্ভব। তার পরও এক হিসাবে দেখছি, বাংলাদেশে বছরে প্রায় আড়াই হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। কিন্তু সবাই এ ব্যাপারে এক মত, সঠিক সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।
প্রিয়তমেষুর ঘটনাটিও সম্ভবত আমাদের জানার বাইরে থেকে যেত। স্বামীর বন্ধুর হাতে ধর্ষণ, তার কাছে পরিবারটি নানাভাবে ঋণী। জানাজানি হলে এ পাড়ায় থাকা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে। সে কারণে সবচেয়ে বেশি অপ্রস্তুত স্বামী ভদ্রলোক। দুই দিন আগেও যাকে গভীর প্রেমে সে আগলে রেখেছিল, সেই স্ত্রী এখন ‘অপরিষ্কার’, তাকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছেও হয় না তার। এ নিয়ে কোনো থানা-পুলিশ হোক, তা সে একেবারেই চায় না। কিন্তু পাশের বাড়ির মহিলাটি ধর্ষিত মেয়েটির পাশে এসে দাঁড়ায়। একসময় সে নিজেও এক নিকটাত্মীয়ের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিল, সে সময় তা নিয়ে একটি কথা বলার সাহস হয়নি। কিন্তু আজ সে চুপ থাকতে নারাজ। সবাই না-না বলছে, ধর্ষক বন্ধুটি এসে হুমকি দিচ্ছে; নিকটাত্মীয় বলছে, স্বামীর বস বলছে—এ নিয়ে আর কথা না বাড়াতে। সব বাধা অগ্রাহ্য করে মেয়ে দুটি হাতে হাত ধরে লড়াই শুরু করে। তারা জানে, এমন অপরাধ বিনা প্রতিবাদে মেনে নিলে সেই ধর্ষক পুরুষটি আগামীকাল আবার অন্য কোনো মেয়েকে লাঞ্ছিত করবে। শেষ পর্যন্ত তাদেরই জয় হয়। ধর্ষণের অপরাধে সেই মুখোশধারী বন্ধুটির শাস্তি হয়। তার চেয়েও বড় কথা, মেয়েটির স্বামী, যে একসময় মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল, সেও স্ত্রীর পাশে এসে দাঁড়ায়। না, তারা পালাবে না। লোকলজ্জার ভয়ে মুখ ঢেকে থাকবে না।
এমন ঘটনা হয়তো ঘটে না। আমাদের দেশের মেয়েদের এমন জোর কোথায় যে গোটা সমাজের বিরুদ্ধে তারা লড়বে! ক্ষমতাবান লোকের অর্থের জোর আছে, বাহুর জোর আছে। পুলিশ তাদের নিয়ন্ত্রণে, আদালতও তাদের হাতের মুঠোয়। এমন লোকদের রোখা সহজ নয়। হুমায়ূন আহমেদ এই গল্পের লেখক, আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, এমন হয়তো ঘটে না, কিন্তু এমনই ঘটা উচিত। ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধ, তাকে যত ঢেকে রাখব, সে অপরাধ ততই আসন গেড়ে বসবে। চোখের সামনে এমন অপরাধ ঘটার পরও যে নীরবতা, তার জন্য ধর্ষক একজন হলেও আমরা সবাই-ই কমবেশি সে অপরাধে দায়ী।
পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম ও লেখক হুমায়ূন আহমেদকে ধন্যবাদ, তাঁরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছেন। ছবির ভেতর দিয়ে নিজেদের প্রতিবাদ উচ্চারণ করেছেন। আর কিছু না হোক, আমাদের বিবেকের নাড়ি ধরে টান মেরেছেন। একটি সপাং চাবুকের বাড়ি এসে লেগেছে সেখানে। কিন্তু শুধু এক গল্পে, এক চলচ্চিত্রে হবে না—ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে চাই বড় ধরনের সামাজিক আন্দোলন; চাই মেয়ে-পুরুষ মিলে একযোগে লড়াই। পুরুষেরা যদি পাশে এসে না দাঁড়ায়, মেয়েদের নিজেদেরই উঠে দাঁড়াতে হবে। সবচেয়ে আশার কথা, মেয়েরা যে নিজেরাই উঠে দাঁড়াচ্ছে, বাংলাদেশের একটি ঘটনার উদাহরণে সে কথার প্রমাণ মিলেছে। এ ঘটনা নিয়ে জাতিসংঘ টেলিভিশন গত বছর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছে, যার নাম সিকিং জাস্টিস।
এই তথ্যচিত্রের বিষয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক নওরিন তাবাসসুম। একই বিভাগের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহেল কাফির বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ এনেছেন, বিবাহিত এই ভদ্রলোক(!) তাঁকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করেছেন। এমনকি এই বলে হুমকি দিয়েছেন, তাঁকে সন্তুষ্ট করা না হলে নওরিনের চাকরি পাকা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সে লোক সময়-অসময়ে ফোন করে তাঁর বাসায় আসতে চেয়েছেন। জানতে চেয়েছেন, তিনি এখন একলা আছেন কি না। তাঁর সঙ্গে শাশুড়ি থাকেন, এ কথা বলায় সেই অধ্যাপক তাঁকে (অর্থাৎ শাশুড়িকে) অন্যত্র পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন। বিস্মিত নওরিনের প্রশ্ন, ‘কেন?’ ‘কেন আবার, তাহলে আমরা একলা থাকতে পারব।’ একবার কমনরুমে নওরিন সহকর্মীদের কোক কিনে খাওয়াচ্ছিলেন। সেই ভদ্রলোক এসে হাজির। নওরিন ভদ্রতা করে তাঁকেও কোক খেতে আহ্বান করলে ভদ্রলোক সোল্লাসে বললেন, ‘শুধু কোকে হবে না, আমরা তোমার সবকিছু খাব।’ (এই অংশটুকু তথ্যচিত্রে নেই, আমি রেকর্ড করা টেপে শুনেছি।)
নওরিন এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের কাছে অভিযোগ করেছেন। কোনো কাজ হয়নি। তিনি উল্টো বুদ্ধি দিয়েছেন, পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে। এমনকি তাঁর স্বামী পর্যন্ত যুক্তি দিয়েছেন, তাঁর এখন নতুন চাকরি। এ নিয়ে বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভালো।
কিন্তু নওরিন চুপ করে থাকেননি। তিনি তথ্যমাধ্যমের কাছে গেছেন, আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। তাঁকে এ কাজে সমর্থন দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহকর্মী, ছাত্রছাত্রী।অবশেষে আদালতের হস্তক্ষেপে পুরুষ অধ্যাপককে নিরস্ত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, চাকরিতেও কিঞ্চিৎ অবনমন ঘটে। শুনেছি, এক ধাপ নিচুতে হলেও ভদ্রলোক এখনো সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ান। কী পড়ান, কাদের পড়ান, যারা শিক্ষা গ্রহণ করে, তারাই বা কীভাবে এমন দুষ্কৃৃতকারীকে শিক্ষক বলে মেনে নেয়—সেসব ভেবে বিস্মিত হতে হয়।
এ দুটি ঘটনাএকটিকাল্পনিক, অন্যটি বাস্তব। আমাদের একটা জিনিস শেখায়—ধর্ষণ অথবা যৌন নিপীড়ন ক্যানসারের মতো ব্যাধি। তাকে লুকিয়ে রাখলে সে কেবল বাড়তেই থাকবে। সমাজে নানা ধরনের অপরাধী থাকে—চোর, ডাকাত, খুনি। ধর্ষক ঠিক সে রকম একজন অপরাধী। এদের কেউ কেউ ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকে, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অধ্যাপকটি। তাদের আসল চেহারাটি খুলে না দিলে শেষ পর্যন্ত আমরা নিজেরাই বিপদগ্রস্ত হব। আজ হয়তো নওরিন বা প্রিয়তমেষুর তরুণী বধূটি আক্রান্ত হয়েছে। কাল যে আমার বোন অথবা কন্যা আক্রান্ত হবে না, এমন কথা কী করে বলি?
এ লড়াই আমাদের সবার। স্বামী, বাবা ও পরিবারের সাহায্য তো চাই, আর চাই সহমর্মী মানুষের সমর্থনের হাত। কিন্তু সে সাহায্য যদি না আসে, মেয়েরা একাই লড়বে, যেমন লড়েছে প্রিয়তমেষুর মেয়েটি।
১৩ এপ্রিল ২০১২, নিউইয়র্ক

No comments

Powered by Blogger.