সম্পাদকের কলাম-ইলিয়াস আলীর সন্ধান জরুরি by ইমদাদুল হক মিলন

ইলিয়াস আলী বিএনপির তুখোড় নেতা। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সিলেট জেলা বিএনপির দুর্দান্ত জনপ্রিয় এই নেতার পুরো নাম এম ইলিয়াস আলী। তাঁর গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথ এলাকার রামধানা গ্রামে। সেখানে তাঁর মা, ৬৫ বছর বয়সের সূর্যবান বিবি অবিরাম কাঁদছেন, অবিরাম বিলাপ করছেন।


যাঁকে পাচ্ছেন তাঁকেই বলছেন, 'আমার ইলিয়াসকে এনে দাও, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও।' কাঁদতে কাঁদতে, বিলাপ করতে করতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এলাকার শত শত মানুষ দিনভর সেই বাড়িতে। ছেলের মঙ্গল কামনায় খতমে কোরআনের আয়োজন করা হয়েছে বাড়িতে। গরু জবাই করে মাংস বিতরণ করা হয়েছে দুস্থ অসহায় মানুষজনকে। সবার একই প্রশ্ন, ইলিয়াস আলী কোথায়?
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।
তিন ছেলেমেয়ে অর্ণব, লাবিব আর সাইয়ারা। মা লুনা তাঁর তিন সন্তানকে বুকে জড়িয়ে পাথর হয়ে বসে আছেন। কাঁদতে ভুলে গেছেন। ছেলেমেয়েরা কাঁদছে। সামনে ইলিয়াস আলীর ছবি।
ইলিয়াস আলী কোথায়?
ঢাকার বনানীতে ইলিয়াস আলীর 'সিলেট হাউজ'। ছতলা বাড়ির পাঁচতলায় তিনি উঠেছেন মাস চারেক আগে। ছতলায় একজন ভাড়াটে আছেন। বাড়ির অন্যান্য ফ্ল্যাট ফাঁকা। এখনো ভাড়া দেওয়া হয়নি। এই বাড়িতে অনবরত আসছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা, ইলিয়াস আলীর ভক্ত স্বজনরা। কান্নার রোল পড়েছে।
ইলিয়াস আলী কোথায়?
বাড়ির কেয়ারটেকার শফিকুর রহমান জানিয়েছেন, গত মঙ্গলবার (১৭ এপ্রিল) রাত পৌনে ১০টার দিকে ইলিয়াস আলী বাড়ি থেকে বের হন। সে সময় গাড়িতে তাঁর সঙ্গে আরো দুজন ছিল। তার আগে বাড়ির নিচতলার অফিস রুমে ইলিয়াস আলী ছয়-সাতজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে দু-তিনজন তাঁর সঙ্গে সেই রাতেই পরিচিত হন। কথা শেষ করে, সবার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে তিনি গাড়িতে ওঠেন। অন্যরা দুটো মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যান। সবার পরিচয় জানাতে পারেননি কেয়ারটেকার শফিক। দু-তিনজনকে সিলেট অঞ্চলের মানুষ বলে ধারণা করেছেন। রহস্যজনক ঘটনা হলো ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার কথা শুনে বহু নেতা-কর্মী পরের দিন তাঁর বাড়িতে এলেও সেই রাতের ওই ব্যক্তিদের কাউকে দেখা যায়নি। শফিকুর রহমান দেখলেই তাঁদের চিনতে পারবেন বলে জানিয়েছেন।
সেই রাতে ইলিয়াস আলী বেরিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রীর গাড়ি নিয়ে। রাত দেড়টার দিকে ডানদিককার দরজা খোলা গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। একটি মোবাইল ফোন পাওয়া যায় গাড়িতে। সেই ফোনের কললিস্ট ধরে বিভিন্ন নাম্বারে ফোন করে গাড়িটি যে ইলিয়াস আলীর, পুলিশ তা নিশ্চিত হয়।
কিন্তু ইলিয়াস আলী কোথায়?
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাঁর স্বামীকে খুঁজে বের করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। স্বামীর জন্য পাথর হয়ে থাকা তাহসিনা রুশদীর লুনা একসময় আহাজারি করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই অবস্থায় আবার জড়িয়ে ধরেন তিন সন্তানকে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, 'স্বজন হারানোর বেদনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোঝেন। তাঁর কাছে বিনীত নিবেদন, তিনি যেন আমার স্বামীর দ্রুত খোঁজ দেন। সরকার চাইলে যেকোনো মুহূর্তেই নিখোঁজ মানুষের সন্ধান দিতে পারে, এটা আমি বিশ্বাস করি।'
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ, এ-সংক্রান্ত সাধারণ ডায়েরি হয়েছে বনানী থানায়। ডায়েরি করেছেন তাঁর স্ত্রী। পুলিশ, র‌্যাব এবং দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ব্যাপকভাবে শুরু করেছে তাঁদের কার্যক্রম। খোঁজ চলছে ইলিয়াস আলীর, আর হাওয়ায় ভাসছে নানা রকম গুজব। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, 'র‌্যাব ও এজেন্সির লোকেরা তুলে নিয়ে গেছে।' সিলেটে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল চলছে। রবিবার সারা দেশে হরতাল ডেকেছে বিএনপি। বিভিন্ন দলের প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও নিন্দা চলছে। ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫০ জন শিক্ষক বিবৃতি দিয়েছেন। সিলেট উত্তাল হয়ে গেছে। চলছে নানা হিসাব, নানা প্রশ্ন। দুই সপ্তাহে সিলেট বিএনপি ও ছাত্রদলের তিনজন নিখোঁজ। ৩ এপ্রিল নিখোঁজ হন ছাত্রদল নেতা ইফতেখার আহমদ দিনার ও জুনেদ আহমদ। এখনো তাঁদের খোঁজ মেলেনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বুধবার মধ্যরাতে ইলিয়াস আলীর বনানীর বাসভবনে গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। বলেছেন, 'নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা সর্বাত্মকভাবে তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টা করছি। বর্তমান সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। আমরা চাই না এভাবে কেউ নিখোঁজ হোক।'
কিন্তু দেশের মানুষের সামনে এখন বেশ কয়েকটি প্রশ্ন। ঢাকার একজন ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম নিখোঁজ হলেন অনেক দিন হয়ে গেল, তাঁর কোনো হদিসই কেউ পেল না। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কোনো কূল-কিনারা হলো না। একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে দেশে। এসব কারা করছে, কেন করছে, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা, র‌্যাব, পুলিশ কি এসব ঘটনার হদিস করতে পারছে না? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
ইলিয়াস আলী একজন জনপ্রিয় নেতা। সিলেটের সর্বস্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য। তাঁর নেতৃত্বে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল সিলেটের মানুষ। এই বাঁধ নির্মাণ নিয়ে সিলেটে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি পালিত হয়েছে। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইলিয়াস আলী। সিলেটের জৈন্তা সীমান্তে বাংলাদেশের জমি ভারত দখল করেছে, এই নিয়ে সাধারণ মানুষ যে আন্দোলন করেছিল সেখানেও নেতৃত্ব দিয়েছেন ইলিয়াস আলী। সীমান্ত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের লংমার্চে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এই মাপের একজন নেতা এভাবে নিখোঁজ হয়ে যাবেন? দেশের রাজনীতিতে এই নিখোঁজ কালচার দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। এমনিতেই অস্বস্তির অন্ত নেই মানুষের। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে, দ্রব্যমূল্য চলে গেছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, ঢাকা হয়ে গেছে অচল নগরী। বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, গ্যাস নেই। জনদুর্ভোগে জর্জরিত দেশ। এ অবস্থায় রাজনীতিতে শুরু হয়েছে 'নিখোঁজ কালচার'। দেশের মানুষ কী করবে? কার কাছে যাবে, কোথায় যাবে? এ কোন খাঁচায় আটকা পড়েছি আমরা? এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?
দেশের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, দুই দলেই আছেন জনপ্রিয়তম দুই নেত্রী। আমার এই সামান্য লেখার মধ্য দিয়ে দুই নেত্রীকে আমি বিনীতভাবে অনুরোধ করছি, আমাদের স্বপ্নের দেশটিকে আপনারা রক্ষা করুন। মানুষের জীবনে স্বস্তি এবং শান্তি এনে দিন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আপনারা দুজন চাইলেই তা সম্ভব। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে শুধু আপনারা দুজনেই পারেন দেশের মানুষকে শান্তি এবং স্বস্তি এনে দিতে। মানুষের ভরসার স্থল হতে পারেন।
আর আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে অনুরোধ, ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করে ফিরিয়ে দিন তাঁর মায়ের কাছে; স্ত্রী, তিন সন্তান এবং দলীয় নেতা-কর্মী আর স্বজনদের কাছে। প্রমাণ করুন- হ্যাঁ, আপনারা পারেন। আপনারা দেশ পরিচালনা করছেন, দেশের প্রতিটি মানুষের জানমালের দায়িত্ব আপনাদের। ইলিয়াস আলীর ক্ষেত্রে যেন কোনো রকম কোনো অশুভ ঘটনা ঘটতে না দেখি আমরা। আপনাদের চেষ্টায় এবং পরম করুণাময়ের কৃপায় এই নেতা যেন সুস্থ সুন্দরভাবে ফিরে আসেন তাঁর প্রিয়জনদের কাছে, তাঁর দলের কাছে, দেশের মানুষের কাছে।

No comments

Powered by Blogger.