বুড়িগঙ্গায় এক সময় পানি ছিল by রেজোয়ান সিদ্দিকী

বুড়িগঙ্গা এক সময় স্রোতস্বিনী ছিল। লঞ্চ-জাহাজ-কার্গো-নৌকা এসবও ছিল। নদী নাব্য ছিল। এই পথে লঞ্চে চলাচলের জন্য আরও রুট ছিল। বুড়িগঙ্গার সঙ্গে সংযোগ ছিল সিরাজগঞ্জ থেকে আসা ‘ধলেশ্বরীর’। কৈশোরে আমি টাঙ্গাইল জেলার এলাসিন ঘাট থেকে লঞ্চে করে ঢাকায় এসেছিলাম সারা রাত ধরে।

কোথায় কোথায় লঞ্চ থেমেছিল, মনে নেই। আকাশভরা জ্যোত্স্না ছিল। ধলেশ্বরীতে স্রোত ছিল। লঞ্চের ইঞ্জিনের একটানা শব্দ ছিল। ঢেউ ঠেলে জেগে ওঠা পানির উছলেপড়া ছলাত্ শব্দ ছিল।
আমাদের লঞ্চ যখন ধলেশ্বরীতে পড়ল, আমার চাচা বললেন, এখান থেকে বুড়িগঙ্গা শুরু। পাঠ্য বইয়ের রচনায় বুড়িগঙ্গার কাহিনী পড়েছি। ঢাকা নগরীর ইতিহাস পড়তে গিয়ে পড়েছি বুড়িগঙ্গার কথা। সে রচনার শুরুই ছিল, ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। আমি ভেতরে ভেতরে শিহরণ অনুভব করলাম। তখন রাত্রি শেষ। আমি বিস্ময়াভিভূত চোখে বুড়িগঙ্গার দিকে চোখ রাখি। পানির চেহারা আগের মতোই। ঢেউয়েও কোনো পরিবর্তন নেই। দূরে ছোট ছোট আলো জ্বালিয়ে আছে মাছ ধরার নৌকা। স্টিমার ঢেউ তুলে চলে যায়। তার ঢেউয়ে ছোট লঞ্চ দোল খায়। আমি বুড়িগঙ্গার দু’তীর দেখি।
ক্রমেই দেখি সারি সারি দালানকোঠা। কোনো কোনো বাড়ির জানালায় আলো। রাস্তার আলোয় সামান্য উজ্জ্বল ঢাকার আকাশ। আরও বেশি লঞ্চ, আরও বেশি মাছ ধরার নৌকা। মালবাহী নৌকা। খেয়া। টিমটিমে আলোর ফোটা বুড়িগঙ্গাজুড়ে। পূবের আকাশ ফর্সা হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গা বিপুল কর্মচাঞ্চল্য। পণ্যবাহী জাহাজ থেকে নামছে নানা পণ্যের বস্তা। মালের ঝাঁকা। কলার ছড়ি। ভেঁপু বাজিয়ে পথ করে চলে যাচ্ছে ডজন ডজন লঞ্চ তাদের গন্তব্যে। আমি ডেকে নেমে জানালা দিয়ে বুড়িগঙ্গার পানি ছুঁয়ে দেখলাম। আঁজলা ভরে বুড়িগঙ্গার পানি তুলে চোখমুখে ঝাপটা দিলাম। তারপর দেখি আহসান মঞ্জিল। ছেলেবেলা থেকে পাঠ্য বইয়ের পাতায় আহসান মঞ্জিলের ছবি দেখেছি। এবার চোখের সামনে। উত্তেজনায় শিহরিত হয়ে উঠলাম। এর পরেই সদরঘাট। আমরা লঞ্চ থেকে নেমে বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হলাম।
ঢাকায় স্থায়ীভাবে আমার বসবাস শুরু ১৯৬৯ সাল থেকে। প্রথম কিছুদিন থেকেছি বাংলাবাজার। খুব ভোরে বুড়িগঙ্গায় গোসল করতে গেছি। স্বচ্ছ টলটলে পানি। পানির ধারে গ্রামের পুকুরের মতোই ডানকানা কিংবা খসল্লার পোনা ভেসে বেড়ায়। জাল দিয়ে মাছ ধরে কেউ। কেউবা বড়শি ফেলে বসে আছে, মাছের গোসায়। তারপর থেকেই চুনকুটিয়ায়। প্রতিদিন ভোরে খেয়া নৌকায় বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে ঢাকায় আসা। আবার সন্ধ্যায় বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে চুনকুটিয়ার বাসায় যাওয়া। এ নিয়ে বুড়িগঙ্গা হয়ে উঠেছিল আমার দৈনন্দিন জীবনের সাথী।
এরপর সময় অনেক পেরিয়ে গেছে। নগর বেড়েছে। বেড়েছে নগরীর মানুষ। বুড়িগঙ্গার দু’পাশে গড়ে উঠেছে শিল্প-কলকারখানা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুবিধা অপ্রতুল হয়ে পড়েছে। চারদিক থেকে নানা আবর্জনা, বর্জ্য, গলিজ প্রভৃতি এসে পড়তে শুরু করেছে বুড়িগঙ্গায়। দূষিত হতে শুরু করেছে বুড়িগঙ্গার পানি। তার রিপোর্ট পত্র-পত্রিকায় পড়ে মন খারাপ করেছি। কিন্তু কখনও গিয়ে দেখে আসিনি বুড়িগঙ্গার করুণ দশা।
রামপুরা ব্রিজের নিচ দিয়ে বহমান এক খাল। এলাকাবাসী নদী বলে। একদিন বনশ্রীতে এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে আমি সবাইকে প্রস্তাব দিলাম, ‘চল যাই ওই নদীতে নৌকায় ঘুরে আসি।’ বাচ্চা-কাচ্চাসহ গোটা পরিবার ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল। সে খালের ধারে এসে দেখি সেখানে পানি, যেন আলাকাতরার ধারা বইছে। তরল পদার্থ বটে। কিন্তু পানি বলে শনাক্ত করার কোনো উপায় নেই। ঘন কালো এক তরল পদার্থ। তার মধ্যে চলছে নৌকা, ইঞ্জিনবোট, বালি টানার ট্রলার। খালের দু’ধারে জনপদও আছে। মানুষের বসতি আছে। তরল পদার্থে ভাসছে মৃত গরু, মরা কুকুর। অক্কা পাওয়া সাপ। এ পানির দুর্গন্ধে চারদিক বিষিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে নৌকাভ্রমণ। আমি সবাইকে বাধা দিলাম, ‘এই খালের ধারে-কাছে যাওয়াও ঠিক হবে না। তার চেয়ে চল সবাই দূরে বসে বাদাম, ঝালমুড়ি খেয়ে কিছুটা সময় পার করি।’
এরও মাস দুই পরে যাচ্ছিলাম বুড়িগঙ্গার প্রথম সেতু পেরিয়ে। দূর থেকেই পচা পানির গন্ধে নাকে রুমাল গুঁজতে হলো। নিচে বুড়িগঙ্গা। পানি নেই। ব্রিজের ওপারে গাড়ি রেখে কষ্টেসৃষ্টে বুড়িগঙ্গার তীরে নেমে এলাম রামপুরা ব্রিজের নিচে, যা দেখেছিলাম, তাই। সেখানে পানি নেই। কালো তরল পদার্থের সামান্য শীর্ণ স্রোতধারা। সম্ভবত এর মধ্যে কোনো জলজ প্রাণীরও অস্তিত্ব নেই। যদি কেউ থেকে থাকে নিশ্চয়ই সে জীবন্মৃত। এর ওপর দিয়ে যাচ্ছে নৌকা, লঞ্চ, পণ্যবাহী জাহাজ। দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। দ্রুত উপরে ওঠে গাড়িতে চাপি। যত দ্রুত সরে যাওয়া যায় বুড়িগঙ্গা থেকে ততই বুঝি স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা।
এখন বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য অপসারণ অভিযান চলছে, তাতে হয়তো ভাসমান ময়লা, পলিথিন, প্লাস্টিকের ক্যাইন উদ্ধার হচ্ছে। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে যে টনকে টন বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানিকে আলকাতরায় রূপান্তর করছে সেসবের উত্স বন্ধ হয়নি। বুড়িগঙ্গা মরতে বসেছে। তার দীর্ঘশ্বাসে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে আসছে। তার অভিসম্পাতে নগরীর স্বাস্থ্য বিপন্ন হচ্ছে। কিন্তু করার কি কিছুই নেই? আমরা কী কোনোভাবেই বুড়িগঙ্গায় ফের পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে পারি না?
এই যে মোদের নির্ভরতা
নাগরিকদের আদিখ্যেতার অন্ত নেই। তার কেবল চাই-ই চাই। সুইচ টিপেই আলো চাই, কল টিপেই পানি চাই। সান বাঁধানো পথ চাই। চুলা টিপেই গ্যাস চাই। যানজটবিহীন ট্রাফিক চাই। সময়মতো প্লেন ছাড়া চাই। সারাবছর নাতিশীতোষ্ণ হাওয়া চাই। যখন তখন চাকরি চাই। ভর্তি হওয়ার সুযোগ চাই। ঈদ পার্বণে বোনাস চাই। সব নদীতে সেতু চাই। একটা পেলে আর একটা চাই। এভাবে অবিরাম চাওয়ার এক বিশাল বদস্বভাব নাগরিকদের পেয়ে বসেছে—তাদের শুধু চাই আর চাই।
কিন্তু এই চাই পূরণের দায়িত্বে যারা নিয়োজিত আছেন তাদের আবার এসব চাই চাই ভাবটি বড় বিষের মতো লাগে। তত্ত্বাবধায়ক নামক সামরিক সরকারের আমলে গ্রীষ্মে বিদ্যুত্ চেয়েছিল নাগরিকেরা, তাতে ভারি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বিদ্যুতের এক কর্মকর্তা। ওই সরকারের এক চোমড়াকে খুশি করার জন্য বিদ্যুত্ বিভাগের কর্মকর্তা বলে বসেছিলেন, সুইচ টিপলেই বিদ্যুত্ পায়তো, তাই বিদ্যুত্ চাই বিদ্যুত্ চাই বলার একটা বাজে মানসিকতা তৈরি হয়ে গেছে। এতো বিদ্যুত্ বিদ্যুত্ কেন করে নাগরিকরা। এরাই যখন গ্রামে ছিল তখন হ্যারিকেন-কুপির আলোয় সব কাজ সারতে পেরেছেন। এখন ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুত্ চাই। এই ফুটানি প্রশ্রয় দেয়া যায় না। ওই সরকার তা দেয়ওনি। বিদ্যুতের দাবিতে মানুষ মিছিল করেছে। বিদ্যুত্ কেন্দ্র ঘেরাও করেছে। সড়ক অবরোধ করেছে। যানবাহন ভাংচুর করেছে। সরকার তার ক্ষমতাবলে নাগরিকদের ডান্ডাপেটা করেছে।
নাগরিকদের বাড়াবাড়িও সীমাহীন। লেখাপড়ার জন্য বিদ্যুত্ চাই। এসির জন্য বিদ্যুত্ চাই। রিফ্রিজারেটরের জন্য বিদ্যুত্ চাই। কল চালাতে বিদ্যুত্ চাই। পানি উঠাতে বিদ্যুত্ চাই। ডিপ বা শ্যালোর জন্য বিদ্যুত্ চাই। কেন? তোমরা কি তোমাদের পূর্ব পুরুষদের কথা ভুলে গেছ, তারা কি মানুষ ছিলেন না? তারা কি চাষাবাদ করেননি? কি সুন্দর দোন দিয়ে পুকুর থেকে পানি নিয়ে জমিতে সেচ দিয়েছেন। কত পরিবেশ বান্ধব ছিল সেসব কর্মকাণ্ড। এখন ডিজেলচালিত ইঞ্জিন দিয়ে পানি তুলছে মানুষ। জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে পরিবেশ বিষাক্ত করছে। তবু তাদের হুঁশ হয় না। খাঁই মিটে না।
তারপরও মানুষের বিদ্যুত্ চাই-ই চাই। এখন আবার নতুন আদিখ্যেতা হয়েছে গ্যাস নিয়ে। এই নগরীর বয়স চারশ’ বছর। গ্যাসের বয়স ৭০-৮০ বছর। এই গ্যাস আসার আগে মানুষ কি এই নগরীতে রান্নাবাড়া করে খায়নি। গ্যাসের চাপ কম বলে নাগরিকরা শূন্য হাঁড়ি-কুড়ি নিয়ে মিছিল করে। গ্যাস চাই। আরে বাবা গ্যাস থাকতে হবে তো। সরকার তো আর গ্যাস পয়দা করে না। এমন যুক্তি হামেশাই উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু নাগরিকরা এসব যুক্তি মানে না। গ্যাস তাদের চাই-ই চাই।
কেন? তোমাদের পূর্ব পুরুষেরা, তোমাদের মায়েরা কি তোমাদের রান্না করে খাওয়ায়নি। তারা তো গ্যাসের নামও শোনেননি। তোমরা কি মেধা প্রতিভা নিয়ে বেড়ে উঠোনি। সুবিধা একটা পেলে সেটা আর কিছুতেই ভুলতে চাও না। দাও-দাও, চাই-চাই বলে হুলুস্থূল বাধিয়ে ফেল। এ যে কেমন বদস্বভাব নাগরিকদের।
পত্রিকার খবর পড়ে মনে হয় নগরীর নানা স্থানে গ্যাসের চাপ কম। ফলে চুলা জ্বলে না। অনেকেই গ্যাসের চুলার আলগা চুলা বসিয়েছে। খড়কুটো আর চেলা কাঠ দিয়ে রান্নাবান্না শুরু করেছে। শাসকেরা সম্ভবত এটাই চাইছেন। নাগরিক ফিরুক আদিম অরণ্যে। নাগরিক দৃষ্টি দিক তার উেসর দিকে। ফিরে যাক ফেলে আসা আদিম জীবনে। যদিও নাগরিকের দাবি হল গ্যাসের চাপ নেই। চাপ বাড়াতে কমপ্রেসার লাগাও। কমপ্রেসার একখানা লাগানোর পরিকল্পনা নেয়া হলো। সেও এমন স্থানে যেখানে গ্যাসের চাপ যথেষ্টই আছে। যেখানে চাপ নেই সেখানে বসল না কমপ্রেসারটি।
নাগরিকদের নিয়ে এও এক বিপদ কম নয়। তারা অনেক খুঁটিনাটি নিজেরাই বুঝে ফেলে। তার ওপর ইন্টারনেট-ওয়েবসাইট নামের নতুন যন্ত্রণা এসে দাঁড়িয়েছে শাসকদের সামনে। এগুলোই ঘেঁটেঘুটে প্রকৃত সত্য বের করে আনে। তারপর চিল্লায়। এভাবেই নাগরিকরা সারাদেশে অশান্তি সৃষ্টি করে। শাসকেরা কখনও কখনও তাদের শান্ত করার জন্য নানারকম যুক্তি দেখায়। আশা দেয়। তোয়াজ করে। কখনও কখনও নাগরিকদের ধরে হেভি পিট্টি দেয়। নাগরিকরা সাধারণত প্রাথমিকভাবে এসব নির্যাতন মেনে নেয়। তারা একদিন প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে। সে ফুঁসে ওঠার শক্তি জলোচ্ছ্বাসের চাইতেও প্রবল থেকে প্রবল বেগে অপগণ্ড শাসকদের তখতে তাউস ভেঙেচুরে কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তখন হম্বিতম্বি আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
ফুটনোট
একটি স্কুলের নবীনবরণ অনুষ্ঠানের ব্যানারে লেখা, ‘৩য় শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের নবীণ বরন অনুষ্ঠান।’ ব্যানারে এরকম বানান দেখে এক অভিভাবক একজন শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নবীন বরণের এমন বানান কেন?’ শিক্ষক ঝটপট বললেন, ‘ঐ হলো, এতে নবীনরা প্রবীণ হয়ে যাবে না।’

No comments

Powered by Blogger.