অর্থনীতি-এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি ও জাতীয় ক্ষতি by জাফর আহমেদ চৌধুরী

২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মোট বরাদ্দের বিপরীতে মোট ব্যয় হয়েছে ৩৮ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরের তুলনায় চলতি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের অগ্রগতির হার ১ শতাংশ বেশি। কিন্তু বাস্তবায়নের এ অগ্রগতির হার ২০০৯-১০ অর্থবছরের তুলনায় ১ শতাংশ কম।


স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০১১-১২ সময়ে পাঁচটি অর্থবছরের ব্যতিক্রম ছাড়া সব অর্থবছরে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৯০ শতাংশের চারপাশে ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন বছরের প্রথম আট মাসে বিভিন্ন বছরে সর্বোচ্চ ৪২ শতাংশ হতে দেখা গেছে। আর বাকি প্রায় ৫০ শতাংশ বাস্তবায়ন শেষ চার মাসে হয়ে থাকে। এটি একধরনের জাদুকরী ব্যাপার। এ নিয়ে সমালোচনার পাল্লাও ভারী। মানুষ দেখে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে প্রচণ্ড কাজ। যখন আবহাওয়া খারাপ হতে থাকে, তখন খাল বা নদী খনন, বাঁধ বাঁধাই, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, বিভিন্ন দালানকোঠায় রং লাগানো ইত্যাদি কাজ মানুষের চোখে পড়ে। জনদুর্ভোগও তাতে হয়।
২০১১-১২ অর্থবছরে মূল এডিপির বরাদ্দ ছিল ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে স্থানীয় মুদ্রার পরিমাণ ২৭ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা বা বরাদ্দের ৫৯ শতাংশ। প্রকল্প সাহায্য বাবদ বরাদ্দ ছিল ১৮ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা বা বরাদ্দের ৪১ শতাংশ। অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মোট ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৩৮ শতাংশ। প্রকল্প সাহায্যের ১৮ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার মধ্যে ব্যয় হয়েছে চার হাজার ৯২০ কোটি টাকা অর্থাৎ ২৬ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে প্রকল্প সাহায্য ব্যবহারে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতা কম। সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় ২০১১-১২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি কাটছাঁট করে সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধিত এডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ মূল বরাদ্দ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রকল্প সাহায্য বরাদ্দ কমানো হয়েছে তিন হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। এমনিতে সরকারের ঘাটতি বাজেট। সার্বিক বাজেট সামাল দিতে সরকারকে অভ্যন্তরীণভাবে ঋণ নিতে হচ্ছে, যার পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে এডিপির আকার আরও ছোট করলেও অযৌক্তিক হতো না।
২০১১-১২ অর্থবছরে মূল এডিপিতে মোট এক হাজার ৩৯টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত ছিল। ৭০২টি অননুমোদিত বরাদ্দবিহীন প্রকল্প এডিপিতে সংযোজিত ছিল। সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দসহ অন্তর্ভুক্ত মোট প্রকল্পের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২২৮টি। মূল এডিপির চেয়ে সংশোধিত এডিপিতে প্রকল্প সংখ্যা বেড়েছে ১৮৯টি। বরাদ্দবিহীনভাবে ৫৩১টি অননুমোদিত প্রকল্পের তালিকাও সংশোধিত এডিপিতে রাখা হয়েছে।
উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নেও তাই অনেক ফাঁকফোকর থেকে যায়। যেসব প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে বা সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলোর মূল বরাদ্দ বা মূল বাস্তবায়নের সময়কাল ঠিক রাখা যায়নি। সমাপ্ত ৮১টি প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ১৬৫টি প্রকল্পের ক্ষেত্রে বাস্তবায়নকাল বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২৫৭টি সমাপ্ত প্রকল্পের মূল গড় প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ১১৫.৬৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রকৃত গড় ব্যয় হয়েছে ১৪৯.৩০ কোটি টাকা। ফলে ২৫৭টি সমাপ্ত বা সমাপ্ত ঘোষিত প্রকল্পের ক্ষেত্রে ৮৬৫০.৬২ কোটি টাকা প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে। অন্যদিকে এসব প্রকল্পের মূল পরিকল্পিত গড় বাস্তবায়নকাল ছিল ৩.৪৮ বছর। এর বিপরীতে প্রকৃত গড় বাস্তবায়নকাল দাঁড়িয়েছে ৬.১৯ বছর। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অনুমোদিত ও প্রকৃত ব্যয় এবং পরিকল্পিত ও প্রকৃত বাস্তবায়নকাল সম্পর্কে এটি একটা সম্যক চিত্র।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রকল্পগুলো তৈরি, অনুমোদন, এডিপিতে অন্তর্ভুক্তি, বাস্তবায়ন এবং বাস্তবায়নোত্তর সময়ে অনেক ধরনের সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা লক্ষ করা যায়। অনেক প্রকল্প তৈরি করা হয় তাড়াহুড়া করে। সার্বিক পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ ফলাফল ভালোভাবে পরীক্ষা করা হয় না। তাড়াহুড়া করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় যথাযথ মূল্যায়ন কম হয় চাপের মুখে, তদবিরের মুখে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিইসি সভায় প্রকল্প সংশোধন করে দিতে বলা হলে বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় থেকে তা ফেরত আসতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। পরিকল্পনা কমিশনের প্রোগ্রামিং কমিটির সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রায় হাজার খানেক প্রকল্প দ্রুত বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ প্রকল্প নতুন প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হলে সেগুলোর অনুমোদনের সুপারিশ করতে একটা বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়। বাস্তবায়ন পর্যায়ে অর্থবছরের শুরুতে ঢিলেমি দেখা যায়। কোনো কোনো প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণের আনুষ্ঠানিকতায় যথেষ্ট বিলম্ব ঘটে। প্রকল্পের ড্রয়িং, ডিজাইন, টেন্ডার দলিলাদি প্রণয়ন ও বাজেট বিভাজনেও কালক্ষেপণ করা হয়। বড় বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে টেন্ডার দলিলাদি প্রণয়ন, বিজ্ঞপ্তি জারি, টেন্ডার গ্রহণ, মূল্যায়ন, অনুমোদন ও কার্যাদেশ প্রদানে প্রায় ছয় মাস সময় অতিবাহিত হয়। আবার দৃশ্যমান বা অদৃশ্য হস্তক্ষেপ হলে তো কথাই নেই। কার্যাদেশ প্রদান ও চুক্তি স্বাক্ষরে এক থেকে দেড় বছর সময় চলে যেতে পারে। এতে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বেড়ে যায়। মন্ত্রণালয়গুলোতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে মাসে মাসে পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হলেও প্রকল্পের বাস্তব কাজের অগ্রগতি ও গুণগত মান নিয়ে গুরুত্বসহ আলোচনা হয় না। আর্থিক অগ্রগতি নিয়েই বেশি আলোচনা করা হয়। তা ছাড়া অর্থবছরের শুরুতে তিন কিস্তি অর্থ ছাড়ের সুযোগ থাকলেও তা যথাযথভাবে অনুসরণ না করায় অর্থ ছাড়ে বিলম্ব ও দীর্ঘসূত্রতা পরিলক্ষিত হয়। প্রকল্প সাহায্য অংশের প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড়ে অধিকতর বিলম্ব হওয়ায় যথাসময়ে প্রকল্প সাহায্য ব্যয় করা সম্ভব হয় না। প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও প্রকল্পের সমস্যা থেকে যায়। সংরক্ষণের জন্য ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয় না বা রাখা হলেও তা সঠিকভাবে ব্যয় করা হয় না। এ জন্য দেখা যায় যে উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় নির্মিত অনেক ইমারত, রাস্তা, সেতু, কালভার্ট কিছুদিন পর খারাপ হয়ে যায় এবং ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। অনেক ভৌত কাঠামো নির্মাণ হওয়ার পর দীর্ঘদিন অব্যবহূত থাকে। এগুলো লক্ষ করা গেছে হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি, যা উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। কাজের গুণগতমান এখন অনেক ক্ষেত্রে ধরে রাখা যাচ্ছে না।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়নে সরকারের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে নজর রাখা হয়। চলতি অর্থবছরে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০১১-১৫) মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী, দ্রুত দারিদ্র্য নিরসন ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। পরিকল্পনা দলিল অনুযায়ী, বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কতিপয় বিষয় ও ক্ষেত্রের ওপর। কিন্তু অব্যবস্থাপনার কারণে এসব কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সামষ্টিক অর্থনৈতক অস্থিতিশীলতা, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি, পানির জন্য হাহাকার এবং আইনশৃঙ্খলার খারাপ চিত্র দৃশ্যমান। কাঙ্ক্ষিত ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জনও প্রশ্নবিদ্ধ। সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এসব সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দসহ এক হাজার ২২৮টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে বরাদ্দবিহীনভাবে অননুমোদিত নতুন ৫৩১টি প্রকল্প এবং বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির সুবিধার্থে বরাদ্দ ব্যতিরেকে ২০৯টি প্রকল্পের তালিকা সংযোজন করা হয়েছে। অর্থবছরের অবশিষ্ট দুই মাসে এসব প্রকল্পে বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তি বা সম্পদ প্রাপ্তির আদৌ সম্ভাবনা নেই। চলতি সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ (১৭.৭৪ শতাংশ) দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে। তুলনামূলকভাবে কম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য (৮.৩০ শতাংশ) এবং কৃষি খাতে (৬.২৭ শতাংশ)। এ দুটি খাতে ব্যয় বরাদ্দ আরও বেশি হতে পারত। উন্নয়ন কর্মসূচিপ্রণেতারা এদিকে কম নজর দিয়েছেন।
২০১১-১২ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সম্ভাব্য সমাপ্য প্রকল্পের সংখ্যা দেখা হয়েছে ২০৬টি। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে রয়েছে ১০টি। এ প্রকল্পগুলো এক দশক বা এক যুগের আগে নেওয়া। প্রথম পর্যায়ের কাজের পর দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য নেওয়া এ প্রকল্পগুলো বিগত তিন বছরে শেষ করা গেলে ভালো হতো। উল্লেখ্য, বিগত তিন বছরে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। বাস্তবে জনগণের ভোগান্তি কমেনি। লোডশেডিংয়ের দৌরাত্ম্য চলছে। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দিনের বেলা সর্বোচ্চ সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি দেশের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চিত্র নয়। সাধারণ হিসাবে এটি ডিজিপির ৪ শতাংশ মাত্র। কিন্তু এ কর্মসূচির গুণীতক প্রভাব আছে। অর্থনীতিতে এই ৪ শতাংশের প্রভাব প্রায় সবক্ষেত্রে প্রসারিত। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে অবকাঠামো সৃজন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সুবিধাদি সৃষ্টি, নদীশাসন, পানি সরবরাহ, শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যসেবা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্য উৎপাদন ইত্যাদি উন্নয়ন করা হয়, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারিত। এসব কারণে সঠিকভাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ এবং তার বাস্তবায়ন অতীব প্রয়োজনীয়।
জাফর আহমেদ চৌধুরী: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক পরিকল্পনা সচিব।

No comments

Powered by Blogger.