সাহসঃ অঙ্গীকার ও প্রত্যয়ের নাম by আইয়ুব হোসেন

সাহস—একটি প্রত্যয়ের নাম। অঙ্গীকারেরও। প্রত্যয় ও অঙ্গীকার—এই দুয়ে মিলিয়ে সাহস’র প্রতিষ্ঠা ও পথচলা। বস্তুত সাহস নামটির মধ্যে সুপ্ত আছে প্রত্যয়। সেটা কী রকম! স্বাবলম্বী হওয়ার পথ সন্ধানে—এই বাক্যের সংক্ষিপ্তায়ন হলো সাহস। প্রত্যয়টা এখানেই।

সাহস যাদের নিয়ে, যাদের জন্য এবং যাদের দ্বারা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে তাদের অবলম্বন নিশ্চিত করে দিতে নিবেদিত। আপনার অবলম্বন আপনি। অর্থাত্ স্বঅবলম্বন তথা স্বাবলম্বী করে তোলা। অতঃপর অঙ্গীকার। সেটা কেমন! আমরা সবাই মিলে সুন্দর একটা কিছু ঘটিয়ে দেব—এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে এভাবে। সাহস নামীয় সংগঠনটির প্রত্যয় ও অঙ্গীকার থেকে এরকম ধারণায় উপনীত হওয়া যায় যে এটা সমাজের যে অংশকে নিয়ে কর্মরত, তাদের স্বাবলম্বী করে তুলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করা এ সংগঠনের মৌল লক্ষ্য। সাহস’র পরিচয় আমরা এখানে মেলে ধরতে পারি।
বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামই নৈসর্গিক শোভায় ঝলমলে। কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার ঝলম গ্রামটিও সবুজ-শ্যামল রূপ সুষমায় সন্দেহাতীতভাবে ঝলমলে। নামটির নির্বাচন হয়তো সে কারণে হতেও পারে। ঝলম আর সিঙ্গুর পাশাপাশি দুটি গ্রাম। নিতান্তই অজ দুটো গ্রাম। সরু এক চিলতে রাস্তা চলে গেছে গ্রামের বুক চিরে। রাস্তায় পথচারী হাতেগোনা। যন্ত্রযান নিতান্ত সংখ্যক দৃষ্টিগোচর হয়, তাও কদাচ। ডালপালা মেলে ধরে আছে নাতিদীর্ঘ বৃক্ষের সারি। রাস্তাটির বয়স তেমন বেশি নয় বলে বৃক্ষরাজি এখনও বাড়ন্ত নয়। ঝলম গ্রামের এই পথ ধরে হাঁটলে অকস্মাত্ই পথচারীর দৃষ্টিগোচর হবে একটা পরিকল্পিত ও পরিপাটি কমপ্লেক্সের। ফুলে ফুলে মোড়ানো যেন একটা কমপ্লেক্স। পুরো এক একর জমিজুড়ে বিস্তীর্ণ নয়নজুড়ানো কমপ্লেক্স। উত্তর পাশে শহীদ বেদি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অমর শহীদদের স্মরণে নির্মিত বেদি। তিনটি মুষ্ঠিবদ্ধ হাত দৃপ্ত ভঙ্গিতে উঁচিয়ে ধরা। পেছনে গোলাকৃতির দেয়াল, তাতে ডিম্বাকৃতির দুটো জানালা। বেদির সম্মুখভাগে সাদা প্লেটে লেখা—সাহস স্মারক স্তম্ভ।
বিশিষ্ট তরুণ ভাস্কর হাসিবুর রহমান কিরণ এই মনোমুগ্ধকর ভাস্কর্য-বেদি নির্মাণ করেছেন। কিরণ নীরবে-নিভৃতে কাজ করেন। বিদেশে তার কাজ-কর্মের বেশ কদর আছে। তার পরিশ্রমের ফসল এই বেদির সর্বাঙ্গে নজর বুলালে সাহসী হওয়ার প্রেরণা না জুগিয়েই পারে না। এর ঠিক পেছনে পুকুর, চারধারে মধ্য উচ্চতার গাছ-গাছালি ঠায় দাঁড়ানো। আলো-ছায়া খেলা করে পুকুরের নীতল জলে। পুকুরের প্রায় তীর ঘেঁষে দোচালা টিন ছাদের উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমে ইংরেজি এল আকৃতির লম্বা ঘর। স্কুল ঘর। স্কুলটির বয়স তেমন পরিণত নয়। সম্ভবত ৬ কিংবা ৭ বছর হবে। এর মধ্যে গড়ে তোলা পরিপাট্য যে কারও মনোযোগ আকর্ষণ করে। শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য নির্মিত এ কমপ্লেক্সের অবয়বে ফুটে উঠেছে নান্দনিকতার রূপ। প্রকৃতির মতো নিষ্পাপ শিশুদের উপযোগী পরিবেশই বটে। স্কুল ঘরগুলো রং-চংয়ে পরিপূর্ণ। টেবিল-চেয়ার-দেয়াল সর্বত্র জোরালো বাহারি রং, শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য নিশ্চয়ই। শ’ দুয়েক শিশু শিক্ষার্থী হবে হয়তো। ৫-৬ জন শিক্ষক রয়েছেন। একজন তরুণ কবি প্রতিষ্ঠানটির সমন্বয়কারী হিসেবে হাল ধরে সার্বিক দায়িত্ব পালন করছেন গোড়া থেকে। কবি বিধায় শিশু-বান্ধব তো হবেনই। নাম সবুর বাদশা। সাহস পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানের পাঠদানে ভিন্নতা রয়েছে। বিনোদন ও শিক্ষা—এ দুয়ের সংমিশ্রণে শিশুদের পাঠে মনোযোগী করে তোলা হয়। রয়েছে নানা ধরনের এক্সট্রা কারিকুলাম। শিশুদের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভার প্রতি সতর্ক মনোযোগ নিবদ্ধ করে তা পর্যায়ক্রমে উন্মোচন ও উত্কর্ষ সাধন করার দিকে নিয়োজিত থাকেন তরুণ প্রজন্মের শিক্ষকরা। নিদেনপক্ষে নিজ নিজ প্রতিভা পরিচর্যার মাধ্যমে যাতে এ দেশের কিছু সংখ্যক ভবিষ্যত্ নাগরিক স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, মূলত সেই প্রয়াসে রত সাহস।
সাহস কমপ্লেক্স, কমপ্লেক্সের ভূমি, স্থাপনা, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি যাবতীয় নির্বাহ করছেন একক অথবা বলা যায় পারিবারিকভাবে নাজমুল হুদা রতন। তার অগ্রজ খায়রুল এনাম আলম এবং তার করিত্কর্মা পুত্র এনামুল হুদা রবিনসহ তাদের পরিবারের সবাই কমবেশি সম্পৃক্ত রয়েছেন সাহস’র সব কর্মকাণ্ডে। কেবল স্কুল নয়, আরও কিছু কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে সাহস। জাতীয় গুরুত্ববাহী তিনটি দিনে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে গত কয়েক বছর যাবত। এর মধ্যে আছে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা নববর্ষ। আরও আছে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের গুণীজন সম্মাননা ও মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা দিয়ে চলেছে ফিবছর, সাড়ম্বরে।
সাময়িক পত্র ‘সাহস কথা’ এবং সৃজনশীল সাহিত্যের পুস্তক প্রকাশনার জন্য সাহস’র একটি টিম কাজ করছে। চারটি সংখ্যা বেরিয়েছে সাহস কথা’র। আর বই প্রকাশিত হয়েছে ৬-৭টি। এ বছরও হচ্ছে কিছু। সাহস প্রকাশনার নেপথ্যে কাজ করছেন বিশিষ্ট তরুণ ছড়াকার জগলুল হায়দার বাবু। সাহস নামটিও বাবুরই দেয়া। সাহস’র প্রাণপুরুষ রতনকে নিরন্তর প্রণোদনা ও পরামর্শ জুগিয়ে বাবু সতেজ রেখেছেন সাহস’র তাবত কর্মকাণ্ড।
নাজমুল হুদা রতন ব্যক্তিগত জীবনে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে স্বাবলম্বী ও প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছেন। রতন মৃদু ও ধীর লয়ে কথা বলেন, কিন্তু কর্মচাঞ্চল্যে মুখর একজন সজ্জন মানুষ। ঢাকার ডিওএইচএসে তার বাণিজ্যিক অফিসটিকে সাহস’র প্রকাশনা ও সম্পাদনা কার্যালয় হিসেবেও ব্যবহার করেন। সাহস নিয়ে অনেক ভাবনা ও পরিকল্পনা তার মনোজগতে ঘোরে-ফেরে। নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথ খোঁজেন। স্বাবলম্বী জাতির সর্বাঙ্গ সুন্দর নাগরিক গড়ার স্বপ্ন দেখেন এবং দেখানও।
একটা আদর্শ মডেল হয়ে উন্নত মস্তকে সজোরে বলুক সাহস—সম্ভব সুন্দর কিছু ঘটাবই। একদিন এই মডেলটি অপরাপর স্থানেও সম্প্রসারিত হবে আশা করি। আমরা সাহস’র তত্পরতায় সৃষ্ট স্বাবলম্বী একদঙ্গল নাগরিকের উজ্জ্বল পদচারণার প্রত্যাশায় থাকছি। সাহস আমাদের বিমুখ করবে না ভরসা রাখি।
লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক
ayubhoos@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.