চারদিক-যাচ্ছি আনন্দগ্রামে by আজাদুর রহমান

ভেবেছিলাম হরিণখোলায় গিয়ে দম নেব। পাটকেলঘাটা পার হতে গিয়ে আটকে গেলাম। বেতনা বাঁকতে বাঁকতে ব্রিজতলায় এসে মোচড় দিয়েছে। তারপর ধনুকের ছিলা হয়ে দক্ষিণে চলে গেছে। চন্দ্রকার তীর ধরে শ্যামলা উপত্যকা উঠে গিয়ে গাছালির তলে তলে বাস্তুভিটা। ভাটার শেষ কলি চলছে বলে কলকলিয়ে পানি নেমে যাচ্ছে এখন।


আর তিরতিরে হয়ে যাচ্ছে নদীটা। কাদায় গাঁথা নৌকাগুলো নিশ্চয়ই গত রাতে আটকা পড়েছে। এমন নরম দৃশ্য একদাগে দেখতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার! মিনিট দশেক পরই অবশ্য থম ধরবে। তারপর উল্টো দমকে ক্রমেই দৃশ্যগুলো পাল্টে যাবে। হয়তো মাইল পাঁচেক দক্ষিণে জোয়ারের মুখ আছে। পানি ফুলতে ফুলতে দু-তিন তলা হয়ে গেলে ছিটিয়ে থাকা নৌকাগুলো ভেসে উঠবে। ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করতে হবে। দৃশ্যের মায়া থেকে চোখ সরিয়ে নিতে হলো। আপাতত হরিণখোলাকে মনে রেখে গতি বাড়িয়ে দিলাম। ডুমুরিয়ার আঠারোমাইল ছুঁয়ে তালা। তারপর মেঠো পথ। কেউটে পথটা ডালে ডালে ভাগ হয়ে গেলে পথিকেরা আমাকে পথ দেখায়। হাসিমুখে আলাপ তুলতে চায়, ‘ভাইজান, কো থেকি এইলেন।’ দায়সারা উত্তর ছুড়ে দিয়ে একতালে দক্ষিণে যেতে থাকি।
জিয়ালাকে দুধগ্রাম বলা যায়। খোদ শহুরে মানুষও জিয়ালাকে আলাদা নজরে দেখে। দুধ বেচেই একরকম নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে জিয়ালা। দু-চারজন আনাড়ি হাভাতে বাদে নিবাসীরা স্বাবলম্বী, স্বাস্থ্যবান আর আমুদে। ঘরে ঘরে দুধেল গাই আর কোমলা বাছুর। এমন সুখমুখো জনপদে আমুদে লোকের অভাব হয় না। কমপ্লিট একটা লাঠিয়াল দলের খোঁজ পেয়ে গেলাম। পথের কোমরেই আসিরুলের বাড়ি। পাল্লা আছে, তাই খেলোয়াড়েরা আগাম জমা হচ্ছে আসিরুলের বাড়িতে। প্র্যাকটিস করাই আছে, তার পরও লাঠি ঠেকানো এবং লাঠি দিয়ে আঘাত করাই যেখানে বড় কাজ, সেখানে হাত চালু না রেখে উপায় কী? আসিরুলেরা সহজ-সরল মানুষ। ভদ্রলোকদের মতো তাঁরা মুখ মনের আড়াল রাখেন না। ‘ভাই, আপনের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। শুনলাম, আপনি লাঠিয়াল’—ব্যস, এটুকু বলাতেই কপালের ভাঁজ নেমে গেল। বারান্দায় মাদুর পাতলেন। স্ত্রী নাজমা অন্দর থেকে দাওয়ায় বসলেন। পরিবেশটা সাদাসিদে হয়ে গেল। দলের লোকজন কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভূমিকা লাগল না। আপনিতেই গল্পের নদী বয়ে চলল। লাঠিয়াল হিসেবে সে-ও তো প্রায় ১৫ বছর। ‘জিয়ালা জোয়ান লাঠিয়াল’ দলে আসিরুলকে নিয়ে এখন ১২ জন। জার্সি, টুপি ও ঘুঙুর থেকে শুরু করে যা যা লাগে, সব আছে। জার্সির কথা উঠতেই আসিরুল জটলা ফেলে ঘরের ভেতর চলে গেলেন। তারপর নতুন জার্সি গায়ে পরে সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘ন্যান, ছবি তোলেন।’ যোগ্যতায় যেতে গিয়ে তাঁকে কম লাঠিপেটা হতে হয়নি। কনুই উঁচু করার পর টের পেলাম, লাঠির বহু আঘাত খেয়েই তবে লাঠিয়াল হওয়া যায়। আঙুলের জয়েন্টগুলো পর্যন্ত কটকটা আর শক্ত হয়ে গেছে। এত ঝুঁকির পরও খেলেন কেন? আসিরুল হেসে উঠলেন, ‘দ্যাকেন, এ নি ভাবলি লাঠিয়ালের মান থাকে না। এতি আমুদের জন্যি খেলি, এতি তো হিম্মতের খেলা।’ কেমন আনন্দ-উৎসব হয়? ব্যাখ্যায় নামার আগে বৃদ্ধ খলিলুর রহমান চশমা খুলে হাতে রাখলেন। তারপর শ্লেষ্মাভেজা গলাটা খাঁকারি দিয়ে গলা ছাড়লেন, ‘শোনেন, লাটি খেলা তো এমমি এমমি হবিনানে, সাতে ঢোল-কাঁসি ইয়াতি বাজানি লাগে। ই খেলার আলদা একটা বাজনে আছে। বাজনে শুনলি মানুষি এমমি বুঝতি পারে যে লাটিখেলার বাজনে বাইজতেছি।’ যেসব শরমেন্দা মেয়েছেলে এতক্ষণ অন্যদিকে চাহনির ভান করে কথা শুনছিল, তারাও এখন কাছে এসে কথার মানে ধরছে। একজন জব্বারকে ইশারা দিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘মতির বাপ, উজি দা-ও আর আগুন খেলার কতাটা কও নাকে।’ বর্ণনায় যা পেলাম, তা হলো তাকত দেখানোর পাশাপাশি দর্শকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে তাঁরা বিপজ্জনক খেলা করেন। ধারালো দায়ের মাথায় ত্যানা পেঁচিয়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরানো হয়। তারপর জ্বলন্ত তিনখান দা শূন্যে ছুড়ে দিয়ে হাত বদল করে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ধরতে হয়। বিরাট হাততালি পড়ে যায়। উনিশ-বিশ হলেই ক্ষত-বিক্ষত হতে হবে। কিন্তু মামুলি কাটাকুটি বাহাদুরির চেয়ে বড় নয়। এমনি এমনি লাঠি চালালে হবে না। ঢোলের তালে তালে পায়ের গোড়ালি তুলতে হবে আর শরীর দুলিয়ে আক্রমণ করতে হবে প্রতিপক্ষকে। পা তুললেই বেজে উঠবে দুই শত ঘুঙুরের বিছা। থামলে চলবে না। বিপক্ষ দল তো কমে ছাড়বে না। তারাও কারিশমা দেখাবে। হেরে গেলে মানসম্মানের ব্যাপার। সে জন্যই নতুন করে প্র্যাকটিস চলছে। আলাদা করে তেমন অনুরোধ করতে হলো না। দ্রুত জার্সি পরে নিলেন তাঁরা। সব হাফপ্যান্ট খুঁজে পাওয়া গেল না। অগত্যা কেউ লুঙ্গিতে গিঁট মেরেই চাতালে নেমে গেলেন। দিদার বখত বনাম আসিরুল। তেলমাখা লাঠি হাতে মুখোমুখি ঘুরতে ঘুরতেই দিদার বখত মুখে চিৎকার তুলতেন। কটাকট কোপে পাড়াসুদ্ধ খবর হয়ে গেল। দেখার মতো খেলাই বটে। প্যাটার্ন চেঞ্জ হয়ে গেল। এবার মাথার ওপর লাঠি ঘুরছে। আর ডান-বাঁয়ে কোপ পড়ছে। দিদার বখত অবশ্য বেশিক্ষণ খেলতে পারলেন না। হাঁফ ধরে গেল। মোসলেম দেরি করলেন না। ত্বরিত লাঠি হাতে নেমে পড়লেন। ভিড়ের মধ্যেই থালায় গুড়-মুড়ি নিয়ে নাজমা এগিয়ে এলেন, ‘ন্যান, এটটু চাবান।’ পাল্টা কথা খুঁজে পেলাম না। দমাদম লাঠির কোপ পড়ছে। হই হই চিৎকারের ভেতর হারিয়ে গেল নাজমার মুখ।

No comments

Powered by Blogger.