২০ এপ্রিল : সখীপুর এবং কাদেরিয়া বাহিনী by শওকত মোমেন শাহজাহান

২০ এপ্রিল টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধের একটি অগি্নগর্ভ দিন। এদিন সখীপুরে লেখকের নেতৃত্বে এই এলাকার ১০ জন ছাত্র সশস্ত্র মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলেন, যা কাদেরিয়া বাহিনী নামে পরিচিতি লাভ করে। সেদিন থেকে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস এই সখীপুরই ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং ১৭ থেকে ১৯ আগস্ট এ তিন দিন ব্যতিরেকে আর কখনো শত চেষ্টা করেও সখীপুর এলাকায় পাকিস্তানি সেনারা ঢুকতে পারেনি।


৩ এপ্রিল ১৯৭১ : পাকিস্তানি বাহিনী টাঙ্গাইল দখলের উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে অগ্রসর হয়। ঢাকা থেকে এর আগে আসা ইপিআর সদস্য ও টাঙ্গাইলের ছাত্র-যুবসমাজ টাঙ্গাইল জেলার মীর্জাপুর থানার সাটিয়াচোরায় প্রতিরোধ ব্যুহ গড়ে তোলে। বিকেলে যুদ্ধ হয়। আমরা পরাভূত হই। পাকিস্তানি বাহিনী টাঙ্গাইল শহর দখলে নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী শহরে ঢোকার আগ মুহূর্তে কাদের সিদ্দিকী টাঙ্গাইল ট্রেজারি থেকে এক ট্রাক অস্ত্র ও গোলা-বারুদ নিয়ে সখীপুর উপজেলার বড়চওনা গ্রামের ইদ্রিছের কাছে পাঠান সংরক্ষণের জন্য।
১৭ এপ্রিল ১৯৭১ : পাকিস্তানি বাহিনী ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে কালিহাতীতে ইপিআর-পুলিশ ও ছাত্র-জনতার যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কালিহাতীর সন্তান জামাল নিহত হন। এই যুদ্ধের ২০ দিন পর আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর (বর্তমানে মন্ত্রী) কাছ থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি এবং পরের দিন সখীপুর চলে আসি।
২০ এপ্রিল ১৯৭১ : লেখকের আহ্বানে বিকেল ৪টায় সখীপুর প্রাইমারি স্কুল মাঠে সখীপুরের বিভিন্ন গ্রামের ৬০-৭০ জন ছাত্র সমবেত হয়। ৫০ জন ছাত্র সে রাতেই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য ভারতে যাওয়ার সম্মতি জ্ঞাপন করে। রাত ১০টায় সখীপুর পাইলট স্কুল মাঠে সমবেত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় সখীপুর পাইলট স্কুলের আঙিনায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ছাত্র- মকবুল হোসেন তালুকদার খোকা, জয়নুল আবেদীন এবং করটিয়া সা'দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র এম ও গনি, মাজহারুল হক লেবু, মোশাররফ হোসেন খান মোতালেব (গুর্খা), সখীপুর পাইলট হাইস্কুলের ছাত্র আবু হানিফ আজাদ, শেখ মোহাম্মদ হাবীব, আবদুস সালাম মজনু, গোলাম মোস্তফা বড়চওনায় ইদ্রিশ কমান্ডারের কাছে রাখা অস্ত্র থেকে ১০টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে আমার নেতৃত্বে গঠিত হয় সংঘবদ্ধ মুক্তিবাহিনী। সারা বাংলাদেশে মুজিবনগর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার পর (১৭ এপ্রিল) সখীপুরে সর্বপ্রথম বর্ণিত ১০ জন সিংহশাবক সংঘবদ্ধ ও আনুষ্ঠানিক মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সখীপুর ও বর্ণিত ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ২০ এপ্রিল তাই সখীপুরবাসীর অহংকারের দিন। গৌরবের দিন। আত্মাভিমানের হিরণ্ময় স্মৃতির নন্দিত মাহেন্দ্রক্ষণ এবং সে দিন থেকেই এই দিনটি আমাদের তথা সখীপুরের সব মানুষের।
১০ জন ছাত্র ও আমি ২০ এপ্রিল ১০টায় ভারতের পথে যাত্রা করি। কিন্তু ২৩ এপ্রিল বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনী ময়মনসিংহের উপকণ্ঠে উপনীত হলে ময়মনসিংহ শহর অতিক্রম করতে না পেরে সখীপুরে ফিরে আসি। এলাকায় জনমত সৃষ্টি এবং আরো বেশি ছাত্র-যুবককে সংগঠিত করতে থাকি। ১৩ মে কাদের সিদ্দিকী আরো চারজন ছাত্রসহ সখীপুরে আসেন। ১৪ মে ঢাকা থেকে ভারতে যাওয়ার পথে ইপিআর সদস্যরা ভালুকা থানার আংগারগাড়া গ্রামের পরশুরাম ডাক্তারের বাড়িতে পুঁতে রাখা তিনটি থ্রি-ইঞ্চি মর্টার, তিনটি রকেট লঞ্চার, ৪৮ কার্টুন হ্যান্ডগ্রেনেডসহ ১৭টি গরুর গাড়ি ভর্তি অস্ত্র, গোলাবারুদ ও থ্রি নট থ্রি রাইফেল লেখকের নেতৃত্বে উদ্ধার করে সখীপুরে নিয়ে আসেন। পরদিন সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সিপাই বিধায় আমরা কাদের সিদ্দিকীকে কমান্ডারের দায়িত্ব অর্পণ করি এবং আমরা ১০জন, কাদের সিদ্দিকীর পাঁচজন ও নতুনভাবে ভর্তি আরো ১০ জনসহ সর্বমোট ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু এই সখীপুর থেকে।
এরপর ৮ জুন ছাত্র-যুবকদের নিয়ে পাঁচটি কম্পানি গঠন করা হয়। ৯ জুন সখীপুরের বহেড়াতৈলে কসম প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম কম্পানি কমান্ডার কাদের সিদ্দিকী, আর লেখক ৫নং কম্পানির কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সখীপুরে হেড কোয়ার্টার গোছানোর অতিরিক্ত দায়িত্বও লেখকের ওপর ন্যস্ত হয়।
২০ এপ্রিল তাই টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধ তথা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন। আর সখীপুর হলো মুক্তিযুদ্ধের একটি স্বর্ণালি মাইলফলক।
আজ ২০ এপ্রিল সখীপুরে উদযাপিত হচ্ছে সখীপুরে মুক্তিবাহিনী গঠনের ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
লেখক : সভাপতি, কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

No comments

Powered by Blogger.