মনের কোণে হীরে-মুক্তো-একটি বিনষ্ট নগরী হিসেবে ঢাকা কি অবশেষে পরিত্যক্ত হবে by ড. সা'দত হুসাইন

ঢাকা। আমার প্রাণের ঢাকা। গ্রামের বাড়িতে পাঁচ বছর এবং নোয়াখালী শহরে ১০ বছর। মোট ১৫ বছর ছাড়া আমার সারাজীবনই কেটেছে ঢাকা শহরে। মাঝেমধ্যে কয়েক মাস বা বছর বিদেশে থেকেছি উচ্চ শিক্ষার্থে। তবে ঢাকার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখে।
ঢাকায় আমার চেতনার উন্মেষ হয়েছে, আমার পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব যাদের আমার সম্প্রসারিত অবয়ব মনে করি, আমার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। আন্দোলন, সংগ্রাম, সুখ-দুঃখের মধ্য দিয়ে আমরা বড় হয়ে উঠেছি। কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি। প্রথম কিংবা দ্বিতীয় কর্মজীবন শেষ করে নতুন কর্মজীবন শুরু করেছি।
ষাটের দশকে আমি যে ঢাকাকে দেখেছি তা ছিল ছোট কিংবা বড়জোর মাঝারি আকারের একটি প্রাদেশিক শহর। রাস্তা-ঘাট ছিল অপ্রশস্ত, গাড়িঘোড়া ছিল কম। বিশাল ভবন ছিল হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র; সুউচ্চ ভবন ছিল না বললেই চলে। ৯তলা সমবায় ভবন এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ছিল বোধ হয় সবচেয়ে উঁচু ভবন। ছোট আকারের শহর হওয়ায় এর প্রতিটি জায়গাই ছিল আমাদের বড় আপন। আমরা রিকশায় করে প্রায় পুরো ঢাকা ঘুরে বেড়াতাম। বিশেষ করে হল সংসদের নির্বাচনের আগে ভোট চাইতে 'এটাচড্ স্টুডেন্ট'দের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধরনা দিতাম। নতুন ঢাকা আর পুরান ঢাকা বলে কিছু ছিল না। পুরোটাই ঢাকা শহর। সদরঘাট, পাটুয়াটুলি, বখশিবাজার, নবাবপুর, ভিক্টোরিয়া পার্ক, ওয়ারি, টিকাটুলি, নাজিমুদ্দিন রোড, পল্টন, মতিঝিল, মালিবাগ, শান্তিনগর, কাকরাইল, ধানমণ্ডি, আজিমপুর, তেজগাঁও, ইস্কাটন- সবই যেন ছিল একসূত্রে গাঁথা, আমাদের হাতের মুঠোয়। যেখানেই যেতাম, মনে হতো আমরা নিজের জায়গাতে আছি, একটু পরেই হলে ফিরে যাব।
ঢাকা ছিল ছায়া সুনিবিড়। ছোট ছোট খেলার মাঠ আর খোলা জায়গার অভাব ছিল না। এখানে-সেখানে জলাশয়ও আমাদের চোখ পড়ত, তবে এর দুষ্প্রাপ্য ছিল না বলে জলাশয়ের ওপর আমরা তেমন গুরুত্ব দিতাম না। নদী বলতে কিন্তু বুড়িগঙ্গাকেই বোঝান হতো। বালু, তুরাগ, শীতলক্ষ্যার তেমন একটা পরিচিতি ছিল না। তখন রিকশা করে বুড়িগঙ্গার পাড়ে যাওয়া একটা সহজ ও স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। বিলঝিল ও জলাভূমির অভাব ছিল না। এককথায় ঢাকা ছিল ছোট্ট ও সুন্দর বাসযোগ্য একটি শহর। ঢাকা বড় হবে, তিলোত্তমা নগরী হিসেবে সারা বিশ্বে এর সুনাম ছড়িয়ে পড়বে- এটিই ছিল আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের বিশ্বাস।
আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের বিশ্বাস আজ সম্পূর্ণরূপে পরাভূত। গত কয়েক বছর ধরে যা দেখছি, যা জেনেছি এবং সাম্প্রতিককালে পত্রপত্রিকায় যেসব লেখা পড়ছি, তাতে আতঙ্কিত না হওয়ার কোনো কারণ নেই। এক মহাবিপজ্জনক পরিস্থিতি এ শহর এবং এর নাগরিক অর্থাৎ আমাদের গ্রাস করতে চলেছে।
স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকা শহরের বাড়িঘর ও সম্পদের প্রতি সমাজের প্রভাবশালীদের লোভতুর দৃষ্টি পড়ে। আশির দশক থেকে এ দৃষ্টি সরাসরি মহানগর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ভূমির ওপর নিবদ্ধ হয়। খাল-বিল ও জলাশয়ও ভূমির সঙ্গে যোগ হয়। প্রশাসনযন্ত্র ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পদগ্রাসী গোষ্ঠী এবং দখলবাজ চক্র নগরীর খালি জায়গা, খেলার মাঠ, খাল-বিল-জলাশয় দখল করতে শুরু করে। গুলশান-বনানীর মূল পরিকল্পনায় বিভিন্ন ব্লকের মধ্যে যেসব খালি জায়গা ছিল প্রভাব খাটিয়ে সেসব জায়গা ব্যক্তির নামে বরাদ্দ করিয়ে নেওয়া হয়। যেসব জায়গায় শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করত, বয়স্করা হাঁটাহাঁটি করতেন সে জায়গাগুলোতে বিশাল ভবন তৈরি হয়েছে। ইট-পাথরের রুক্ষতা শিশু-কিশোরদের হাসি কেড়ে নিয়েছে। বয়স্করা অনেকেই হাঁটাচলা বা বৈকালিক ভ্রমণ ছেড়ে দিয়েছেন। চারদিকে শুধু ভবন আর ভবন। কোথাওবা নতুন করে নির্র্মাণকাজ শুরু হয়েছে। একসময়ের খোলামেলা নয়নাভিরাম জায়গা আজ আক্ষরিক অর্থে কংক্রিট জঙ্গলে পরিণত হয়েছে ।
স্রোতের মতো লোক এসেছে ঢাকা শহরে। এখনো আসছে। এ স্রোত নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ ছিল না। নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তাও করা হয়নি। বিদ্যমান সব সুবিধা ঢাকায় কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে গ্রামাঞ্চলের ধনী লোকরাও পাড়ি জমিয়েছেন ঢাকায়। কিনেছেন প্লট, ফ্ল্যাট, গাড়ি-বাড়ি। এত লোক, তাদের ঘরবাড়ি, গাড়িঘোড়া, শীতাতপ যন্ত্র, কল-কারখানার চাপে ঢাকা নগরীর তাপমাত্রা বেড়েছে কয়েক ডিগ্রি। রাস্তায় চলাচল হয়ে পড়েছে বিরক্তিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। পানির স্তর নেমে গেছে কয়েক মিটার। ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি এখন দূষিত, বিপজ্জনক। আশপাশের শিল্প-কারখানার বর্জ্য পড়ে বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ, শীতলক্ষ্যার পানি বিষাক্ত। এ পানি পান করে এখন লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ভবিষ্যতে অবস্থার আরো অবনতি ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মানুষের চাপে যেন পুরো নগরী ডুবতে বসেছে।
ঢাকা মহানগরীতে এখন জলাশয়গুলো বিলুপ্তপ্রায়। ভরাট করা জলাশয়ের ওপর গড়ে তোলা হয়েছে সুরম্য অট্টালিকাগুলো, যা প্রভাবশালীদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। জলাশয় ভরাট করার ব্যাপারে মূল ভূমিকা পালন করেছে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এবং আগ্রাসী ব্যক্তিরা। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের কেউ জলাশয় রক্ষার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হননি। এ ব্যাপারে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা বলা প্রাসঙ্গিক হবে। আমাদের নিকুঞ্জ (দক্ষিণ) আবাসিক এলাকার পশ্চিম পাশে 'নিকুঞ্জ লেক' নামে একটি লেক বা জলাধার রয়েছে। বিশাল শিল্পপতি, সমাজের গণ্যমান্য প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং অঢেল টাকার মালিকরা এ লেক ভরাটের কাজ শুরু করলে আমরা পরিবেশ রক্ষাসংক্রান্ত সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। একমাত্র 'পরিবেশ বাঁচাও' ছাড়া আর কোনো সংস্থা আমাদের সাহায্য করতে রাজি হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তর আমাদের জানাল যে এটা তাদের দায়িত্ব নয়, পূর্ত মন্ত্রণালয় আমাদের চিঠিকে পাত্তাই দিল না, রাজউক নির্বিকার, পরিবেশবাদী সংগঠন থেকে বলা হলো লেকের নিচের জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন। সুতরাং এ ক্ষেত্রে তারা কিছু করতে পারবে না। আমরা এলাকায় আন্দোলন করলাম, মানববন্ধন করলাম। কিছুই হলো না। স্তম্ভিত হয়ে আমরা দেখলাম এরূপ একটি গভীর জলাধার বা লেক যাতে সারা বছর পানি থাকে, তাকে রাজউকের দলিলে দেখানো হয়েছে 'লো-লাইং প্যাডি ফিল্ড' অর্থাৎ ধানচাষের নিচু জমি। অবশেষে উচ্চ আদালতে আমরা মামলা করে ভরাটের কাজ আংশিক বন্ধ করালাম। কিন্তু ইতিমধ্যে অর্ধেক লেক ভরাট করা হয়ে গেছে। জানি না, লেকের এ অংশ কোনো দিন আর পুনর্খনন করা সম্ভব হবে কি না। আসলে যাঁরা অঢেল টাকার মালিক সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো তাদের পক্ষেই কাজ করে। পরিবেশ এবং নাগরিকের ভবিষ্যৎ কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় ব্যক্তির স্বার্থ কোনো বিবেচনাতেই আসে না।
এখন প্রায় নিশ্চিতভাবেই জানা গেছে যে নগরীর অনেক অঞ্চলের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি নিষ্কাশনের উপযোগী জলাধার নেই বললেই চলে। সুউচ্চ ভবন অনেক বেশি, গাড়ির সংখ্যা অত্যধিক, রাস্তা অপর্যাপ্ত, বাঁধভাঙা জনস্রোত ধেয়ে আসছে, কল-কারখানা, শীতাতপযন্ত্র তাপ ছড়াচ্ছে অপ্রতিরোধ্যভাবে, বনায়নের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বিশ্ব মানের জরিপে ঢাকার স্থান হয়েছে পৃথিবীর দ্বিতীয় নিকৃষ্টতম নগরী হিসেবে। সংবাদপত্রের অনেক প্রতিবেদক ও বিশ্লেষকের মতে, ঢাকা এখনই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। মফস্বল থেকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব যাঁরা আসেন তাঁরাও ঢাকার এ অধঃপতন সরাসরি অনুভব করতে পারেন। তাঁদের কেউ কেউ তাড়াতাড়ি মফস্বলে ফিরে যেতে চান। যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া আদৌ সম্ভব হবে কি না, সে নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ পরিত্রাণের জন্য যে ধরনের সংস্কার, পরিবর্তন এবং ভাঙা পড়ার প্রয়োজন, তা করা কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না বলে মনে করেন অনেকেই। তার চেয়ে বর্তমান ঢাকার অদূরে নতুন রাজধানী শহর গড়ে তোলা সহজসাধ্য হতে পারে। তবে কি একটি বিনষ্ট নগরী হিসেবে ঢাকা অবশেষে পরিত্যক্ত হবে?

লেখক : সাবেক সচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.