প্রতিবেশী-উপনির্বাচন দেখতে মিয়ানমারে by মাহবুবুল হক রিপন

মিয়ানমারের রাজনীতির পর্যবেক্ষণে আমার কাছে মনে হয়েছে আরও কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে_ দুর্নীতি। এর ভয়াবহতা কী ধরনের তা বোধহয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নাগালের বাইরে। জেনারেলরা বানিয়েছেন প্রাসাদোপম ভবন। সমাজের সবাই জানেন এটা হয়েছে চীনা কোম্পানির ঘুষের টাকায়।


তবে মিয়ানমারের সুশীল সমাজের সদস্যরা মনে করে, তারা চীনের স্যাটেলাইট রাজ্যে পরিণত হবে না


মিয়ানমারের বহুল আলোচিত উপনির্বাচন দেখতে ইয়াংগুনে যেতে হলো গত ২৮ মার্চ। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টারের ওখানে লেখা আছে, যারা এই ইভেন্ট কভার করতে আসবেন সে গণমাধ্যম কর্মীরা যেন এখানে নিবন্ধিত হয়ে যান। যাক সেসবের তোয়াক্কা না করে চলে গেলাম বাঙালি অগ্রজপ্রতিমের পাঠানো গাড়িতে করে তার বাংলোবাড়িতে। গত এক বছরে ইয়াংগুনে নতুন গাড়ির আমদানি হয়েছে ব্যাপকভাবে। ফলে যথারীতি রাত ৮টায় কোথাও কোথাও ট্রাফিক জ্যাম। ঘূর্ণিঝড় নার্গিস-বিপর্যয়ের আগে পর্যন্ত ইয়াংগুন ছিল এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সবুজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রাজধানী। যদিও সামরিক জান্তা ততদিনে শত বছরের পুরনো রাজধানীকে পরিষ্কার করে কয়েকশ' মাইল দূরে নেপিয়াদোতে বানিয়েছে বিশাল এক রাজধানী। যা শুধু প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু। এখনও সরকারিভাবে এখানে মাইল বলা হয়। ওজন মাপার ক্ষেত্রে স্থানীয় পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এসব কথা থাক। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও গণতন্ত্রের পথে মিয়ানমারের ফিরে আসাই মূল প্রসঙ্গ।
৩০ মার্চ শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায় মিংগালা তানুইয়েন্ত, যা ইয়াংগুনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, সেই নির্বাচনী এলাকায় গেলাম প্রচার দেখতে। এনএলডির প্রার্থী দাউ ফিউ ফিই থিনের শেষ প্রচার মিছিল। ব্যাপক মানুষের উপস্থিতি। দাদি-নানি থেকে শুরু করে শিশুটিও এসে উপস্থিত। আর চারদিকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এনএলডির অনুষ্ঠানসূচি। মাঝে মধ্যে স্লোগানের আওয়াজ কম হওয়ার সময় প্রার্থী নিজেই মাইকে বলছেন সমবেত জনতার উদ্দেশে, আপনারা কি এখনও জান্তাকে কিংবা তার দল ইউএসডিপিকে ভয় পান? তাহলে এত আস্তে স্লোগান দিচ্ছেন কেন? এ এলাকার বড় অংশই হচ্ছে মুসলমান ভোটার। আর দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মানুষ। মুসলমানরা জাতিগতভাবে কয়েক ভাগে বিভক্ত মিয়ানমারে। একটা হলো স্থানীয়, যাদের অবয়ব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ানদের মতো, আরেক দল উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং পাকিস্তান থেকে আসা, যদিও এরা এসেছে ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলেই। শেষ দল হচ্ছে আরাকানের রোহিঙ্গারা। যদিও ইয়াংগুনে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা অনেকটা স্বাধীন এবং পীড়নমুক্ত অন্তত নিজেদের স্টেট, যা এখন উত্তর রাখাইন নামে পরিচিত, তার চেয়ে ভালো আছে এখানে। অং সান সু চি আর এনএলডির বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় মনে হচ্ছিল নিজেই জড়িয়ে পড়ি। কেননা আমার চেহারা এখানে পার্থক্য করা মুশকিল। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ ভোটারই দক্ষিণ এশীয় অথবা রোহিঙ্গা। লুঙ্গি-শার্ট পরিহিত আর প্রায় সবাই পান খাচ্ছে, রাস্তার ওপর চায়ের স্টলে উপচেপড়া ভিড় আর নির্বাচন নিয়ে জমজমাট আড্ডা। মাঝে মধ্যে কোথাও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ডাইলেক্টও শোনা যাচ্ছে। চায়ের স্টলগুলোতে গরম দুধ-চা আর পরোটা খাচ্ছে, যা সচরাচর অন্য এলাকাগুলোয় তেমন একটা দেখা যায় না। নির্বাচনের আগের তিন দিন সরকারি দল ইউএসডিপির তেমন একটা প্রচার চোখে পড়েনি। নির্বাচনী এলাকাগুলোতে দেয়াল লিখন নেই, পোস্টার কিংবা বিলবোর্ডও খুব বেশি পরিমাণে নেই। যদিও প্রার্থীরা এলাকায় গিয়েছেন, ভোটাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
এ এলাকার মানুষের মধ্যে দরিদ্র অবস্থার চেহারাটা চোখে পড়ার মতো। নাগরিক সুবিধাগুলো খুব বেশি নেই। বিদ্যুতের ভয়াবহ অবস্থা, গড়ে ছয় থেকে আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। এ সময়ে গরমের তীব্রতা বছরের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। যদিও মিয়ানমার বিদ্যুৎ রফতানি করছে থাইল্যান্ড এবং চীনে। বিশুদ্ধ পানির সংকটও একই অবস্থা। স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা ব্যবস্থার করুণ দশা। যারা বিত্তবান, সন্তানদের বিদেশে পড়াচ্ছেন অথবা হাতেগোনা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পাঠাচ্ছেন। সরকারকে এ বিষয়ে চাপ প্রয়োগ কে করবে? রাজনৈতিক দল কিংবা গণমাধ্যম, যার দুটিই কার্যত অনুপস্থিত।
১ এপ্রিলের বহু প্রতীক্ষিত নির্বাচন দেখার জন্য বের হলাম। কোথাও গাড়ি কিংবা অন্য কোনো বাহন দিয়ে ভোটার আনতে দেখিনি রাজনৈতিক কর্মীদের। কিংবা ব্যাজ পরে কেন্দ্রের আশপাশে অবস্থান করতেও তেমন কাউকে দেখা যায়নি। কয়েকটি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করে যেটা মনে হয়েছে বিশেষত তরুণ প্রজন্ম, যারা ভোট দেওয়ার এ সংস্কৃতির সঙ্গে একেবারেই পরিচিত নয়।
দুপুর ১২টা পর্যন্ত মিংগালা তানুইয়েন্ত ৭নং স্কুলে ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। মুসলিম অধ্যুষিত এ অঞ্চলের মহিলা-পুরুষদের দেখলাম জোহরের নামাজের পর লাইন ধরে আসছেন। আবার আরেকটু দূরে কেএসএস রেস্টুরেন্টের পাশের ওই ভবনের একটি বর্ধিত অংশে অস্থায়ীভাবে ভোটকেন্দ্র তৈরি হয়েছে। কেএসএস রেস্টুরেন্ট, যা হলো ইয়াংগুনের সবচেয়ে সুস্বাদু বিরিয়ানির দোকান, অনেকটা ঢাকার হাজির বিরিয়ানি কিংবা স্টার কাবাবের মতো। সেই রেস্টুরেন্টের সামনে একটা বোর্ডে ভোটার লিস্ট টাঙানো আছে। এলাকার লোকজন এসে নিজের নম্বর দেখে ভেতরে যাচ্ছে, বলপেন নিয়ে নির্ধারিত প্রতীকে টিক চিহ্ন দিচ্ছে। কম্পিউটারে বোতাম টিপা কিংবা ব্যালট পেপারে সিল মারার ব্যবস্থা নেই। অনেককেই অভিযোগ করতে দেখেছি মৃত মানুষের নাম কিংবা অন্য এলাকায় কারও নাম ঢুকে গেছে। ভোটকেন্দ্রে সেনাবাহিনী কিংবা রাস্তায় কোনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি চোখেই পড়েনি। মাঝে মধ্যে ভোটকেন্দ্রে আমার মতো দক্ষিণ এশীয় পর্যবেক্ষকদের চেয়ে শ্বেতাঙ্গ পর্যবেক্ষক-সাংবাদিকদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। যদিও এই দেশটিতে কোনো প্রেস ক্লাব নেই, যদিও ফরেন করেসপনডেন্ট ক্লাব আছে। তাও চলে সরকারের মর্জিমতো। ফলে মিয়ানমার সংক্রান্ত খবরের জন্য নির্ভর করতে হয় ব্যাংককের ফরেন করেসপনডেন্টদের ওপর। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই এনএলডি অফিসে ভিড় আর উল্লাস চোখে পড়ছে। লুঙ্গি-শার্ট কিংবা গেঞ্জি পরিহিত পান খেতে খেতে কী যে উল্লাস সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। সুপারমল, কাঁচাবাজার, বাসস্টপ যেখানেই যান এনএলডি আর অং সান সু চির জয়ধ্বনি। ভাবতেই অবাক লাগে, কীভাবে এত সমর্থনের পরও একটা দেশে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে কোনো গণঅভ্যুত্থান হয়নি। যাক, নির্বাচনের পরের দিন কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাদের একজন জিয়ে থিউ, ডেপুটি এডিটর, 'দি ভয়েস'। তরুণ সংবাদকর্মী অভয় দিচ্ছিলেন গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে মিয়ানমারে। অং সান সু চির পক্ষেই সম্ভব বহুধা বিভক্ত জাতিগত সংঘাতপূর্ণ এ দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে। তার মতে, আশি ভাগের মতো ভোটার উপস্থিতি ছিল এ উপনির্বাচনে। যদিও বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সু চির সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিতে বাধা আছে। যদিওবা পরবর্তী ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়। জিয়ে থিউ জানালেন, সংবিধান বাইবেল নয়। এটাকে পরিবর্তন করতে হবে মিয়ানমারের স্বার্থেই। আগে তো বিধি ছিল সু চি নির্বাচন করতেই পারবেন না। সেই বাধা অপসারিত হয়েছে। ফলে এখন হচ্ছে মিয়ানমারের গণতন্ত্রের উষালগ্ন।
এনএলডির দু'জন সদ্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দাউ ফিউ ফিউ খিন আর উ মান জহনি (বলা বাহুল্য, বয়স্ক সম্মানিত নারীর নামের আগে ডিএডবি্লউ আর পুরুষের ক্ষেত্রে ইউ ব্যবহার করা হয়) বললেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা আর সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টি করা সবচেয়ে জরুরি। কেননা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী মানুষের সংখ্যা অর্ধেকের কিছু কম। ফলে তাদের আস্থায় না রেখে দেশ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। যদিও বন্দুকের নলের মুখে গত ষাট বছর ধরে জোর করে দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখা হয়েছে। সুশীল সমাজের কয়েকজন সদস্যও আমাকে সেই কথাই বলছিলেন। যুদ্ধাবস্থা নিয়ে একটি স্থিতিশীল দেশ গড়া যায় না, বিগত বছরগুলোতে তাই প্রমাণিত হয়েছে।
মিয়ানমারের রাজনীতির পর্যবেক্ষণে আমার কাছে মনে হয়েছে আরও কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে_ দুর্নীতি। এর ভয়াবহতা কী ধরনের তা বোধহয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নাগালের বাইরে। জেনারেলরা বানিয়েছেন প্রাসাদোপম ভবন। সমাজের সবাই জানেন এটা হয়েছে চীনা কোম্পানির ঘুষের টাকায়। তবে মিয়ানমারের সুশীল সমাজের সদস্যরা মনে করে, তারা চীনের স্যাটেলাইট রাজ্যে পরিণত হবে না। যদিও সাম্প্রতিককালে ভারতীয়দের বাণিজ্যও সম্প্রসারিত হচ্ছে। অর্থাৎ জান্তা সরকার দুই বৃহৎ প্রতিবেশীকেই কমবেশি নজরানা দিয়ে সরকার পরিচালনা করছিল সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে।
মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীদের বড় অংশের বাস থাইল্যান্ডে। গত বিশ বছরে অন্তত কয়েক হাজার সেমিনার আর সভা-সমাবেশ করেছে। এক পর্যায়ে এরা ব্যাংককে মিয়ানমার দূতাবাস দখল করেছিল। চিয়ান মাই হচ্ছে এদের একটা বড় ঘাঁটি। দাতা সংস্থাগুলো জানিয়ে দিয়েছে, গণতন্ত্রের সংগ্রামের জন্য এটাই হচ্ছে অর্থ সরবরাহের শেষ বছর। এবার নিজেদের দেশে ফিরে গিয়ে গণতন্ত্র পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করো। কিন্তু অনেকেই দেশে ফিরতে আগ্রহী নয়। কথা হচ্ছিল সহপাঠিনী মিন মিন সেনের সঙ্গে, যিনি এখন অস্ট্রেলিয়ায় থিতু হয়েছেন। '৮৮-র আন্দোলনের কর্মী পরবর্তী সময় সশস্ত্র সংগ্রাম করেছেন, কিন্তু দেশে ফিরতে আগ্রহী নন। এই নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা দেশে ফিরে না গেলে গণতন্ত্র টেকসই কারা করবে?

মাহবুবুল হক রিপন :থাইল্যান্ডের মাহিদল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত
mahbubulh@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.