দাভলাত খুদোনাজারভ-সিনেমার ওস্তাদ-রূপান্তর: শওকত হোসেন

‘তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের ঘনিষ্ঠ দিকগুলো তুলে ধরে। দর্শকদের নিজের বয়ানে অংশ নিয়ে তাঁর চরিত্রগুলোর সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়ার আহ্বান জানান তিনি। তাঁর সৃষ্টি অবাঞ্ছিত শোম্যানশিপ থেকে বহু দূরের,’ সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের কোন বিষয়গুলো তাঁকে আকৃষ্ট করে, তার বর্ণনা দিয়েছেন খুদোনাজারভ।


তদানীন্তন ইউএসএসআর ইউনিয়ন অব সিনেমাটোগ্রাফারসের সাবেক চেয়ারম্যান খুদোনাজারভ সত্যজিৎ রায়ের ছবির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পেছনে প্রভাবশালী জাপানি চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোসাওয়ার একটি মন্তব্যের কথা উল্লেখ করেছেন। ‘কুরোসাওয়া স্বীকার করেছেন যে রায়ের চলচ্চিত্র চলচ্চিত্রের ধারণার ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আমার কাছে এত দিন স্রেফ বিমূর্ত বিষয় হিসেবে রয়ে যাওয়া এই ভারতীয় নামকে কুরোসাওয়ার উক্তি যেন বাস্তব অর্থ দিয়েছে। কারণ, নামডাক সত্ত্বেও তখনকার দিনে রায়ের চলচ্চিত্র আমাদের সিনেমা হলে বা আর্কাইভসে দেখা যেত না। কিন্তু আমি বুঝে নিয়েছিলাম, এই ছবিগুলো না দেখলে আমার চলবে না।’
‘প্রথমবার পথের পাঁচালী দেখার কথা কখনও ভুলব না,’ সবেমাত্র চিত্রপরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করার সময় বাংলা ছবি দেখার স্মৃতিচারণা করেছেন খুদোনাজারভ। ‘ছবিতে কোনও সাবটাইটেল ছিল না, কিন্তু আমরা যেন পুরো অর্থই ধরতে পারছিলাম। মেয়ের মৃত্যুতে দুঃখভারাক্রান্ত বাবার জন্য রবিশঙ্করের সঙ্গীত গুমরে উঠলে আমরা চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি, মনে হচ্ছিল যেন সৃষ্টিশীলতার এক অলৌকিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছি। জীবন পরিণত হয়েছিল শিল্পে আর শিল্প হয়ে উঠেছিল জীবন, আমাদের চেতনার জীবন, আমাদের খোদ সত্তার জীবন, যা কোনওভাবে এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বদলে গিয়েছিল। অপর হয়ে উঠেছিল আমাদের আপনজন। সেই থেকে যে জগৎ আমাদের রায়কে দিয়েছে আর রায় আমাদের যে জগৎ দিয়েছেন তার অংশে পরিণত হয়েছি।’
পথের পাঁচালী (১৯৫৫) কান চলচ্চিত্র উৎসবে ১৯৫৬ সালে সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। সেই সময়ের মানবাধিকারকর্মী ও প্রায়শই উত্তাল সময়গুলোতে শান্তির পক্ষে তৎপর খুদোনাজারভ মনে করেন, এই সিনেমা থেকে তিনি অনেক কিছু গ্রহণ করেছেন; ‘রায় মানব জাতির সাধারণ ঘটনা আর আবেগগুলোই আমাদের নতুন করে দেখতে ও শুনতে বাধ্য করেন—জন্ম, শবযাত্রা, বন্ধুত্ব, বিবাদ, প্রেম আর অসহিষ্ণুতা, সৌজন্য ও পাপের প্রায়শ্চিত্ত। প্রবল ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে এসব কিছু রায় তুলে ধরেন আর সেগুলো এক সময় সারা বিশ্বের মানুষের জন্যই নতুন এক অর্থ হয়ে ধরা দেয়।’
নিজ দেশের সঙ্গে রায়ের চলচ্চিত্রের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেছেন খুদোনাজারভ। ‘দ্য হোম অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড (ঘরে বাইরে, ১৯৮৫) এই চলচ্চিত্র জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজন, সামাজিক বাগাড়ম্বর আর ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে আত্মপ্রেমের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে। কিন্তু উদার-গণতান্ত্রিক জাতীয় ঐকমত্যের পটভূমিতে ভালোবাসা ও আত্মবিসর্জনের অসামান্য ছবি চারুলতা (১৯৬৪)। চারুলতাকে না চিনলে কীভাবে কেউ কি তার প্রজ্ঞা অনুভব করতে পারবে? রাশিয়ার দর্শকদের জন্য আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছে সমাপ্তিসহ ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব অপু’ (অপুর সংসার, ১৯৫৯) যত দ্রুত সম্ভব দেখা উচিত: অপুর সংসার হচ্ছে ভাগ্য এবং ছেলের ভবিষ্যৎ দায়িত্বের সঙ্গে অপুর রফা, অসাধারণ কাহিনি।’
দ্য মিউজিক রুম-এ (জলসা ঘর, ১৯৫৮) খুদোনাজারভ জগতের মৌলিক পরস্পরবিরোধিতার সমন্বয় দেখতে পান। ‘এই ঐতিহাসিক নাটকটি গল্পকে ছাড়িয়ে গিয়ে সমাজ ও পুরুষের আত্মার মাঝে পুঞ্জীভূত গভীর বিশ্বাসঘাতকতার সন্ধান করেছে। সমস্যার সর্বজনীনতা ও চলচ্চিত্রের বিন্যাস এবং অধিকাংশ ভারতীয় দর্শকের কাছে দুর্বোধ্য অভিজাত শ্রেণীর ভাষা ও সঙ্গীতের ভেতর কি এক ধরনের স্ববিরোধিতা নেই?’ প্রশ্ন তোলেন খুদোনাজারভ।
জীবনের বেশির ভাগ কাজই যার নিষিদ্ধ হয়েছে বা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, রাজনৈতিক বিরোধে ভারাক্রান্ত সেই খুদোনাজারভের কাছে রায়ের দর্শনে রয়েছে আশা, ‘ব্যক্তির উপর সমাজের প্রাধান্যের ধারণায় বেড়ে ওঠা আমাদের কাছে সামাজিক সংঘাত অবসানের দার্শনিক সত্যে সন্ধানের বদলে রায়ের ছবিতে কীভাবে একজন ব্যক্তির সমস্যার সমাধান একটি জাতির কিংবা এমনকি গোটা বিশ্বের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সেটা দেখতে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।’
অতি উৎসাহী চলচ্চিত্রকার খুদোনাজারভ রায়ের চলচ্চিত্রকে এর ইউরোপীয় অনুপ্রেরণার সঙ্গে সম্পর্কিত করেছেন, ‘অনেক পরে এসে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, রায় ইতালীয় নিও-রিয়েলিস্টগণ ও আমাদের নিজস্ব পরিচালকদের মধ্যে আইজেনস্টাইন, পুদোভকিন ও দোনস্কয়ের কাছে ঋণী।’
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করতেই ১৯৮৭ সালে খুদোনাজারভ কলকাতা সফর করেন, ‘ঠিক কোনও মুসলিম যেভাবে মক্কায় যান, সেভাবেই রায়ের প্রতি সম্মান দেখাতে চেয়েছিলাম আমি। তিনি দীর্ঘদেহী মানুষ জানা থাকায় তাঁকে উপহার দেব বলে সঙ্গে করে সবচেয়ে বড় মাপের তাজিক জোব্বা নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিশাল মানুষটির পক্ষে সেটাও যেন ছোট হয়ে গিয়েছিল। আমি বরাবর জানতাম, চলচ্চিত্রকার ও মানুষ হিসাবে তাঁর মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় একটা কিছুর খোঁজ পাব। বাস্তবে আমাদের সাক্ষাৎ আমার সকল প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।’

দাভলাত খুদোনাজারভ (১৯৪৪—) বিশিষ্ট সোভিয়েত চলচ্চিত্রকার, রাজনীতিক, মানবাধিকারকর্মী। ১৩ মার্চ ১৯৪৪ তাজিকিস্তানের খোরাগে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সালে তাজিকিস্তান থেকে সুপ্রিম সোভিয়েত অব দ্য ইউএসএসআরের পিপলস ডেপুটি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে ইউএসএসআর ইউনিয়ন অব সিনেমাটোগ্রাফারসের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দুশানবে দাঙ্গার সময় সেনাবাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের ভেতর মধ্যস্থতা করেছিলেন তিনি। ১৯৯৪-৯৫ সালে ইউনাইটেড স্টেট ইনস্টিটিউটের পিস ফেলো ও কেনান ইনস্টিটিউট অব দ্য উইড্রো উইলসন সেন্টারের হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট রিসলিউশনের গালিনা স্তারোভোয়তোভা ফেলো ছিলেন তিনি।
সূত্র: ১৪ মার্চ সাক্ষাৎকারধর্মী এই লেখাটি প্রকাশিত হয় রাশিয়া ভারত রিপোর্ট ওয়েবসাইটে

No comments

Powered by Blogger.