সংকট নিরসনে সামাজিক ন্যায়বিচার by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

একটি সমাজের মূল চালিকাশক্তিগুলো হলো_ ধর্ম, উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে, বিশেষ করে বৃহৎ ধর্মগুলোর আবির্ভাবের পর থেকে এ তিনটি মূল লক্ষ্য অর্জন ছিল মানবজাতির বৃহত্তম আকাঙ্ক্ষা। যুগে যুগে এ লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে।


এসব প্রতিশ্রুতিতে বলা হয়েছে, যখন সারাবিশ্বে সত্য ধর্ম বিস্তৃত হবে, সেদিন মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্রে উন্নতি ও পূর্ণতা অর্জিত হবে এবং সব মানুষ আশ্রয় পাবে সামাজিক সুবিচারের শীতল ছায়াতলে। আর এ তিনটি চালিকাশক্তি বা নীতিমালার যে কোনো একটি থেকে দূরে থাকলে সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ভিত্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
উন্নয়ন সম্পর্কিত ইসলামী চিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো_ ইসলাম একই সঙ্গে মানুষের ইহকালীন ও পারলৌকিক জীবনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। উন্নয়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন অর্থনৈতিক মতবাদের সঙ্গে এ সম্পর্কিত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির মূল পার্থক্য ঠিক এটাই।
ইসলামের উন্নয়ন সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি মূল কথা হলো ন্যায়বিচার। ইসলাম মনে করে, ন্যায়বিচার অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলোকে যত বেশি সংশোধন করতে পারে, অন্য কোনো বিষয় ততটা করতে সক্ষম নয়। ন্যায়বিচারের ধারণা না থাকার কারণেই সমাজে দুর্নীতি ও সামাজিক সংকট দেখা দেয়।
হিংস্রতা, জুলুম, নিরাপত্তা-হীনতা, মানসিক অস্থিরতা ও বিশ্বাসঘাতকতার মতো সংকটগুলোর মূল উৎস হচ্ছে অবিচার। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীন মহলের স্বার্থপূজা ও নানাবিধ ষড়যন্ত্রের বেদিতে ন্যায়বিচার বিসর্জিত হয়েছে। ফলে বর্তমানে রাষ্ট্রে বা সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য এত বেশি প্রকট যে, সমাজ উন্নয়ন প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
অন্যদিকে ইসলাম ন্যায়-বিচারকে সামগ্রিক উন্নয়নের সহযোগী বলে মনে করে। ইসলাম ধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষকে উন্নত করা। আল্লাহতায়ালা কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এটাও বলেছেন যে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই নবী-রাসূলগণকে পাঠানো হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার মানুষের সবচেয়ে মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম। অবিচার সমাজের শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলে। অবিচার সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিরাজিত সুস্থ সম্পর্ক এবং নীতিমালাকে নড়বড়ে করে তোলে। আর এ কারণেই ইসলাম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে বলে। একমাত্র ন্যায়বিচারের ক্ষেত্র বিস্তৃত করার মাধ্যমে সমাজে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব। কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জীবনের সব ক্ষেত্রে মানুষের পূর্ণতা অর্জিত হয়। অর্থাৎ এ পূর্ণতা মানুষের বস্তুগত, আধ্যাত্মিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রসহ তার জীবনের সব ক্ষেত্রেই অর্জিত হওয়া উচিত।
আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারীম ও হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হাদীসের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কে, যা আমাদের ব্যক্তিজীবনে সবাইকে কাজে লাগানো দরকার। কিন্তু আমরা জেনে বা না জেনে কাজে লাগাই না। ফলে সমাজের পদে পদে অশান্তি সৃষ্টি হয়। ইসলামের রয়েছে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এক বিশাল দিগন্তপ্রসারী নীতিমালা। এই নীতিমালা অনুসরণ করা হলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা পেতে বাধ্য। কিন্তু আফসোস! আমরা তা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছি।
ন্যায়বিচার সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, 'নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানতকে তার মালিকের কাছে যথাযথভাবে পেঁৗছে দেওয়ার জন্য এবং যখন মানুষের মাঝে ফয়সালা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করার জন্য।'-সূরা নিসা : ৫৮
কোরআনের অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, 'আর তোমরা ন্যায়ানুগ পন্থায় বিচার কর এবং ইনসাফ কায়েম কর। আল্লাহতায়ালা ন্যায়বিচারকারীদের ভালোবাসেন।' -সূরা হুজরাত : ৯
অতএব, প্রত্যেক মুসলমানের উচিত তার অপছন্দনীয় ব্যক্তির সঙ্গেও ন্যায়বিচার করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, 'কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন তোমাদের কখনও ন্যায়বিচার না করতে প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায়বিচার কর। এটাই খোদাভীতির অধিকতর নিকটবর্তী।'-সূরা মায়েদা : ৮
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্যের ওপর জুলুম, নির্যাতন ও তার সঙ্গে খারাপ আচরণ থেকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'তোমরা জুলুম (অবিচার) করা থেকে বেঁচে থাক। কেননা, এই জুলুমই কিয়ামতের দিন অন্ধকারের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।' বুখারি শরীফ
আরেকটি কথা, হালাল উপার্জন ছাড়া কখনও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই তো সূরা বাকারায় আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিচ্ছেন, 'তারা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করবে, আমরা আল্লাহর রাস্তায় কী পরিমাণ ব্যয় করব, আপনি বলে দিন যা উদ্ধৃত্ত।' আর আল্লাহর রাস্তা তো ওইটিই, যেখানে মানবতার কল্যাণ সাধিত হয়, যেখানে এতিম, মিসকিন, গরিব ও দুঃখীদের তাদের হক দেওয়া হয়। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহতায়ালা কোরআনে সূরা মাউন নামে আলাদা একটি সূরাই নাজিল করেছেন, যেখানে আল্লাহতায়ালা এতিম, মিসকিন ও গরিবের হক আদায় করতে ব্যর্থ মুসলিল্গকে ওয়াইল নামের দোজখে নিক্ষেপ করার কথা বলছেন।
আমরা মনে করি, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। প্রথমত, পরিবারের সদস্যরা তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রাথমিক অবস্থা থেকেই শিক্ষা দেবে_ কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়। দ্বিতীয়ত, আমরা জানি, শিক্ষক হলো মানুষ গড়ার কারিগর। ছাত্রাবস্থায় শিক্ষকের আদর্শ ও তাঁদের মূল্যবান উপদেশ অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরেই এ বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে থাকা উচিত। তৃতীয়ত, তরুণ ও যুবসমাজকে ইসলাম ও মানবচরিত্র সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করতে হবে। আর সে জন্য নিয়মিত ইসলামিক বিভিন্ন মজলিসে যেতে হবে। সর্বোপরি লোভ-লালসায় পড়ে নিজেদের মূল্যবোধ নষ্ট না করে বৈধ ও ন্যায়ের পথে উপার্জন এবং জনসাধারণের কল্যাণ সাধন করতে হবে। আর কোথাও অন্যায় হতে দেখলে জনসাধারণকেই সচেতন হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। তবেই সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জন করা সম্ভব।
muftianaet@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.