ক্যাম্পাসে ফের হত্যাকাণ্ডঃ ছাত্রলীগকে কেন সামলানো যাচ্ছে না!

ছাত্রলীগকে সামলানো সম্ভব হচ্ছে না। সব ধরনের শাসন-হুশিয়ারি অগ্রাহ্য করে শিক্ষাঙ্গনকে ফের রক্তে রঞ্জিত করল তাদের গ্রুপিং-কোন্দল। মৃত্যু কলঙ্কের অপবাদে আবার অবনমিত হলো একদার ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় থেকেই ছাত্রলীগের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড এবং গ্রুপিং চূড়ান্ত উচ্ছৃঙ্খলতায় রূপ নিয়েছিল। দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সংঘর্ষ পর্যবসিত হয়েছিল নিত্যদিনের ঘটনায়। এই অসহনীয় অবস্থায় বিভিন্ন মহল থেকে ছাত্রলীগকে সামলানোর দাবি উঠছিল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলেছিলেন। তারপরও ছাত্রলীগ দমেনি। শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার আবহ বিনষ্ট হতে পারে এমন সব কর্মকাণ্ডে তারা আরও বেশি করে জড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসনের চোখের সামনে প্রকাশ্যে চলেছে এসব তাণ্ডব। ছাত্রলীগ ক্রমশ মারমুখী হয়েছে। তারই জের হিসেবে এবার জীবন দিতে হলো এক মেধাবী শিক্ষার্থীকে।
গত ১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এএফ রহমান হলে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় গুরুতর আহত হন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আবু বকর সিদ্দিক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান ৩ ফেব্রুয়ারি সকালে। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাসে শুরু হয় বিক্ষোভ মিছিল, পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। বিক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বেশ কিছু গাড়ি ভাংচুর করে এবং তছনছ করে প্রক্টরের কার্যালয়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র লাশ হয়ে ফিরে যান টাঙ্গাইলের মধুপুরে, শোকাহত স্বজনের কাছে।
উল্লেখ্য, বেপরোয়া ছাত্রলীগের তাণ্ডবে এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ত ঝরেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন প্রক্টরসহ তিন শিক্ষক। এছাড়া ছিনতাই, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপকর্মে ছাত্রলীগ নামধারীরা বেশ কিছুদিন ধরে লাগামহীন পর্যায়ে চলে যায়। ক্যাম্পাসে এ ধরনের ন্যক্কারজনক উপদ্রবের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে, তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিংবা হল থেকে দু’চারজনকে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত এসব ব্যবস্থায় স্থায়ী কোনো ফলোদয় হয়নি। অর্থাত্ টোটকা চিকিত্সায় বিষ নামানো সম্ভব হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকে ৭৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে এই ক্যাম্পাসে। এর মধ্যে বিচার হয়েছে মাত্র দুটির। অন্যদিকে অভিযুক্তরা ছাড়া পেয়ে গেছে আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে। ঘটনা পরম্পরায় দেখা যায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরও সেসব ফাঁকফোকর বন্ধ হয়নি। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্ররাজনীতি অব্যাহত রয়েছে, তার কোনো গ্রহণযোগ্য বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র নেই। দলের লেজুড়বৃত্তি করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করাই যেন এর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কারণেই দেশের সব মহল থেকে বার বার দাবি উঠেছে, শিক্ষাঙ্গনে দলীয় রাজনীতি বন্ধ করা হোক। ছাত্ররা রাজনীতি করবে, কিন্তু রাজনীতির নামে মাস্তানি বন্ধ করা হোক। বন্ধ হয়নি বরং বেড়েছে। তারই একটি নজির ছাত্রলীগের গ্রুপিং-কোন্দলে ক্যাম্পাসে আবারও জীবনহানির ঘটনা।
না, এ ঘটনায় শুধু শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হয়নি, একটি সম্ভাবনাময় জীবনের যবনিকাপাত ঘটেনি, দেশে গোটা রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠাকে তুঙ্গস্পর্শী করে তুলেছে। পাশাপাশি সরকার এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। এর পুনরাবৃত্তি এড়াতে দেশবাসীর দাবি, হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করুন, ছাত্রলীগকে কেন সামলানো যাচ্ছে না—এরও সদুত্তর দাবি করছেন দেশবাসী।

No comments

Powered by Blogger.