চারদিক-৪০ বছর পর by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

বেঁচে আছেন এমন ২৩ জন একে একে এসে উপস্থিত হলেন রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্টহাউসে। আগে থেকে সবাই জানতেন এই সভায় আসবেন না শমসের আলী। তিনি যুদ্ধের ময়দানেই শহীদ হয়েছিলেন, কিন্তু দলের আরও ছয়জন এলেন না। পরস্পরের মুখে মুখে জানাজানি হয়ে গেল, তাঁদের আরও তিনজন আর পৃথিবীতে নেই।


যাঁরা এলেন তাঁদের মধ্যে নাজির আহম্মেদ খান ছিলেন নিউইয়র্কে, অন্যরা রাজশাহী-ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। একাত্তরে নাজির আহম্মেদ খান ও আজাদ আলীর (বীর প্রতীক) নেতৃত্বে ৩০ সদস্যের একটি দল ৭ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছিল। তাঁদের ২৫ জন একসঙ্গে ভারতের চাকুলিয়ায় প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। বাকিরা স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এই দলের ২৬ জন এখনো বেঁচে আছেন। তাঁদের ২৩ জন এসেছিলেন রাজশাহীতে। গত ৪০ বছরের মধ্যে তাঁরা আর কখনোই একসঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পাননি।
তাঁদের মধ্যে রবিউল আলম ওরফে আবু রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মচারী ছিলেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আনছার আলী এর আগে রাজশাহীতে কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধের সাথি আনছার আলীকে পেয়ে আবু তাঁর কাছে দীর্ঘদিন থেকে সবাইকে একখানে করার বায়না ধরে আসছিলেন। আনছার আলী বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যান। অবশেষে গত ২৪ মার্চ আসে সেই দিন।
এই দলে ছিলেন তিন মোজাম্মেল। তাঁদের একজন পরে বড় শিল্পপতি হয়েছেন। বড় কর্মকর্তাও হয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় তাঁর গলায় গুলি লেগেছিল। আবু তাঁর নাম দিয়েছিলেন গলা ফুটা। আর এক মোজাম্মেলের নাম দিয়েছিলেন বুড়্যাহ। অপর মোজাম্মেলের নাম দিয়েছিলেন জিপ্পু। ৪০ বছর পর সেদিন তাঁদের তিনজনকে সেই নামেই ডেকে উঠলেন আবু। তাঁরাও সাড়া দিচ্ছেন, দেখে সবাই হতবাক।
সেখানে নাজির আহম্মেদ খানকে সভাপতি করে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সভা শুরু করা হয়। কথা বলতে গিয়ে একে একে সবাই স্মৃতির ভারে আক্রান্ত হয়ে পড়ছিলেন। মাহবুব উল গনি এখন জনতা ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক। তিনি সে সময় বয়সে ছোট ছিলেন। যুদ্ধের সময় তাঁকে নিয়ে চারঘাটের ইউসুফপুরে এসে বিপদে পড়েছিলেন আকছাদ আলী। তাঁরা ইউসুফপুরে আসার পর রাজাকাররা তাঁদের অবস্থান জেনে যায়। বাঁচতে হলে রাতেই তাঁদের পদ্মা নদী পার হয়ে ভারতের সীমানায় গিয়ে উঠতে হবে। কিন্তু মাহবুব উল গনি সাঁতারও জানতেন না। আকছাদ আলীর বড় ভাই একটি কলাগাছ কেটে তাঁদের দুজনকে পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দেন। মাহবুব উল গনি কলাগাছ জড়িয়ে ধরে থাকলেন। আর আকছাদ আলী সাঁতরে কলাগাছ টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। ৪০ বছর পর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আকছাদ আলী হাঁপিয়ে উঠছিলেন। বললেন, ‘এখনো ভাবলে বিশ্বাস হয় না যে আমরা সেই রাতে পদ্মা নদী পার হয়েছিলাম।’ অবশ্য একসময় মাহবুব উল গনি আর পারছিলেন না। আর কিছুক্ষণ কলাগাছ ধরে থাকতে হলে মাহবুব উল গনি ভেসে যেতেন। আকছাদ আলী এখন শারীরিকভাবে প্রায় অচল হয়ে গেছেন। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। অথচ তাঁর কথা শুনে মনে হচ্ছিল তিনি কালকের কথা বলছেন। একে একে নিজের বর্তমান অবস্থার বর্ণনা দিয়ে স্মৃতিচারণা করছেন সবাই। লোকমান হোসেন, ওয়ায়েজ উদ্দিন, আবদুস সাত্তার, মকছেদ আলী, আফছার আলী, ইজাহার আলী, সাদেক আলী, ছমির উদ্দিন, মুহম্মদ শফিউর রহমান, আবদুল জলিল মোল্লা, আতাউর রহমান, হামিদুল হক, আবদুল হান্নান। বলতে বলতে সবাই আবেগে কাঁপছিলেন। আজাদ আলী বীর প্রতীক বললেন, কীভাবে ট্রেন উড়াতে গিয়ে তাঁরা উড়ে গিয়েছিলেন। বললেন, তিন মোজাম্মেল। মোজাম্মেল জিপ্পু চরম হতাশার কথা ব্যক্ত করে বললেন, ‘আলাইপুর ক্যাম্প অপারেশনে আমাদের চোখের সামনে মর্টার শেলের আঘাতে শহীদ হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শমসের আলী। ৪০ বছর পরও তাঁর নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আমরা তুলতে পারিনি। একই নাম হওয়ায় অপর এক শমসের আলীর পরিবার শহীদ মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধিকার হিসেবে মাসে মাসে সরকারের কাছ থেকে ভাতা পাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা শমসের আলীর পরিবার আজ ভিটেছাড়া হয়ে অন্যের জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। আমরা শমসের আলীর পরিবারের জন্য কিছুই করতে পারিনি।’ সহযোদ্ধাদের পেয়ে কথা বলতে গিয়ে হায়দার আলী চারদিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার বিষয় নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। কথায় কথায় নাজির-আজাদ ইউনিটের ১৪টি অপারেশনের গল্প শোনা হয়ে গেল। বাঘার ঐতিহাসিক তেঁতুলতলার অপারেশনের গল্প শুরু করেছিলেন আজাদ আলী বীর প্রতীক, কিন্তু একা আর শেষ করতে পারলেন না। আনছার আলী বলে ওঠেন, তিনি প্রথম ফায়ার করেছিলেন। এরপর কে কোথায় কীভাবে অংশ নিয়েছিলেন, সবাই একের পর এক নাটকের মতো দৃশ্য পরম্পরায় বলতে লাগলেন।
মাহাবুব উল গনি বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক ব্যাপার ছিল। অথচ আমরা এখন বৈষয়িক সুবিধার জন্য আন্দোলনে যাচ্ছি। চেতনাবিরোধীদের বিরুদ্ধে যাচ্ছি না। তাহলে আমরা কি এখন আর চেতনা ধারণ করি? রাষ্ট্রযন্ত্রের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তারপর আরও আলোকিত কোনো রাজনৈতিক শক্তি এলে এ দায় থেকে জাতিকে মুক্তি দেবে। আমরা দুঃখ নিয়েই মাটিতে মিশে যাব।’
এত হতাশার কথার পরও তাঁরা একটা অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করলেন। কীভাবে চেতনার সঙ্গে থাকা যায়। কীভাবে পরস্পরের সুখ-দুঃখে অংশীদার হওয়া যায়। দলের যাঁরা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা পাননি, তাঁরা তাঁদের সন্তানদের খোঁজখবর রাখবেন। চলতে সহযোগিতা করবেন।
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

No comments

Powered by Blogger.